ফাইল চিত্র।
“আজ আমার এই প্রৌঢ় বয়সে এসে উপলব্ধি করি, ওঁর থেকে কত কী শিখেছি! কেবল ফিল্মের খুঁটিনাটি নয়, একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ বাঙালির থেকে যা যা শিক্ষণীয়— তার সবটাই শেখার চেষ্টা করেছি মানিকদার থেকে।” লিখেছেন সিনেম্যাটোগ্রাফার সৌম্যেন্দু রায়; হাতে-গোনা যে ক’জন মানুষ এখনও জীবিত রয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম ইউনিটে, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
স্মৃতিকথন কোনও মানুষকে নানা রঙের আঁচড়ে চিনিয়ে দেয়; মানুষটি কোন দুর্লভ গুণের জন্য স্মরণীয়, তা-ও খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন অপর্ণা সেন লিখছেন, “একটা মহৎ গুণ ছিল ওঁর, কখনও ‘হয়নি’ বলে কোনো অভিনেতাকে নিরুৎসাহিত করতেন না।... একজন সংবেদনশীল পরিচালক হিসেবে তিনি এটুকু বুঝতেন যে হতোদ্যম মানুষের কাছ থেকে তার সেরা কাজটা আদায় করা কঠিন।” আলোচ্য বইটিতে বহু বিশিষ্ট মানুষের সত্যজিৎ-রোমন্থনে উঠে এসেছে এই বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের সৃষ্টির নানা দিক। সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী যেমন লিখেছেন তাঁর ছোটবেলার সন্দেশ পত্রিকা এবং সম্পাদক সত্যজিতের কথা— “আমার প্রথম গল্প ‘রজনীবাবুর দোকান’ বেরিয়েছিল ১৯৭৪-এ।... সঙ্গে ছবি এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। দেখে গর্বে বুক সাত হাত।” সত্যজিৎ-চর্চার জন্যে এই বইটি যে রীতিমতো প্রয়োজনীয়, তা উল্টে দেখলেই বোঝা যায়।
বিচিত্রপত্র-এর সত্যজিৎ প্রসঙ্গ
সম্পা: সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন চট্টোপাধ্যায়, সৌম্যকান্তি দত্ত
৫০০.০০
বিচিত্রা পাবলিশার্স
গোড়ায় ছিল পত্রিকার বিশেষ ‘সত্যজিৎ সংখ্যা’, তার শিরোনামও ছিল ‘একাই ১০০’। পাঠকেরা তা যখন সাগ্রহে কাছে টেনে নিলেন, অল্প কিছু দিনেই মুদ্রিত পত্রিকাটিও ফুরোল, সেই সময়েই এই বইয়ের ভাবনা শুরু। প্রকাশিত হল সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষ পূর্তির বছরে, মূল লেখাগুলিকে অবিকৃত রেখে, আরও অনেক লেখার যোগে, প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠার কলেবরে। সম্পাদকের ভাষায়, এই বইতে “যেমন সমকালীন চিন্তাভাবনা আছে, তেমন আছে সত্যজিতের কালে তাঁকে ঠিক কীভাবে মূল্যায়ন করা হত, তার আভাস।” সত্যজিৎ-কৃতি নিয়ে আকিরা কুরোসাওয়ার মন্তব্য ‘রায়ের সিনেমা না দেখার অর্থ হল সূর্য-চন্দ্র না দেখে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা’ বা আদুর গোপালকৃষ্ণনের বিশ্লেষণ— পথের পাঁচালী কী করে ভারতীয় ছবির ব্যক্তিত্ব বদলে দিয়েছিল— বহুপঠিত হলেও ফিরে পড়তে ভাল লাগে। চিত্রপরিচালক, সাহিত্যিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, অনুবাদক সত্যজিৎকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছেন লেখকেরা; ‘বিতর্কে সমালোচনায়’ অংশটিতে দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল সম্পাদিত অচলপত্র পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ টেগোর তথ্যচিত্রের কড়া সমালোচনা, সত্যজিৎ রায়-মৃণাল সেনের ‘সংঘাত’ ও ‘সহযোগিতা’র সম্পর্ক-বয়ান এই সময়ের পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানির সমালোচনা-ধারাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কেমন ছিল ‘ছেড়ে কথা না বলা’র সে কাল। সত্যজিতের পাঁচটি সাক্ষাৎকারের মুদ্রণ এই বইয়ের সম্পদ, বিশেষ করে সুভাষ চৌধুরীর নেওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ক সাক্ষাৎকারটি। নজর কাড়ে ‘বাংলাদেশে সত্যজিৎ’ পর্বটি, আর পরিশিষ্ট অংশে ছবি বিজ্ঞাপন প্রচ্ছদ পোস্টার অলঙ্করণ, ‘বাতিল জঞ্জালে সত্যজিৎ’— চমৎকার। এত কিছু দু’মলাটে পড়েও মনখারাপ হয় সাক্ষাৎকারে সন্দীপ রায়ের আক্ষেপে, এ শহর, রাজ্য বা দেশে এখনও কোনও পূর্ণাঙ্গ ‘রায় মিউজ়িয়ম’ নেই!
একাই ১০০
সম্পা: কৌশিক মজুমদার
৫৮০.০০
অন্তরীপ পাবলিকেশ
সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে প্রথম খণ্ডটি বেরিয়েছিল, এ বার দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত। পথের পাঁচালী ছবি মুক্তির বছর মনে রেখে দু’টি খণ্ডেই ভূমিকা-সহ ৫৫টি করে লেখা, অভিনব ভাবনা। লেখার সংখ্যাবাহুল্যে সাধারণত বিষয়ের পুনরাবৃত্তি-দোষের আশঙ্কা থাকে। এই বইটি সেই আশঙ্কা দূর করে, সম্পাদকের বিষয়বিন্যাসে। ক্যালিফর্নিয়া, বার্লিন, জ়ুরিখ, লন্ডন, মেলবোর্ন, ফ্রান্স, কানাডা, পূর্বতন সোভিয়েট ইউনিয়নে সত্যজিৎ-প্রভাব, বিবিসিতে সত্যজিৎ-চর্চা— এই সবই নতুন জগৎ, পাঠককে টানবে।
অপরাজিত সত্যজিৎ ২
সম্পা: সুখেন বিশ্বাস
৪২৫.০০
জার্নালিজ়ম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক-তালিকাও ঈর্ষণীয়— গুলজ়ার, মনোজ মিত্র, মমতাশঙ্কর, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, অশোক মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথ বসু, শর্মিলা রায় পোমো, তানভীর মোকাম্মেল, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, সুবীর মিত্র, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, মৈনাক বিশ্বাস-সহ প্রবীণ-নবীনের সমাবেশ, ভূমিকা সন্দীপ রায়ের। শুধু স্মৃতিমুগ্ধতা নয়, সমসময়ের আলোয় সত্যজিতের বহুমুখী প্রতিভার বিশ্লেষণ। পরিশিষ্টে ‘তথ্যচিত্র ও টিভি-চিত্রে সত্যজিৎ রায়’ গবেষকদের কাজে লাগবে।