চলচ্চিত্রযাপন
হরিসাধন দাশগুপ্ত
২২৫.০০
সপ্তর্ষি প্রকাশন
হরিসাধন দাশগুপ্ত এক দিন কালীঘাটে নিয়ে গিয়েছিলেন জঁ রেনোয়া-কে, কলকাতায় এসেছিলেন তখন এই ফরাসি পরিচালক, ছবির শুটিং করছিলেন— রিভার। ‘‘হঠাৎ দেখলাম রেনোয়াঁ সাহেব নেই আমাদের সঙ্গে— তারপর অনেক দূর গিয়ে দেখি— একটি ভিখারিণী শুয়ে রয়েছে হাত বাড়িয়ে, মরণাপন্ন। রেনোয়াঁ সাহেব মাটিতে বসে ঐ ভিখারির হাতে একটা টাকা রেখে হাত বোলাচ্ছেন, দেখছেন সে মরে গেছে কিনা, ওঁর চোখে জল।’’ হরিসাধনের লেখা গোটা বইটিতে এমনই নানা মানবিক মুহূর্ত। সে সব মুহূর্তের সঙ্গে ইতিহাসের অনুষঙ্গ মিশে গিয়ে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বইটির গুরুত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবশেষ ও আমাদের দেশভাগ-স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণস্থ চল্লিশের দশক, কমলকুমার মজুমদারের আড্ডা, সত্যজিতের চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার প্রস্তুতিপর্ব, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, ঋত্বিক ঘটক, শান্তিপ্রসাদ চৌধুরী, কালীসাধন দাশগুপ্ত... হরিসাধনের আত্মকথনের ভিতর দিয়ে অস্পষ্ট জলছবির মতো আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে বাঙালির ফেলে-আসা বর্ণময় অতীত। আর তাঁর মন্তব্যের মধ্যেই বিশ্লেষণ: ‘‘রেনোয়াঁর চোখ দিয়ে সত্যজিৎবাবু ও আমি দুজনেই বাংলাদেশকে দেখতে শুরু করলাম।’’ চেনা যায় লেখকের মধ্যে লুকিয়ে-থাকা দরাজ সৃষ্টি-উন্মুখ মানুষটিকেও। ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিনেমাটোগ্রাফির স্নাতক ও হলিউডে হাতেকলমে কাজ-শেখা এই মানুষটিই (১৯২৪-৯৬) ভারতীয় তথ্যচিত্রকে সাবালক করে তুলেছিলেন। সংযোজিত হয়েছে অনেকগুলি দুর্লভ ছবি। এমন একটি চমৎকার বইয়ে বানানের সমতা নেই, অত্যন্ত অগোছালো সম্পাদনা।
ঠাকুরবাড়ির গৃহসজ্জা
শান্তা শ্রীমানী
১৩০.০০
পত্রলেখা
১৮২৩ সালে তৈরি হল দ্বারকানাথ ঠাকুরের বৈঠকখানা বাড়ি বা বকুলতলার বাড়ি। বাড়ির ভোলবদল ১৮৩৫-এ। সেই বছরেই দোতলা হল বেলগাছিয়া ভিলা। অবন ঠাকুর প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনেছিলেন, বৈঠকখানা বাড়ির ‘‘সমস্ত তিনতলাটা দেখাত যেন মস্ত একটা নৌকা অনেকগুলো সোনার দাঁড় কালো জলে ফেলে প্রতীক্ষা করছে বার হবার হুকুম ও ঘণ্টা।’’ তবে ঋণমুক্তির জন্য দেবেন্দ্রনাথ দ্বারকানাথের সময়কার আসবাবপত্র দুর্লভ মূর্তি ছবি সবই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শোনা যায় ‘‘জোড়াসাঁকো বাড়ি হইতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলির প্রান্ত পর্যন্ত বাড়ির সব জিনিসপত্র সাজাইয়া পনেরো দিন ধরিয়া নিলামে সেগুলি বিক্রয় করা হইয়াছিল। নামি দামি জিনিস জলের দরে বিকাইয়াছিল।’’ শান্তা শ্রীমানীর বইটির প্রথম অধ্যায় ‘ঠাকুরবাড়ির গৃহসজ্জা’, সেখানেই আছে এমন সব মণিরত্ন। অন্য দু’টি অধ্যায় ঠাকুরবাড়ির বাবুয়ানি আর ঠাকুরবাড়ির বাগানবাড়ি। বাবুয়ানিতে জায়গা করে নিয়েছেন পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন, প্রসন্নকুমার, যতীন্দ্রমোহন, কয়লাঘাটার রমানাথ ঠাকুর। আর বাগানবাড়িতে প্রধান আসন অবশ্যই দ্বারকানাথের বেলগাছিয়া ভিলার। তা ছাড়া হরিমোহনের সাতপুকুরের গুপ্ত বৃন্দাবন, গোপাললাল ঠাকুরের আলমবাজারের টেগোর ভিলা আর যতীন্দ্রমোহনের মরকত কুঞ্জই বা কম কী? বইটি নানা তথ্যে আর গল্পে জমজমাট।
অলোকেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনাসংগ্রহ
সম্পাদক: সুধাংশুশেখর মুখোপাধ্যায়
৩০০.০০
গাঙচিল
বাবামশায়ের ছবির মস্ত রসবেত্তা ছিল তাঁর বালক চাকর রাধু। অবনীন্দ্রনাথ ছবি এঁকে রাধুকে দেখাতেন এবং রাধু যদি মত প্রকাশ করত শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি তা শুনতেন।— লিখেছেন অলোকেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ছবির রাজা ওবিন ঠাকুর-এ। তাঁর এই রচনাটি একদা মাসিক বসুমতী-তে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর গ্রন্থিত হওয়ার সময় ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন: ‘‘আমি সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক বা গবেষক নই, কিছু শোনা এবং কিছু নিজের জীবনে দেখা স্মৃতিপটে যা ধরা ছিল তাই এই বইটিতে ধরে দিলাম।’’ অবনীন্দ্রনাথ ও সুহাসিনী দেবীর এই জ্যেষ্ঠ পুত্র চিত্রশিল্পী তো ছিলেনই, মূর্তি নির্মাণেও খ্যাতি ছিল তাঁর। প্রচারবিমুখ আড্ডাপ্রিয় এই মানুষটি মনের তাগিদেই ছবি আঁকতেন, মূর্তি গড়তেন, এ সবের ভবিষ্যৎ-মূল্য নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। লিখতেনও চমৎকার, তাঁর ভাষার লালিত্যে, তথ্যের সম্ভারে অবনীন্দ্রনাথের পরম্পরার দীক্ষা-চিহ্ন স্পষ্ট। পিতৃদেবকে নিয়ে উল্লেখিত রচনাটির পাশাপাশি তাঁর এই রচনাসংগ্রহ-এ আছে ‘কবি ও তাঁর ছবি’ প্রবন্ধটি, রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা নিয়ে: ‘‘সূর্য যেমন সারাদিন প্রখর আলো দিয়ে সন্ধ্যায় রঙেতে মেঘেতে কত ছবি এঁকে বিদায় নেয়, এও কতকটা সেই রকম। সারা জীবন লেখার কারবার করে, যাবার আগে রেখার ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা।’’ রচনাসংগ্রহ-এ অ্যারেবিয়ান নাইটস্-এর দু’টি খণ্ডের গল্পগুলি মনে পড়িয়ে দেবে বিস্মৃত শিশুসাহিত্যিক অলোকেন্দ্রনাথকে। তাঁর হাত ধরে কমবয়সী বেশিবয়সী সব পাঠকই রূপকথার রাজ্যে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারবে।