মাতৃচেতনা: শ্রীমা সারদা দেবীর সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা।
ভারতচেতনায় ভগিনী নিবেদিতা
সম্পাদক: স্বামী চৈতন্যানন্দ
৩৫০.০০
উদ্বোধন কার্যালয়
‘‘নিবেদিতার আধ্যাত্মিক গভীরতার আন্দাজ পাওয়া যায় তাঁর শ্রীমায়ের সম্বন্ধে মূল্যায়ন দেখে। সে-সময় শ্রীমা সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ ছাড়া প্রায় আর কারও গুরুপত্নী ভিন্ন উচ্চতর ধারণা ছিল না।... এরকম একটা সময়ে নিবেদিতার শ্রীমায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ। শ্রীমা তাঁকে কন্যারূপে গ্রহণ করে তাঁর অতলান্ত স্নেহসাগরে ডুবিয়ে দিলেন। এই স্বাভাবিক স্নেহ-বন্যার পিছনে যে আধ্যাত্মিক উত্তুঙ্গতা আছে তা বুঝতে নিবেদিতার দেরি হয়নি।’’ লিখছেন স্বামী প্রভানন্দ, গ্রন্থ-ভূমিকায়। এই মাতৃচেতনার সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত নিবেদিতার দেশমাতৃকা-চেতনা। ভূমিকাতেই উল্লেখ পাই, ‘ধর্ম কী’ বোঝাতে গিয়ে নিবেদিতা এক বার বিবেকানন্দ বোর্ডিং হাউসের ছাত্রদের বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের মাতৃভূমিকে জানা, তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-আচার-আচরণসমন্বিত হৃৎস্পন্দনকে অনুভব করা। নিজের মায়ের সঙ্গে যে নিকট সম্পর্ক, সেই সম্পর্কে দেশমাতৃকার পূজা, তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, তাঁকে সেবা করা। ভারতবর্ষ তোমাদের জননী, ‘বন্দে মাতরম্’...।’’ বোর্ডিং হাউসে ভারতের মানচিত্র টাঙিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সামনের মানচিত্র যেটি দেখছ... সেটি তোমাদের মা, তোমাদের জননীর ছবি।’’
সম্পাদক লিখেছেন, ‘‘তাঁর প্রতিভা বহুমুখী— তার প্রকাশ জীবনের বহু ধারায়।’’ সেই ধারাগুলিকে বুঝে নিতেই প্রায় বারোশো পাতার এই গ্রন্থের আয়োজন। গ্রন্থের ছ’টি বিভাগের শুরুতে ‘নিবেদিতা প্রসঙ্গে’, আছে তাঁর সূচনাপর্ব, শিক্ষয়িত্রী রূপ, শ্রীমায়ের দৃষ্টিতে, সমকালীন ভারতীয় সংবাদে, শ্রীঅরবিন্দের চোখে; ‘মননে ও বিশ্লেষণে’ অংশে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা ত্রয়ী, তৎকালীন যুবসমাজ, কালী ও নিবেদিতা; ‘ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতি’ বিভাগে তাঁর সমাজ-ভাবনা, নারীমুক্তি, জাতীয় আন্দোলন; ‘শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শন’ বিভাগে তাঁর শিক্ষাচিন্তা, ভাষাশৈলী, পত্রাবলি, সাংবাদিক ও গ্রন্থ-সমালোচক নিবেদিতা, তাঁর ভারতশিল্প ও সংস্কৃতিভাবনা, ধর্মভাবনা; ‘অন্য চোখে অন্য রূপে’ অংশে অন্যের চোখে নিবেদিতা, আবার তাঁর চোখে নানা বিশিষ্টজন; সব শেষে ‘বিবিধ’ বিভাগে রচনা সঙ্কলন, জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি।
স্বয়ং ভগিনী নিবেদিতার জীবন ও কর্মপদ্ধতির গভীরে পৌঁছনো আজও দুরূহ। শতবর্ষেরও কিছু আগে, সমকালীন দেশ ও বিশ্বে তিনি ছিলেন জটিল ধাঁধা। তাই হয়তো তাঁর আপন বৃত্ত ও বৃহত্তর বলয় তাঁকে নিরন্তর ভুল বুঝত। যে দেশের কল্যাণপ্রকল্পে নিজের অস্তিত্ব, যশস্বী মেধাশ্রী এক ভবিষ্যৎ বলি দিয়েছিলেন, তারাই তাঁকে ‘ম্লেচ্ছ’ বলে দূরে সরিয়েছিল, ‘যুদ্ধপরায়ণা’ বলে বিস্মৃতির গহ্বরে ঠেলেছিল। একই সময়, বিদুষী শ্বেতাঙ্গিনী হয়েও পূর্বের তথাকথিত ‘অসভ্য’ জনজাতিকে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য নিজ জন্মভূমি তাঁকে নিয়ে অট্টহাস্য করত। বিন্দু বিন্দু করে এই সকল অত্যাচারের লিখিত প্রমাণ সঙ্কলন করেছেন প্রব্রাজিকা প্রবুদ্ধপ্রাণা।
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্যধারায় অবদানের জন্য ২০১৬ সালে তিনি নিবেদিতা পুরস্কার পেয়েছেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে বাগবাজারে যে স্কুলটি সিস্টার স্থাপন করেছিলেন, তার জন্য অর্থসংগ্রহের তাগিদে তিন বার বিদেশ, প্রধানত আমেরিকায় যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেখানে বহু বার ‘খবর’ হয়েছিলেন তিনি। কখনও তাঁর বক্তৃতা বিষয়ে টুকরো খবর প্রকাশিত হয়েছে, কখনও তাঁর লেখা বইগুলির আলোচনা, কখনও মতামত পাতায় মার্গারেটের নিবেদিতা হয়ে ওঠা নিয়ে অভিনব ব্যাখ্যা, কখনও একেবারে প্রথম পাতায় তিনি— বিষয় হল, নিবেদিতা কি তন্ত্রমন্ত্র জানেন? দ্য বস্টন গ্লোব, দি আমেরিকান, প্যারিসের দ্য বুরবোঁ নিউজ় প্রভৃতিতে প্রকাশিত ছবি ও মূল খবরের প্রতিলিপি, অমৃতবাজার পত্রিকা ও দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার লন্ডন ও আমেরিকার প্রতিনিধি মারফত পাঠানো সংবাদ একত্র করেছেন প্রবুদ্ধপ্রাণা। সাতটি মূল বিষয়বিভাগে সুবিন্যস্ত বইটি। যেমন ভারতীয় নারীদের সপক্ষে নিবেদিতা, ভারতের জাতীয়তাবাদের রক্ষায়, বেদান্ত ও ধর্মের ঢাল রূপে ইত্যাদি। প্রতিটি বিষয়ে পরিবেশিত সংবাদ-সারণির প্রথমে রয়েছে বিশ্লেষণ। বিষয়টি নিয়ে নিবেদিতা আদতে কী ভাবতেন এবং পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম তা কোন আঙ্গিকে ও কেন দেখেছিল, তা বিশদে বোঝানো হয়েছে। জোসেফিন ম্যাকলয়েড (সিস্টারের ‘ইয়ুম’) ও নিবেদিতার চিঠিগুলি, জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা জেজি থর্পের চিঠিসমূহ বিষয়গুণে তো বটেই, কিংবদন্তির হস্তাক্ষর সংরক্ষণের স্বার্থেও দুর্মূল্য। সংবাদের কর্তিকা, এই পত্রসম্ভার এবং সে কালের সভাস্থল ও বাড়িগুলির আলোকচিত্র, বক্তৃতার প্রাক্মুহূর্তে সিস্টারের ছবিগুলি সেই সময়টিকে জীবন্ত করে তোলে।
সিস্টার নিবেদিতা ইন কনটেম্পোরারি নিউজ়পেপার্স
সম্পাদক: প্রব্রাজিকা প্রবুদ্ধপ্রাণা
৩০০.০০
শ্রী সারদা মঠ
‘‘শৈল-মূলে সন্ন্যাসিনীর চিতা শয্যা রচিত হইল।... নূতন গৈরিকবাসে তাঁহার দেহ আবৃত, মুখখানি খোলা। মনে হইল ঘুমাইতেছেন। দক্ষিণ করখানি বক্ষের উপর ন্যস্ত। কিন্তু করধৃত রুদ্রাক্ষের মালা আজ স্থির, নিশ্চল। মুখাগ্নির পূর্বে সমবেত কণ্ঠে শোক-গম্ভীর সুরে প্রার্থনা করা হইল। পর্বতমালায় সেই প্রার্থনার প্রতিধ্বনি উঠিল।
শেষ সংবাদে নিবেদিতা
সম্পাদক: গৌতম বাগচি
২০০.০০
পারুল প্রকাশনী
রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের এক সন্ন্যাসী মুখাগ্নি করিলেন। মুহূর্তমধ্যে চিতা জ্বলিয়া উঠিল। উপস্থিত সকলের বিহ্বল দৃষ্টির সম্মুখে নিবেদিতার নশ্বর দেহ বহ্নিস্পর্শে ধীরে ধীরে ছায়া বইয়া, বিম্ব হইয়া মিশিয়া গেল মহানিঃশব্দের অন্তহীন তমিস্রায়।...’’ ১৯১১-র ১৪ অক্টোবর এই বিবরণ প্রকাশ করেছিল ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকা। আগের দিন, ১৩ অক্টোবর দার্জিলিঙের ‘রায় ভিলা’য় মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়েসে প্রয়াত হয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা। কলকাতায় প্রথম শোকসভা হল ২৩ অক্টোবর, বাগবাজারে নন্দলাল বসুর বাড়িতে। সভাপতিত্ব করেন মতিলাল ঘোষ, আর এই সভায় নিবেদিতা সম্পর্কে স্বরচিত সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত পাঠ করেন কিরণচন্দ্র দত্ত। পরের সভা ২৩ মার্চ ১৯১২, টাউন হলে। সভাপতি স্যর রাসবিহারী ঘোষ। সমসাময়িক বাংলা ও ইংরেজি পত্রপত্রিকায় নিবেদিতার জীবনাবসানের এমন নানা সংবাদ ও স্মৃতিচারণের হদিশ মেলে। গৌতম বাগচির বইটি এই সব থেকেই নির্বাচিত সঙ্কলন। আছে নিবেদিতার ১৯০২-এর বক্তৃতা ‘হাও অ্যান্ড হোয়াই আই অ্যাডপ্টেড দ্য হিন্দু রিলিজিয়ন’, ‘স্টার-পিকচার্স’, এবং রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’-র ইংরেজি অনুবাদ। সংযোজিত হয়েছে নিবেদিতার জীবনপঞ্জি, সঙ্গে বেশ কিছু ছবি।