মুখে মুখেই প্রবাদের জন্ম

উনিশ শতকে ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকার সম্পাদক নীলরত্ন হালদার প্রথম বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত নীতিবাক্য ও প্রবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করেন কবিতা রত্নাকর (১৮২৫, ২য় সং ১৮৩০) বইয়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৯ ০৮:১৭
Share:

উনিশ শতকে প্রবাদচর্চা, খণ্ড ১-২
সম্পাদক: রমেনকুমার সর
৬০০.০০ প্রতি খণ্ড
বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ

Advertisement

বাংলা ভাষায় প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার যে সুপ্রাচীন তাতে সন্দেহ নেই। লোকসমাজে পরম্পরাবাহিত এই প্রবাদের অস্তিত্ব, সুশীলকুমার দে-র মতে, গ্রন্থাদি রচনার বহু পূর্বেও ছিল। ‘‘এগুলি রচনা করিবার জন্য রচিত হয় নাই, মানুষের মনে আপনি জন্মিয়াছে, তাই মানুষের মুখে আপনি প্রচলিত হইয়াছে। প্রথম যিনি, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের জ্বালা-পরম্পরার দুঃসহতা... অনুভব করিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার প্রত্যক্ষ ভাবটি দৈনন্দিন সাধারণ বুদ্ধির টুকরা হিসাবে বিবৃত করিয়া যে ক্ষিপ্র টিপ্পণী কাটিয়াছিলেন, তাহা ক্রমে অভ্যস্ত বাক্যে, জনশ্রুতিতে বা প্রবাদে পরিণত হইয়াছিল।’’ আবার কবিদের বিভিন্ন জনপ্রিয় লেখার অংশবিশেষও লোকের মুখে মুখে প্রবাদের জন্ম দিয়েছে। বাংলা ভাষায় প্রাচীনতম সাহিত্যসৃষ্টি ‘চর্যাগীতি’ কি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ প্রমুখের রচনা অজস্র প্রবাদের উৎস। উনিশ শতকে ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকার সম্পাদক নীলরত্ন হালদার প্রথম বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত নীতিবাক্য ও প্রবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করেন কবিতা রত্নাকর (১৮২৫, ২য় সং ১৮৩০) বইয়ে। ১৮২৬-এ তিনি বিভিন্ন ভাষার প্রবাদ সঙ্কলন করেন বহুদর্শন বইয়ে। অনেক গবেষক রেভারেন্ড উইলিয়াম মর্টনকে তাঁর দৃষ্টান্তবাক্য সংগ্রহ (১৮৩২) বইয়ের জন্য প্রথম বাংলা প্রবাদ সংগ্রাহকের গৌরব দিতে চান। কিন্তু আলোচ্য বইয়ের সম্পাদক দেখিয়েছেন, নীলরত্নেরই সে সম্মান পাওয়া উচিত। তবে রেভারেন্ড জেমস লঙ এ কাজে সব থেকে বড় ভূমিকা নেন। ১৮৬৮ থেকে ১৮৭২-এর মধ্যে পণ্ডিত নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যে তিনি প্রকাশ করেন প্রবাদমালা-র তিনটি খণ্ড, যেখানে সংগৃহীত হয় প্রায় ৬০০০ প্রবাদ। এরই সঙ্গে সন্ধান পাওয়া গিয়েছে আর এক বাঙালি প্রবাদ সংগ্রাহকের— ১৮৯০-এ শিলচর, কাছাড় থেকে হরকুমার ভট্টাচার্য প্রকাশ করেন রত্নাকর বইটি। ১৮৯৩-এ প্রকাশিত দ্বারকানাথ বসুর প্রবাদ-পুস্তক কিন্তু নিছক সংগ্রহ নয়, প্রবাদ কী, তার গুরুত্ব কোথায় তা নিয়ে সেখানে আছে বিস্তারিত আলোচনা। আবার ১৩০৫-৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত মধুমাধব চট্টোপাধ্যায়ের তিন খণ্ড প্রবাদ-পদ্মিনীতে আছে প্রতিটি প্রবাদের ব্যাখ্যা। সম্পাদক দু’টি খণ্ডে নীলরত্ন হালদার থেকে মধুমাধব চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত উনিশ শতকের প্রবাদ-সংগ্রহগুলি পূর্ণাঙ্গ ভাবে সঙ্কলন করেছেন, কিছু কিছু হুবহু প্রতিমুদ্রিত। দুর্লভ বইগুলি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সৌজন্যে সুলভ হল।

Advertisement

দ্য গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক/ দ্য স্ট্রাগল টু সেভ দি ওয়েস্টার্ন হিমালয়াজ়
সঞ্জীব পাণ্ডে ও অ্যান্টনি জে গ্যাসটন
১৫০০.০০
নিয়োগী বুকস

শ্রাবণ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার দেখা নেই। চেন্নাই ভয়াবহ জলসঙ্কটে ভুগছে। প্রকৃতির উপর যে অত্যাচার চলেছে তার ফল মিলছে। রেহাই পায়নি পশ্চিমী বিশ্বও। এই গ্রীষ্মে প্যারিসের তাপমাত্রা পুরুলিয়া শহরকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এটাই ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ সুযোগ। সেই সুযোগের যাঁরা সদ্ব্যবহার করতে চান তাঁরা পড়ে দেখতে পারেন আলোচ্য বইটি। সালটা ১৯৭৯। স্থান হিমাচলপ্রদেশ। পশ্চিম হিমালয় জুড়ে সমীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেন অ্যান্টনি জে গ্যাসটন। ভারত সরকারের অনুমতিও মেলে। কয়েক জন ছাত্র এবং বেশ কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাজ্যের বন দফতরের সদস্যদের নিয়ে ১৯৮০-র অক্টোবর পর্যন্ত সেই সমীক্ষা চলে। এই সমীক্ষা থেকে বোঝা যায় প্রাণী এবং উদ্ভিদের সমাহারে কতটা ধনী হিমালয়ের এই অংশ। পরে এই অঞ্চলটিকে জাতীয় উদ্যান (গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক বা জিএইচএনপি) বলে ঘোষণা করা হয়। এখন এটি ইউনেস্কো ঘোষিত হেরিটেজ সাইট। কাজ অবশ্য থেমে থাকেনি। এর পরেও এই অঞ্চলে বেশ কয়েক বার সমীক্ষা করেছেন গ্যাসটন। এই বইয়ে রয়েছে সেই সব সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের সমাহার। মূলত ন’টি অধ্যায়ে এই জাতীয় উদ্যানের বিশদ বর্ণনা, উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নিয়ে আলোচনা রয়েছে। রয়েছে অনেক রঙিন ছবিও। শুধু বর্ণনায় সীমাবদ্ধ না থেকে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও সার্বিক আলোচনা করেছেন দুই লেখক। গবেষক থেকে প্রকৃতিপ্রেমী পাঠক— বইটি সবাইকে টানবে। সঞ্জীব পাণ্ডে জিএনএইচপি-র ডিরেক্টর ছিলেন, বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা আদায়ে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন আর অ্যান্টনি (টনি) গ্যাসটন গত পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতীয় বন্যপ্রাণ, বিশেষত পাখি নিয়ে চর্চায় মগ্ন। জিএনএইচপি গড়ার বিভিন্ন পর্বে যুক্ত ছিলেন তিনি।

কীর্তন কথা
সম্পাদক: জয়ন্ত রায়
৬৫০.০০
আত্মজন ও পত্রলেখা

বিদ্যাপতি যত প্রেমের পদ লিখেছেন, বিশেষত যে পদগুলিতে তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক অথবা পছন্দের মানুষের নাম উচ্চারণ করেছেন, তার মধ্যে মিথিলারাজ শিবসিংহের নামই সব থেকে বেশি। তিনিই বিদ্যাপতির পদাবলির রসসন্দর্ভের সব থেকে বড় সমঝদার। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ইতিহাসের পাতা উল্টে সেই শিবসিংহের কথা তুলে ধরেছেন বইয়ের শুরুতেই। বাংলা কীর্তন নিয়ে এ পর্যন্ত গবেষণা কম হয়নি, তবে দুই মলাটে কীর্তনের বহুবিচিত্র দিকের উপর আলো ফেলার এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এত বড় সঙ্কলনে সব লেখার মান এক নয়, কোনও কোনও লেখা নিছক দায়সারা। গুগ্‌ল থেকে নেওয়া ছবির সম্ভার বইয়ের গুরুত্বের সঙ্গে অসমঞ্জস। এ সব সত্ত্বেও নানা লেখায় বাংলা কীর্তনের জগতের যে সমৃদ্ধ ছবি ফুটে উঠেছে তা অন্যত্র দুর্লভ। ছ’শো পাতার এই বিপুল বইয়ের কয়েকটি মাত্র লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে— কাননবিহারী গোস্বামীর ‘রেণেটী কীর্তন ও বাঘনাপাড়া’, বিনয়কুমার মাহাতা-র ‘পালা-কীর্তন ও ঝাড়খণ্ডি ধারা’, প্রভাতকুমার দাসের ‘বীরভূমের কীর্তন ও যাত্রাগান’ (বিশেষত ময়নাডালের মিত্রঠাকুরদের কথা), সুমন ভট্টাচার্যের কীর্তনের আখর-প্রসঙ্গ, সুরঞ্জন মিদ্দে ও শেখ মকবুল ইসলামের খ্রিস্টকীর্তন-কথা, সনৎকুমার পুরকাইতের ‘বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী’, শিবপ্রসাদ পাল, হরেকৃষ্ণ হালদার ও দিওতিমা চৌধুরীর শ্রীখোল-প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা, সঞ্চারি দাশশর্মার ‘শিখধর্ম ও কীর্তন’, অনন্যা ভট্টাচার্যের ‘নরোত্তম দত্ত ঠাকুর’ প্রভৃতি লেখা বৈচিত্রের স্বাদ এনে দিয়েছে। শুধু প্রবন্ধের তথ্যসূত্র নয়, সামগ্রিক ভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একটি গ্রন্থ ও প্রবন্ধপঞ্জি থাকলে গবেষক ও আগ্রহীজনের সুবিধা হত। বিষয়ের ব্যাপ্তি যেখানে অনেকটাই, সেখানে দরকার ছিল একটি নির্ঘণ্টও। গবেষক ও শিল্পীদের একত্র করে এমন একটি কাজ জরুরি ছিল।

সুকুমার রায়: জীবনকথা
হেমন্তকুমার আঢ্য
৪০০.০০
খোয়াবনামা

‘‘... (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ) লাইব্রেরিতে বসে তত্ত্ব-কৌমুদী ঘাটছি।... হঠাৎ মনে হল সময় এখানে যেন সেই ১৯২৩-এ থেমে গেছে। একটু আগেই ব্রাহ্ম যুবকদের সভা শেষ হয়েছে। কাছাকাছি ঘুরছেন প্রশান্ত মহলানবীশ, হিরণ সান্যাল, আশাকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমলাংশুপ্রকাশ প্রমুখরা। হঠাৎ সুকুমার রায় এখানে চলে আসতে পারেন ব্রাহ্মধর্মসংক্রান্ত কোনো বই ফেরত দিতে। তিনি বেঁচে থাকলে ব্রাহ্মধর্মান্দোলন হয়তো অন্যদিকে মোড় নিত। নতুন করে প্রাণের জোয়ার আসত।’’ সুকুমার রায়ের (১৮৮৭-১৯২৩) জীবনীর তথ্য সংগ্রহে ঘুরতে ঘুরতে লেখক যেন পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর বছরে। বহুমুখী প্রতিভার এই অকালপ্রয়াত মানুষটি বাঙালির কাছে মূলত আবোল তাবোল কি হ য ব র ল-এর মতো ছোটদের বইয়ের স্রষ্টা হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু তার সঙ্গে চিত্রশিল্পী, সম্পাদক, মুদ্রণ-বিশেষজ্ঞ, ব্রাহ্ম আন্দোলনের নবীন নেতা রূপে তাঁর ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা গভীর অনুসন্ধান দাবি করে, কারণ লীলা মজুমদারের লেখা সংক্ষিপ্ত বইটি এবং কিছু স্মৃতিচারণ বাদে সুকুমার রায়ের কোনও পূর্ণাঙ্গ জীবনী তাঁর জন্মশতবর্ষ পেরিয়েও লভ্য ছিল না। ১৯৯০ সালে হেমন্তকুমার আঢ্য তাঁর জীবনীগ্রন্থটি রচনা করেন। মাঝে একটি সংস্করণ সত্ত্বেও দুর্লভ সেই বইটি অনেক বড় আকারে, অনেক চিত্র-সহ এ বার প্রকাশ পেল শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়ার সম্পাদনায়। বিশেষ করে সুকুমার রায় ও ভারতীয় চিত্রশিল্প বিতর্ক, ব্রাহ্ম যুবসমিতিতে সুকুমারের ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথকে সাম্মানিক সদস্য করা নিয়ে বিতর্ক, ব্রাহ্ম ‘ফ্রেটারনিটি’র কথা, প্রশান্তচন্দ্রকে লেখা ‘ব্যক্তিগত’ চিঠি, শোকবার্তা ও প্রয়াণ সংবাদ সঙ্কলন ছাড়াও আছে সুশোভন সরকারের স্মৃতিকথা ও সুকুমারের বিস্তারিত জীবনপঞ্জি।

চরিত্র চিত্র
দীনেন্দ্রকুমার রায়
২০০.০০
খড়ি প্রকাশনী

রবার্ট ব্লেক ও তাঁর সহকারী স্মিথকে নিয়ে লেখা বহু গোয়েন্দাকাহিনির সঙ্গে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের (১৮৬৯-১৯৪৩) পল্লীকথা, পল্লীবৈচিত্র্য, পল্লীচিত্র সুপরিচিত। কিন্তু আর একটি বই পল্লীচরিত্র (আনু. ১৯২৩ সালে প্রথম প্রকাশিত) ছিল দুষ্প্রাপ্য। সুকুমার সেনের মতে এগুলি ‘মনোহর প্রবন্ধ’, আর লেখকের মন্তব্য ছিল, ‘‘এই গল্পগুলিতে যে সকল চরিত্র অঙ্কিত হইয়াছে তাহা পল্লীগ্রামের পুরুষ ও রমণীগণের চরিত্রের আলেখ্য।... আমি কোন চরিত্রই অতিরঞ্জিত করি নাই, যেমন দেখিয়াছি, তেমন আঁকিয়াছি।’’ পরে দীনেন্দ্রকুমার আরও কয়েকটি চরিত্রচিত্র সৃষ্টি করেন। বর্তমান সঙ্কলনে দেবীপ্রসাদ ঘোষ মূল বইয়ের সাতটি চরিত্রের সঙ্গে আরও দু’টি চরিত্র যোগ করেছেন। দত্ত গিন্নি, সেকালের ডেপুটি, বাবাজী, রাত চোরা গরু প্রভৃতি রচনায় সে কালের গ্রামবাংলার যে ছবি ফুটে ওঠে, তা অনন্য। তবে সবার সেরা বোধহয় ‘গ্রামের পিসিমা’— যাঁকে দেখে পল্লির যুবতীরা বলত ‘পিসিমা যেন পাকা আমটি’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement