সূচনাপর্ব: সত্তর দশকের গোড়ায় অভিনেতৃ সঙ্ঘের ‘বিদেহী’ নাটকে আরতি ভট্টাচার্য ও নীলিমা দাসের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি: নিমাই ঘোষ।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা নাট্যসাহিত্যে আধুনিকতার যে চার পুরোধা নাট্যকার, সেই বিজন ভট্টাচার্য, বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও মনোজ মিত্র, তাঁদের থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেখানে অনেকটাই ভিন্ন, সে হল তাঁর ‘মৌলিকতা’র অভাব! তিনি নিজেও সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাঁর নাট্যসমগ্র-এর তিন খণ্ডেরই ‘কথামুখ’-এ তিনি তাঁর ‘রচিত নাটকগুলির একটা বড় অংশই’ যে ‘যাকে বলে অ্যাডাপটেশন— অর্থাৎ যা অন্যান্য নাটক বা কথাসাহিত্যকে অবলম্বন করেই নির্মিত’, এ বিষয়ে তাঁর ‘বক্তব্য’— ‘কৈফিয়ত নয়’— ‘জানাবার একটু তাগিদ অনুভব’ করেছেন। অথচ নব্বইয়ের দশক থেকেই লক্ষ করছি, বিদেশেও নতুন তথাকথিত ‘মৌলিক’ নাটকের একই আকাল। টম স্টপার্ড, ডেভিড হেয়ার-এর মতো অগ্রগণ্য ইংরেজ নাট্যকাররাও চেখভ, লোরকা, ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ-এর মতো নাট্যকারদের নাটকের নতুন অনুবাদ বা রূপান্তরণ করছেন। ইয়োরোপীয় থিয়েটারে ফিরে আসছেন সেরভান্তেস, বালজ়াক, মান, এউরিপেদেস। যুগ পরিবর্তন না কি যুগ সঙ্কটের ক্ষণেই কি ক্ল্যাসিক্স বা চিরায়ত সাহিত্যে ইতিহাস-সন্ধানের এই তাড়না? জার্মানিতে নাটক দেখতে গিয়ে তা-ই মনে হয়েছে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই রূপান্তরণের প্রয়াসের মধ্যে যেমন অন্য আরও কিছু প্রণোদনা লক্ষ করেছি, ঠিক তেমনই যা উঠে এসেছে তা এক মননশীল, স্বাধীন চিন্তায় অভ্যস্ত অভিনেতার আত্মবীক্ষণ। সেই আত্মবীক্ষণের মধ্যেই আছে থিয়েটারি আধুনিকতার বীজ। থিয়েটারে আধুনিকতার বিবর্তন এগিয়েছে নক্ষত্রস্বরূপ অভিনেতার অতিরেকী আত্মপ্রক্ষেপণকে সংযত-সংবৃত করে নাটক বা নাট্যের পরিপূর্ণ বৈভব ও তাৎপর্যকে উদ্ঘাটন করার লক্ষ্য ধরে। মনে হয়, প্রথম খণ্ডে সঙ্কলিত অধিকাংশ নাটক লেখা হয়েছিল কলকাতার পেশাদার থিয়েটারে একটু অন্য স্বাদ আনতে কমেডির ঔজ্জ্বল্য, বা পেশাদার থিয়েটার-সিনেমার জেল্লার আড়ালে অন্তর্দহনের যন্ত্রণার মেলোড্রামা বা মঞ্চবাস্তবতার যাথার্য্য বা টানটান উত্তেজকতার আঁট বুননের অন্যতায়।
সিনেমার বাইরে থিয়েটারের এক স্বাধীন ভূমিতে থিয়েটারকে খুঁজতেই বিদেশি নাটক-নাট্যের সঙ্গে তাঁর এই আলাপচারিতা। অভিনেতা বা নাট্যনির্দেশক যখন নাট্যকার হন, তখন নিজের গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের তাৎক্ষণিক চাহিদা— যার মধ্যে প্রায় অবধারিত ভাবেই চটজলদি জমিয়ে দেওয়ার একটা দায়-পূরণের যে টানাপড়েন থাকে, তা কিন্তু সৌমিত্রবাবুকে কখনওই তার ফাঁদে ফেলেনি। বা সে ভাবে তিনি তাঁর এই নাটকমালাকে নিজেকে আরও বড় করে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করার নাট্যপীঠ বিবেচনা করেননি। ‘টিকটিকি’, ‘নামজীবন’, ‘রাজকুমার’, ‘নীলকণ্ঠ’ এই বিচারেই স্মরণীয়। কিন্তু এই দাবিপূরণের তাৎক্ষণিকতার বাইরেই সৌমিত্রবাবু যে ভাবে থিয়েটারে আধুনিকতার ক্ল্যাসিক্সগুলির মধ্যে নতুন নাট্যভাষার ধাতকে ধরেছেন ব্রেখ্ট, ড্যুরেনমাট, কাম্যু বা পিন্টার-এর নাট্যরূপান্তরে, তাতে ওই নাট্যভাষাকে ধরতে পারার প্রবল নিষ্ঠার গুণেই মানবসম্পর্কের অন্তঃসলিলা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, ঘাতপ্রতিঘাতের সূক্ষ্ম, গোপন অভিঘাত থিয়েটারের বিষয় হয়ে ওঠে।
নাটকসমগ্র ১-৩
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
৫০০.০০ (১ ও ২ খণ্ড), ৬০০.০০ (৩ খণ্ড)
আনন্দ পাবলিশার্স
পড়তে পড়তে বোঝা যায়, সাবেকি প্লটের স্বতঃসিদ্ধতাকে ভাঙার যে সিদ্ধতা তিনি এই রকম এক একটি নাটকে (যা অনেক সময় অপ্রযোজিত থেকে গিয়েছে) আয়ত্ত করেছেন, তাতেই সেই শক্তি তিনি পেয়ে গিয়েছেন যাতে অভিনেতার মুখোশ বিদীর্ণ করে তিনি যেন অন্তর্দীর্ণ মানুষের মুখকে থিয়েটারে উপস্থিত করতে পারেন ‘আত্মকথা’, ‘ছাড়িগঙ্গা’, ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’-এর মতো নাটকে। অভিনয়ের চাতুরি তথা মুখোশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে চরিত্রের প্রচণ্ড অভিজ্ঞতার মুখকে প্রকট করতে নাটকের যে নির্মম মিতকথন নাট্যকার সৌমিত্র তাঁর নাটকের ভাষায় নিয়ে এসেছেন, তা পুরনো বাংলা নাটকের উচ্চারণ-কথনবহুল নাটকীয়তা থেকে এত দূরই সরে এসেছে যে তার মৌলিকতা নাটকের সূত্র বা উৎসের ‘অমৌলিকতা’কে অবান্তর করে দেয়।
১৯৮৩-তে ‘রাজকুমার’ নাটকে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি: নিমাই ঘোষ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৌলিকতা নাটকে ওই আত্মবীক্ষণেই। মনে আছে, আমার মরাঠি নাট্যকার বন্ধু, বাংলা চলচ্চিত্র ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের একান্ত অনুরাগী মহেশ এলকুঞ্চওয়ারের বড় সাধ ছিল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখা ‘আত্মকথা’ নাটকটি প্রযোজনা-অভিনয় করুন। নাগপুরে দু’জনের দেখা করিয়ে দিই আমি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আত্মকথা’ রূপান্তরণ ও অভিনয়ই কি ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’-এর সূত্রপাত? নাকি পুরোপুরি শরীরে মারণব্যাধির প্রকোপের আবিষ্কারের বজ্রপাতের অভিঘাতেই এক চূড়ান্ত দায়বোধে? নিজেকে মেলে ধরায় যে ভিতরের বাধা ও সেই বাঘার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ যে কোনও সৎ সমাজজনিত ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রায় অবধারিতই; তা সর্বদাই মুখোশধারী অভিনেতার ক্ষেত্রে আরওই প্রাণান্তক। মহেশের নাটকে আড়ালের ওই খেলা যেমন আছে, তেমনই ওই আড়াল ধ্বসে যাওয়ার সেই অমোঘ মুহূর্তও আছে, যা ডাক্তার শ্রীরাম লাগু ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে (মরাঠি ও বাংলা ভাষ্যে) দেখার সৌভাগ্য আমি আজীবন লালন করে যাব। ওই অভিনয়ের অভিজ্ঞতা (সৌমিত্রবাবুর নাটক লেখায় বার বারই ধরা পড়ে ওই গোপনতাবিদারী এক একটি আত্মোদ্ঘাটনের জ্যোতিষ্কোদ্ভাসের মুহূর্তের সন্ধান, যে মুহূর্তের নাটকীয়তাকে তিনি ধরে রাখেন একেবারেই অনাটকীয় চাপা গভীরতায়); আর বিলেতে রোগপরীক্ষার পর পরই দেখা একটি নাটকের চালটুকু (একই চরিত্রকে তিন ব্যক্তির স্বতন্ত্র অথচ আবার অভিন্ন আদলে উপস্থাপন করার নাট্যকৌশলমাত্র) মিলিয়ে যে একেবারেই মৌলিক ‘আত্মজীবনীমূলক’ নাটক তিনি রচনা করেন, তাতে শরীর–মনে লুক্কায়িত গোপন আততায়ীকে নাটকের শুরুতে এক বার অলক্ষেই প্রতিষ্ঠিত করে তাঁর ছুরিকাঘাতের ত্রাসকে তিনি এমন এক ভয়ঙ্কর রূপকে পরিণত করেন যে তা ইতিহাস, বিবেক, সত্যস্বীকার এমনকি নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার নাটকীয়তাকে চিহ্নিত করতে পারে, যা যে কোনও নাট্যকারের সিদ্ধির লক্ষণ, আবার অভিনেতারও আত্ম-অতিক্রমণেরও প্রমাণ।