প্রতীকী ছবি।
মুসলমান সমাজ ও জীবনের বৈষয়িক, আধ্যাত্মিক ও একই সঙ্গে প্রাত্যহিকের অনুপুঙ্খ সন্ধান এই উপন্যাস। দুই বাংলার কথা মাথায় রেখেই দাবি করা যায়, এমন উপন্যাস দুর্লভ। উপন্যাসের কেন্দ্রে দর্জি-ওস্তাগার অধ্যুষিত গ্রামীণ হাওড়ার মুসলিমপ্রধান সাদনাহাটি গ্রামের মসজিদটি। আছে শিক্ষিত, বিচক্ষণ, নির্ভীক তরুণী রিজিয়া; মসজিদের ইমাম তাহিরুল মাওলানা; স্বশিক্ষিত, যুক্তিবাদী, বুদ্ধিদীপ্ত, ধর্মনিষ্ঠ মারুফ; এবং ওই গ্রামেরই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উদার, শিক্ষিত, ধর্মে মতিহীন সুমন, মারুফের বাল্যবন্ধু। মূলত এঁদের ঘিরেই গল্প।
তালাশনামা
ইসমাইল দরবেশ
৫০০.০০
অভিযান পাবলিশার্স
কাহিনির পরতে পরতে লেখক সাদনাহাটির মুসলমানদের হজ, জাকাত, ইদ, কুরবানি, খতনা, বিয়ে, তালাক, গোসল, দাফন, শেরেক, পিরভক্তি ইত্যাদির অনুপুঙ্খ বয়ান উঠে এসেছে। ইসলাম ধর্ম আর মুসলমান সমাজকে জানার বড় সুযোগ করে দিয়েছেন লেখক। ওই গ্রামে পালাগান, যাত্রা, মর্শিয়া বা জারির মতো বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি চর্চা নেই, আছে ইসলামি জলসা, ওয়াজ ইত্যাদি। লেখকের মতে, এই রাজ্যে মুসলমান সমাজকে পিছন থেকে টেনে রেখেছে মানুষের ভ্রান্ত ধর্মবোধ— তার জন্য দায়ী আলেম-ওলামা’কৃত ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা। সাদনাহাটির সমাজেও শেষ কথাটা বলেন মৌলানা-মৌলবিরা। আজীবন কমিউনিস্ট হাসান আলির মৃত্যুর পরে তাঁর দাফন হয় না সাদনাহাটিতে। উপন্যাস শেষ হয় খানিকটা ইচ্ছেপূরণ দিয়ে— সমাজের অন্ধকার কাটাতে মারুফের উদ্যোগে মসজিদ ঘিরে দাতব্য চিকিৎসালয়, লাইব্রেরি, কম্পিউটার শিক্ষার উদ্যোগ শুরু হয়। গ্রামে দাঙ্গা রোধ করার জন্য বৃদ্ধ সাদেক আলির দুঃসাহসী চেষ্টা মনে থাকবে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর দক্ষ কথাকারের মুনশিয়ানা ইসমাইলের কলমে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলার মুসলমান সমাজ কি এতটাই ধর্মনির্ভর?
লুপ্ত জীবিকা, লুপ্ত কথা
কিন্নর রায়
২৭৫.০০
প্রতিক্ষ
বিশ্বায়নের বিস্তৃতি কত দূর, তা হয়তো খেয়াল করা হয় না, হয়তো বুঝেও ওঠা যায় না। টিভি, ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি পণ্য যে দিন শহর ছাড়িয়ে পল্লি-প্রান্তে প্রবেশাধিকার লাভ করেছে, সে দিন পল্লি-জগতেও নতুন রং লেগেছে। পল্লিজীবনের যা কিছু আদি-অকৃত্রিম-নিজস্ব, তা খোয়া গিয়েছে আধুনিকতার বিনিময়ে। ইতিহাসের গতি এমনই নির্মম-নির্মোহ, পিছন ফিরে তাকানোর সময় তার নেই। কিন্নর রায় এই অবলুপ্ত হতে চলা দুনিয়ার সংরক্ষণকারীর কাজ করেছেন। জীবনের ছোটখাটো উপকরণ, যাকে সে কালের ভাষায় বলা যায় ‘কিছুমিছু’, তা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখলেন। বইটির দুটো ভাগ। প্রথম অংশ জীবিকা বিষয়ক— তাতে পুকুর জলের ডুবুরি থেকে কম্পাউন্ডারবাবু, টোলের পণ্ডিত থেকে পাল্কির বেহারা, কে না এসেছে। দ্বিতীয় অংশ ‘লুপ্তকথা’ আর এক ঝাঁক মণিমাণিক্য— আমসত্ত্ব-বড়ি-কাসুন্দি থেকে কাগজ-কালি-কলম, ঘটক-ঘটকি থেকে চোদ্দো পিদিম-চোদ্দো শাক। লেখকের কলমে নস্ট্যালজিয়া ফুটে ওঠে— ‘কত কি দেখা না দেখা, কুয়োর গভীরতায় পড়ে যাওয়া ঘটি, কুয়ার ঘটি তোলা, আমি বহুরূপী, বুড়ির মাথার পা-আ-কা-চু-উ-ল, আলতা পরান নাপ তিনি’। এমন আটপৌরে গদ্যেই এক কালে প্রকাশিত হয়েছিল দু’টি ছোট গদ্যগ্রন্থ। সেগুলি ফের একত্রে প্রকাশিত হল।
প্রেসিডেন্সিতে পাঁচ দশক: ফিরে দেখা
অমলকুমার মুখোপাধ্যায়
৩০০.০০
মিত্র ও ঘোষ
নিজের কলেজের সঙ্গে অনেক ছাত্রেরই প্রাণের যোগ। কিন্তু ডিগ্রি পাওয়ার পরও কলেজের সঙ্গে আগের মতো জড়িয়ে থাকার সুযোগ হয় কতিপয় ভাগ্যবানের। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী অমলকুমার মুখোপাধ্যায় যেমন। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, বিভাগীয় প্রধান এবং অধ্যক্ষ হয়েছেন। অবসরের পরেও কলেজের ‘আইএএএস ট্রেনিং সেন্টার’-এর দায়িত্ব সামলেছেন। আলোচ্য বইটি প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র, শিক্ষক ও প্রশাসক রূপে অবস্থান কালে তিনি কী দেখেছেন ও জেনেছেন, সেই নিয়ে। কুড়িটি অধ্যায়ে ফিরে দেখা গিয়েছে প্রবাদপ্রতিম বহু শিক্ষককে। পরে দিকপাল হবেন, এমন কত জনের সঙ্গে সদ্য যৌবনে আলাপ হয়েছে। মূল্যবান কিছু তথ্যও মিলেছে। ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ছাত্রী-আবাস তৈরি, কলেজের ১৭৫তম বার্ষিকী পালন, স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা, অ্যাডমিশন টেস্টের ইতিবৃত্ত, রাজ্যের বামপন্থী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে জটিলতা ইত্যাদি। কিন্তু মনে হয়েছে, কিছু বিষয় লেখক ছুঁয়ে গেলেও খোলসা করতে চাননি। বইয়ে নকশাল রাজনীতির আঁচ মেলে। লেখক সুপারিন্টেন্ডেন্ট থাকাকালীন, ইডেন হিন্দু হস্টেলে যে ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার চলেছিল, সেই সম্পর্কে আরও জানা গেলে কৌতূহল মিটত। বইয়ে বহু গুণিজন প্রসঙ্গ রয়েছে, পরিশেষে তাঁদের পরিচয় একত্রিত করা থাকলে পাঠক উপকৃত হতেন।