প্রতীকী ছবি।
‘রেঙ্গুন’-এর সঙ্গে বাঙালির সংযোগ দীর্ঘ দিনের, সাহিত্য-স্মৃতিকথা-ইতিহাসে আজও তার ছাপ অমলিন। কিন্তু ইদানীং মায়ানমার তথা বর্মা যেন কিছুটা অপরিচয়ের আড়ালে চলে গিয়েছে। এই স্মৃতিচারণ সেই ফাঁক খানিক ভরাতে পারে। লেখক কর্মসূত্রে তৎকালীন রেঙ্গুনে ছিলেন ১৯৯৫-২০০৯, এই দীর্ঘ সময়ে তিনি মায়ানমারের নানা দর্শনীয় স্থান যেমন দেখেছেন, তেমনই ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছেন স্থানীয় মানুষদের সঙ্গেও। বইটি সত্যিই ‘ডায়রি’ধর্মী— নানা পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, অনুভুতিকে টুকরো টুকরো অধ্যায়ে ধরে রেখেছেন লেখক। কিছু অধ্যায় পর্যটনধর্মী— বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিতে নীরব স্মরণ থেকে গ্নাপোলিতে স্নরকেলিং এবং হারপুনে মাছ গাঁথতে দেখা— নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা, অ্যাডভেঞ্চারের কথা রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে পরিচিতদের স্মৃতিচারণ, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতীয়দের বর্মা ছেড়ে যাত্রা করার কঠিন দিনগুলির ইতিহাস। বর্মিদের সঙ্গে ভারতীয়দের সংঘাতপূর্ণ সম্পর্কের শিকড়সন্ধানও করেছেন লেখক, রোহিঙ্গা সঙ্কটকে দেখেছেন কাছ থেকে। রয়েছে নানা সত্যি গল্পের টুকরোও। যেমন, ১৯৯৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রাক্তন সেনাদের একটি দল মায়ানমার যায়। সেখানে মে মিয়ো শহরে প্রাতঃভ্রমণরত ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গলকে দেখামাত্র চিনতে পারেন ওই শহরবাসী এক বাঙালি ডাক্তার, যিনি ফৌজের চিকিৎসক ছিলেন। মাঝের পঞ্চাশ বছর কোনও বাধা হয়নি। এমন নানা দেখা, শোনা, বোঝা কথা নিয়ে তৈরি সুখপাঠ্য এই বইটি।
স্মরণীয় ব্যক্তিদের অন্তর্ধান নিয়ে সত্যান্বেষণের উদ্যোগ কম। সে চেষ্টাই এই বইটিতে। জিশু, চৈতন্যদেব এবং নেতাজি, তিন ‘ইতিহাসপুরুষ’ সম্পর্কে লেখকের মূল প্রতিপাদ্য: যে হেতু তাঁরা অশক্ত পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অত্যাচারের ভিতটাই উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন, সমাজের গতি বদলে দিয়েছিলেন, তাই অনভিপ্রেত রাজনীতির ষড়যন্ত্র লুকিয়ে তাঁদের অন্তর্ধানের পিছনে। জিশুর উদার প্রেম ও জনকল্যাণকারী ক্রিয়াকলাপ ত্রাস সৃষ্টি করেছিল জেরুসালেমের শাসকগোষ্ঠী ও পুরোহিতদের মধ্যে, নিয়মকানুন ও কুসংস্কারে যাঁরা আবদ্ধ রেখেছিলেন ইহুদি সমাজকে। “চৈতন্যদেব জিশুর প্রায় দেড় হাজার বছর পরের মানুষ।... তাঁর স্বপ্ন ছিল কৃষ্ণপ্রেমে মানুষকে আকর্ষণ করে দেশে এক জাতপাতহীন সাম্যময় সমাজের পত্তন যা বৈদিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও ইসলামি রাজতন্ত্র থেকে সমদূরত্ব রেখে চলবে।” সুভাষচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার ভারতের সমাজকে খণ্ডিত রাখতেই ধর্মের ব্যবধানকে সুকৌশলে বাঁচিয়ে রাখে। “সুভাষ বিভাজনের সেই প্রথা ভেঙে তাঁর তৈরি সেনাবাহিনী আজাদ হিন্দ ফৌজে রেখেছিলেন সব ধর্মের সৈন্য এবং সেনানীদের জন্য অবিভক্ত রান্নাঘর এবং সকলের জন্য একটি সম্বোধন ‘জয় হিন্দ’... প্রায় আশি বছর আগে ভারতের জনতাকে ধর্মের উপরে উঠে একত্র করার এই সংস্কারকে বৈপ্লবিক বললে কমই বলা হবে।” বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে লেখক পৌঁছতে চেয়েছেন এক কাম্য ও স্বচ্ছ বিতর্কের পটভূমিতে।
আমার রেঙ্গুন ডায়েরী
শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০০.০০
করুণা প্রকাশনী
রাশিয়া-সফরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “...মধ্য-এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষাবিস্তার করে চলেছে।” শুধু বিপ্লবভূমি রাশিয়া নয়, পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার যে সব দেশ দীর্ঘ দিন ধরে রুশ সভ্যতার ঐতিহ্যলগ্ন, তাদেরও শামিল করতে হবে কর্মোদ্যমে— এ ছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের গোড়ার রাজনীতি। রাজনীতিতে কথার পাহাড় জমে, তার বেশির ভাগই শেষাবধি জনতার কাছে প্রবঞ্চনাই ঠেকেছে, কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে সোভিয়েট কর্তৃপক্ষের ফাঁকি ছিল না। যতখানি যত্নে অনূদিত হতেন নিকোলাই গোগোল, ফিয়োদর দস্তয়ভস্কি বা মাক্সিম গোর্কি, ততখানিই আদরে পাঠকের দরবারে উঠে আসত সাদরিদ্দিন আইনি, পিরিমকুল কাদিরভ বা দেরেনিক দেমিরচান।
অন্তর্ধানের অন্তরালে: জিশু চৈতন্য সুভাষ
দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়
৪৫০.০০
লাস্ত্রাদা
গত শতকের বাঙালি পাঠক, বিশেষত তার শৈশব জানে, ‘চুক আর গেক’ যেমন তাদের নিজেদের, তেমনই প্রাণের কাছাকাছি ‘দাদুর দস্তানা’ বা ‘বাবর’। বরফে ঢাকা যে মায়াবী দেশের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁদের স্মৃতি, তার অবিচ্ছেদ্য অংশ আর্মেনিয়ার ‘চাগাই’, তুর্কমেনিয়ার ‘পুঁথি’-ও। বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা ইদানীং সোভিয়েট রাশিয়ার সেই সব বই পুরনো আকারে প্রকাশ করছে। সমর সেনরা অনুবাদে যে পাঠ-ঐতিহ্য গড়তে চেয়েছিলেন, আজ কিছু মানুষ তা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সেই শংসার্হ উদ্যোগেরই ফসল এ বই।