—প্রতীকী চিত্র।
সূর্য তখন প্রায় অস্তাচলে, মেঘের স্তর সোনার রঙে রঙিন। নেতারহাটের সানসেট পয়েন্টে পৌঁছনোর আগেই ময়ূর দেখে ফেলেছিলেন লেখিকা। যাওয়ার পথে রাস্তার দু’ধারে শাল-পিয়াল-ইউক্যালিপটাস গাছের সারি দেখতে দেখতে হঠাৎ খেয়াল করলেন, রঙিন পাখনা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা চার-পাঁচটি ময়ূর। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিলেন, সবাই নিশ্চুপ। এক সময় গ্রীবা উঁচু করে, লম্বা লেজ তুলে ময়ূরের দল রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। আর লেখিকার স্মৃতিতে তৎক্ষণাৎ ফিরে এল শান্তিনিকেতন— সেই গাছগাছালি পাখপাখালি, বালিকাবেলা বা বয়ঃসন্ধিতে ছুটির দিনে উত্তরায়ণে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে রাজহাঁস আর ময়ূর দেখতে পাওয়া।
এ এমন এক স্মৃতিকথন, সত্তর দশকের শেষার্ধে শুরু হয়ে বার বার ফেরে আগের দু’টি দশকেও, তৎকালীন বিহার ও বর্তমান ঝাড়খণ্ডের দেহাত থেকে শান্তিনিকেতনে; বরকাখানা স্টেশন, ভুরকুন্ডা কোলিয়ারি, জনজাতি জীবন থেকে রবীন্দ্রনাথের আশ্রম, শালবীথি, খোয়াই, কোপাইয়ে। স্মৃতির পর স্মৃতি, নিরন্তর চলাচলে সজীব এক জীবনের কথায় ভরে ওঠে এ আখ্যান, যেখানে নিহিত বঙ্গজ জীবনের বাইরেও প্রত্যন্ত ভারতের দৈনন্দিন, দারিদ্রের পাশাপাশি উন্নয়ন, পুরুষের সাফল্যের সঙ্গে নারীর অসহায় অন্তঃপুর। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের কয়েক দশকের আবছা ইতিহাস ঢুকে পড়ে এই স্মৃতির আখ্যানে। লেখিকার বড় মাসি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় শিখিয়েছিলেন, “কোনও ব্যাপারে মন খারাপ করবি না। সব কিছু থেকেই আনন্দটুকুই খুঁজে নিবি,” সেই নিরন্তর অনন্ত আনন্দযাত্রাই এই স্মৃতিগ্রন্থের মূল সুর।
লেখিকা গণেশ মূর্তি সংগ্রাহক, চল্লিশ বছরেরও বেশি গণেশ-চর্চা করছেন। তাতে ভালবাসা আছে, আছে পরিশ্রম, প্রচলিত কাহিনি ও বিশ্বাসকে যুক্তিবাদের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে সপ্রমাণ ইতিহাস সন্ধানের চেষ্টা। সাম্প্রতিক কালে বাংলার গণেশ-অর্চনার রূপটি বদলে গিয়েছে, হালখাতা ও দেবীপক্ষ ছাড়াও ভাদ্রে মহারাষ্ট্র অনুসরণে পাড়ায় পাড়ায় গণেশ পূজা গিয়েছে ছেয়ে। সময়ের পরিবর্তন ও বিবর্তনকে অক্ষ মেনে লেখিকা দৃষ্টি ঘুরিয়েছেন গণপতি সম্পর্কিত আরও বহুবিধ দিকে। পেশোয়া রাজত্বে অষ্টবিনায়কের প্রতিপত্তি, পল্লিবীথির গণশু দেবতার পাশাপাশি রয়েছে পুরাণে ছড়ানো গণপতির বিচিত্র উৎসকে এক সুরে বাঁধার প্রয়াস। ডান দিকে ঘোরানো শুঁড়ের সিদ্ধিবিনায়ক, এই দেবতার ইঁদুরের পিঠে চাপলেন কী ভাবে, দেবপূজার শুরুতে গজানন আবাহন আসলে কৃষিসভ্যতার উত্তরাধিকার কি না— জনপ্রিয় এই সব কৌতূহল নিরসনের পাশাপাশি রয়েছে অজানা ও বিতর্কিত গণেশ-প্রসঙ্গও। রয়েছে চৈনিক গুপ্ত সাধনায় গণেশ, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মিথস্ক্রিয়ায় গণেশের স্থান, গণেশের নারী সঙ্গ এবং নারী রূপে গণেশ বা গণেশানীর আলোচনা। আগ্রহী সমাজবিদ বা প্রত্নতত্ত্ব গবেষকের বইটি কাজে দেবে, শেষের গ্রন্থপঞ্জিটি আরও কাজের। তবে সুখপাঠে বিঘ্ন ঘটায় বিস্তর মুদ্রণপ্রমাদ।
চালতা গাছের পাতা যে হাতির দাঁত ঘষতে কাজে লাগে, ক’জন জানেন? বাবলা গাছের কাঁটা মাছ ধরার কাজে বা কাগজ আটকানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, সে কথাও শহুরে মানুষদের অধিকাংশেরই অজানা। এ সব তো তবু কম চেনা তথ্য। আমাদের চার পাশেই রয়েছে যে গাছগাছালি— প্রতি দিন যাওয়া-আসা, ঘরের জানলা বন্ধের সময় দেখতে পাই যাদের, সামান্য অসুবিধা হলেই যাদের ডালপালা মুড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে সমর্থন জানাই— তাদের ক’টির নামই বা আমরা জানি, জানার চেষ্টা করি? প্রকৃতিপ্রেমী লেখক সেই গাছদের নিয়েই লিখেছেন এই বই। বইয়ের নামটি সহজ-সরল, বিষয়বস্তুতেও অনাবশ্যক জটিলতা নেই কোনও। পরিচিত গাছগুলির বর্ণনা, সচরাচর কোথায় তাদের দেখতে পাওয়া যায়, কোন কাজেই বা লাগে এই গাছেরা— এমন সব প্রয়োজনীয় তথ্যে ভরা বইটি, বাড়তি পাওয়া সুন্দর নানা ছবি। ছোটদেরও ভাল লাগবে বইটি। আপাতদৃষ্টিতে একে সরল পাঠ্যবইয়ের বেশি কিছু মনে হয় না ঠিকই, কিন্তু যাঁরা গ্রীষ্মকাল না এলে আমগাছটিও চিনতে পারেন না, এ বই সেই ‘বড়’দের জন্যও কাজে দেবে খুব।