covid 19 india

Book review: সমাজের গায়ে অতিমারির ক্ষত

মোট ৩১টি প্রবন্ধে মহামারি ও অতিমারির উপদ্রব নিয়ে এ গ্রন্থের বিপুল আয়োজন।

Advertisement

অরবিন্দ সামন্ত

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২২ ০৫:৫৮
Share:

আমরা কোভিড-১৯ অতিমারির শিষ্ট প্রজা হিসেবে ত্রস্ত দিন কাটাচ্ছি। কোভিড অভিজাত এবং প্রান্তিক মানুষের সাংস্কৃতিক বোধ ও দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আসলে সমাজ সম্পর্কে আমাদের সাবেক ধারণাটাই পাল্টে গিয়েছে। এখন সামাজিক জীব হিসাবে মানুষই একমাত্র কুশীলব নয়— মাইক্রোব, ভাইরাস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ওষুধ, ইন্টারনেট, আইন, জলবায়ু এবং আরও অনেক কিছুই আমাদের সমাজ-ধারণার কাঠামোর অন্তর্গত। তাই রুগ্‌ণ সমাজের মতিগতি বুঝতে, মহামারি বা অতিমারির মারণ-তৎপরতার ঝোঁক ও ঝুঁকির একটা মানচিত্র তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। আলোচ্য গ্রন্থ দু’টি সেই সামাজিক কর্তব্যের অনিবার্যতাকেই অনুসরণ করেছে।

Advertisement

মধু সিংহ সম্পাদিত গ্রন্থটির তিনটি বিভাগ। শুরুর শিরোনাম ‘অতীতের মহামারি: বিশ্লেষণী পাঠমালা’। এর পর সিনেমা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মহামারির প্রসঙ্গ। সব শেষে কোভিড-বিষয়ক কয়েকটি প্রবন্ধ। মোট ৩১টি প্রবন্ধে মহামারি ও অতিমারির উপদ্রব নিয়ে এ গ্রন্থের বিপুল আয়োজন।

অতীত মহামারির পাঠ অংশে ঔপনিবেশিক ভারতে কলেরা আর ঔপনিবেশিক শরীর, এবং প্লেগ নিয়ে ডেভিড আর্নল্ড-এর বহুপঠিত দু’টি প্রবন্ধ ও ভেভিড হার্ডিম্যান-এর লেখা গত শতাব্দীর ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির কথা আছে। আছে গবেষকদের পরিচিত শীতলা ও বসন্তরোগ নিয়ে লেখা র‌্যালফ নিকোলাস-এর বিখ্যাত প্রবন্ধ। আর্নল্ড, নিকোলাস বা হার্ডিম্যান কলেরা, প্লেগ, বসন্তরোগের বীজাণুতত্ত্ব কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির ভয়াবহতা নির্ণয়েই আলোচনা শেষ করে দেননি। ব্যয়কুণ্ঠ সরকার, সরকারি আমলা, সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক, দেশীয় শিক্ষিত অভিজাত আর প্রান্তিক প্রজার আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে মহামারি কী ধরনের যোগসূত্র রচনা করেছিল তারই ডিসকোর্স রচনা করেছেন তাঁরা।

Advertisement

আউটব্রেকস: অ্যান ইন্ডিয়ান প্যানডেমিক রিডার

সম্পা: মধু সিংহ

১৪৯৫.০০

পেনক্র্যাফ্ট ইন্টারন্যাশনাল

হোমারের দি ইলিয়াড, বোক্কাচিয়োর ডেকামেরন বা স্টিফেন কিং-এর দ্য স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত বা আহমেদ আলির টোয়াইলাইট ইন দিল্লি ইত্যাদি সাহিত্যকর্মে মহামারি প্রসঙ্গের পরম্পরা মেনে গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে ফকিরমোহন সেনাপতি, সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা, রাজিন্দর সিংহ বেদি, ফণীশ্বরনাথ রেণু ও আরও অনেকের রচনার সাক্ষ্য থেকে মানুষের মহামারি নিবারণের প্রকৃতি ও ভয়াবহ লোকক্ষয়ে অসহায় মানুষের আকুতি চিত্রিত হয়েছে। ভারতীয় সিনেমার আখ্যানে মহামারির নিত্য আনাগোনা। এ বিষয়ে অমৃত গঙ্গর-এর আলোচনায় বিশেষত মরাঠি ও বাংলা চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ এসেছে। মধু সিংহ উত্তরপ্রদেশের এক গ্রামীণ নিরক্ষর মহিলার মৌখিক সাক্ষ্য থেকে লকডাউনে অসহায় মানুষের দুর্ভোগ বোঝার চেষ্টা করেছেন।

গ্রন্থের শেষ অংশে ভারতীয় জনজীবনে কোভিড কী ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অর্থ বয়ে এনেছে, তা বুঝতে চেয়েছেন অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেভিড আর্নল্ড, হরিষ নারায়ণদাস, প্রমোদকুমার নায়ার, রোহিণী মোকাশি-পুনেকর ও আরও অনেকে। অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন অনেক দিক থেকেই কোভিড-১৯ ইতিহাসে অদ্বিতীয়, তাই অ-তুলনীয়। কোভিডের ভূতকালের আচরণ থেকে ভবিষ্যতের কোনও ঐতিহাসিক নির্দেশ খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ডেভিড আর্নল্ড বলেছেন কোভিড দু’ধরনের ন্যারেটিভ সৃষ্টি করেছে। একটি আখ্যানে কোভিডকে অতীতের অতিমারির দৃশ্যপট ও ঘটনা-দুর্ঘটনার পুনর্নির্মাণ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অন্যটিতে এই ধরনের সাদৃশ্য-নির্দেশ যে ইতিহাসসম্মত নয়, তা বলা হয়েছে। এ গ্রন্থের অনেকগুলি প্রবন্ধই পত্রপত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত। কিন্তু গ্রন্থবদ্ধ হওয়ার সুবাদে সেগুলি সহজলভ্য হল। সম্পাদক সে সুযোগটি করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদার্হ।

ছ’টি অংশে বিভক্ত ও ৩৭টি প্রবন্ধ সম্বলিত যোগেশ জৈন ও সারা নাবিয়া সম্পাদিত গ্রন্থটি কোভিড-১৯’কে পর্যবেক্ষণ করেছে সামাজিক প্রান্তিকতার নানা নিশান ছুঁয়ে ছুঁয়ে। প্রথম অংশে প্রাক্‌-কোভিড ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবার রূপরেখা দিয়েছেন কে আর অ্যান্টনি। কিরণ কুম্ভর দক্ষিণ এশিয়ায় অতীত মহামারির আখ্যান রচনার ঐতিহাসিক সমীক্ষা করেছেন, পাশাপাশি কোভিড-১৯ আমাদের সামাজিক সম্পর্ক কী ভাবে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে তা আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় অংশে আলোচিত হয়েছে কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্য পরিষেবার সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্যুত্তর। কয়েকটি প্রবন্ধে মহামারির পরিচিত তত্ত্ব-বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে নানা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ভারতের প্রান্তিক মানুষের জীবনে কোভিডের বিড়ম্বনা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষত কে সুজাতা রাও কোভিড মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব পালন বিধি, লকডাউন, কোয়রান্টিন, কনটেনমেন্ট, টেস্টিঙের বৈধতা প্রতিষ্ঠায় সরকারের কাল্পনিক বিক্রম, সর্বোপরি সরকারি টিকা নীতির প্রায়োগিক গুরুত্ব আলোচনা করেছেন।

তৃতীয় অংশে কোভিড মোকাবিলায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সদর্থক ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। বিদ্যা কৃষ্ণন ও সারা নাবিয়া কোভিড মোকাবিলায় রাজনীতির কাছে বিজ্ঞানের পরাভব লক্ষ করেছেন। স্বাগতা যাদবর ভারতের প্রান্তিক মানুষের কাছে টিকা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায় ও সমতার নীতি কী ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে তা আলোচনা করেছেন। সুলক্ষণা নন্দী ও নীলাঞ্জনা দাস ছত্তীসগঢ়ের জনজাতি গোষ্ঠীর জীবনে কোভিড কোন বিপন্নতা ও দুঃখকষ্ট এনেছিল, সে বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণা করেছেন। চতুর্থ অংশে আছে কোভিড মোকাবিলায় নীতি প্রণয়ন ও আইনি সীমাবদ্ধতার কথা। তেলঙ্গানাকে সমীক্ষাক্ষেত্র ধরে আর শ্রীবৎসন, এ সুনীতা ও বসুধা নাগরাজ কোভিড-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য-রাজনীতি পর্যালোচনা করেছেন। জাহ্নবী সিন্ধু পরিযায়ী শ্রমিকদের অনন্যোপায় যন্ত্রণাময় পদযাত্রা ও সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলার বিধান নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৃন্দা ভান্ডারি ‘আরোগ্য সেতু’-কে মেনেছেন নাগরিক গোপনীয়তার উপর রাষ্ট্রের ডিজিটাল আক্রমণ হিসেবে। শ্বেতা দাস, সরোজিনী নাদিমপল্লি ও নীলাঞ্জনা দাস লিঙ্গ-নিরপেক্ষতা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কোভিডকে স্থাপন করেছেন।

কোভিড-১৯: আ ভিউ ফ্রম দ্য মার্জিনস

সম্পা: যোগেশ জৈন ও সারা নাবিয়া

২২৫০.০০

মনোহর পাবলিশার্স

পঞ্চম অংশে আলোচিত হয়েছে কোভিডের অর্থনৈতিক অভিঘাত। রীতিকা খেরা ও ঋষভ মলহোত্র শুনিয়েছেন অভাবী মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছতে সরকারি আলস্যের কথা। জঁ দ্রেজ ও আনমোল সোমাঞ্চি কোভিড সঙ্কট ও মানুষের খাদ্যের অধিকারের প্রশ্ন আলোচনা করেছেন।

বিষয়বৈচিত্র এ গ্রন্থের গৌরব। কিন্তু যখনই কোনও আলোচনা একটি অর্থপূর্ণ লক্ষ্য, একটি সার্বিক সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হয়েছে, তখনই প্রবন্ধের নটেগাছটি মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গবেষণা পরিপূর্ণ অবয়ব গঠনের আগেই যেন ভূমিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ গবেষণার ঝোঁক কোভিড মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বিধি সরকার কত দূর পালন করেছে তা খতিয়ে দেখায়। কিন্তু বিধি তো সমাজকে বহন করে মাত্র, অগ্রসর করে না।

সব শেষে আর একটি কথা। কোভিডের কাছে পরাজিতদের অধিকাংশই পরিবারের বয়স্ক মানুষ। নাতি-নাতনিদের গল্প-বলা ঠাকুরমা-ঠাকুরদা, দাদু-দিদা। এঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পারিবারিক আখ্যানের স্মৃতিবাহী পরম্পরাও যেন লুপ্ত হল। এ নিয়ে কোনও খেদ কোনও প্রবন্ধে নেই। বিপণনসর্বস্ব যুগে ওষুধ সংস্থাগুলি কোভিড-ক্লিষ্ট বিশ্বকে যে মুনাফা লাভের মৃগয়াক্ষেত্র বানিয়েছে, সে নিয়েও আলোচনা বাড়ন্ত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement