Book

আকবরকে ঘিরে নতুন সন্ধান

প্রথম পর্যায়টির সময়সীমা ১৫২৬ থেকে ১৫৬১ অবধি। পানিপথের দু’টি যুদ্ধ হয়েছিল এই সময়ে।

Advertisement

অভীক চন্দ

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২০ ০৬:১৯
Share:

আকবরনামা: ফতেহপুরে পুত্রের অভিবাদন গ্রহণ করছেন আকবর। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমনস

এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এমন সময়, যখন ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের বিকৃত প্রকল্পটি তার পূর্ণ অবয়বে প্রকাশিত। অাওরঙ্গজেবের (অথবা আলমগির) নামোল্লেখমাত্র এক শ্রেণির কট্টরপন্থী মানুষের এমনই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে যে আলোচনা বা বিতর্কের সেখানেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটছে। কয়েক মাস আগের খবর— ইতিহাসের পাতা থেকে টিপু সুলতানের নাম মুছে দেওয়া হবে। ফলে, স্বভাবতই মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি আকবরও জানা-অজানার আলো-আঁধারিতে ক্রমশ অস্পষ্ট এক অবয়বে পরিণত হচ্ছেন। সেই আকবর, যাঁর শাসনে স্বীকৃত হয়েছিল বহুত্ববাদ, যাঁর শাসনের ধ্রুবপদ বাঁধা ছিল এক বৃহত্তর নৈতিকতায়। এই প্রেক্ষাপটেই আকবর বাদশাকে নিয়ে বইটি রচনা করেছেন ইরা মুখোটি।

Advertisement

আকবর: দ্য গ্রেট মুঘল বইটি রচনার পিছনে উদ্দেশ্য ত্রিবিধ। এক, ভারতের ইতিহাস চর্চার তাত্ত্বিক পরিসরে আকবরকে তাঁর প্রাপ্য জায়গাটি করে দেওয়া; দুই, সেই বর্ণময় সময়ের একটা বিশ্বাসযোগ্য ছবি আঁকা, যার কেন্দ্রে ছিলেন আকবর; এবং তিন, আজকের সময়ের সঙ্গে আকবরের ঐতিহ্যের প্রত্যক্ষ সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠা করা। ইরা সেই কাজগুলি করতে চেয়েছেন এমন ভঙ্গিতে, যাতে তা পাঠকের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে, পাঠককে টেনে রাখে, আবার একই সঙ্গে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে থাকে একের পর এক তথ্য। অর্থাৎ, ইরা এক যুদ্ধে নেমেছেন। রণাঙ্গনে প্রবেশ করার প্রস্তুতি তাঁর যথেষ্ট, তা অনস্বীকার্য।

ইরা তাঁর আখ্যানের মালমশলা সংগ্রহ করেছেন নানা উৎস থেকে— ফারসি ভাষায় রচিত তৎকালীন ভাষ্য ও বইপত্রের অনুবাদ থেকে, আধুনিক সময়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে। তার মধ্যে যেমন হিস্টোরিয়োগ্রাফির গবেষণা আছে, মানবীবিদ্যার গবেষণাও আছে, জীবনী আছে, সামরিক ইতিহাস আছে, আবার আছে শিল্পের ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষণাও। এই সব থেকে তথ্য ছেঁকে নিয়ে ইরা তাঁর আখ্যানটি রচনা করেছেন। তাঁর কৃতিত্ব হল, সেই আখ্যানের বক্তব্যের সুর একান্তই তাঁর নিজস্ব। তাঁর রচনায় উঠে এসেছে আবুল ফতেহ জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবরের জীবন ও সময়ের ছ’টি কালানুক্রমিক পর্যায়।

Advertisement

আকবর: দ্য গ্রেট মুঘল
ইরা মুখোটি
৭৯৯.০০
আলেফ

প্রথম পর্যায়টির সময়সীমা ১৫২৬ থেকে ১৫৬১ অবধি। পানিপথের দু’টি যুদ্ধ হয়েছিল এই সময়ে। এই সময়েই উত্তর হিন্দুস্তানে শিকড় গাড়ছিল টিমুরিড সাম্রাজ্য, ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছিল গাঙ্গেয় উপত্যকায়। আবার এই সময়েই এই নতুন সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সঙ্কটও তৈরি হয়েছিল, শের শাহের নেতৃত্বাধীন আফগান বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন নির্বাসনে যেতে বাধ্য হওয়ার পর। দিল্লির তখ্‌ত পুনরুদ্ধার হল ১৫৫৬-তে, কিন্তু হুমায়ুন বেশি দিন বাঁচলেন না। আকবরের রাজত্বের প্রথম পর্বে স্থিতিশীলতা আনার দায়িত্ব পড়ল বৈরাম খাঁ-র ওপর। কিন্তু তাঁর নিয়মানুবর্তিতার নিগড়ে কিশোর বাদশাহের ক্রমেই শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল।

পরের অধ্যায়গুলিতে ইরা মুখোটির কলমে আকবরের ক্রমবিবর্তন হয়ে উঠেছে। কিশোর বাদশাহ থেকে যোদ্ধা ও সাম্রাজ্যজয়ী, কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত, শিল্পরসিক, সম্পূর্ণ নিরক্ষর হয়েও পাণ্ডিত্য অর্জন— একের পর এক ধাপ পেরিয়ে আকবর বোধি লাভ করলেন, নতুন ধর্মের প্রবর্তন করলেন, যা প্রচার করল সুলহ-ই-কুল— সর্বজনীন শান্তির কথা। লেখিকার কৃতিত্ব, আকবরের প্রশস্তি রচনার ফাঁদে পা দেননি। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে ব্যবহার করে তিনি আকবরের বহুমাত্রিক জীবনের আলো-অন্ধকারের সন্ধান করেছেন।

একটা উদাহরণ দিই। আফগানদের বিরুদ্ধে, গুজরাতের শাহের বিরুদ্ধে বা রাজপুতদের বিরুদ্ধে আকবরের অপ্রতিরোধ্য-প্রায় সামরিক দক্ষতার আখ্যানে পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলা যায়। ইরা মুখোটি কিন্তু আবুল ফজল বা নিজামুদ্দিন আহমেদের মতো আকবরের সমসাময়িক ভাষ্যকারদের নির্দ্বিধ প্রশস্তিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন; মেবাড়ী গ্রন্থ এবং পরবর্তী কালের জেমস টড-এর বয়ান ব্যবহার করে আকবর বনাম রাণা প্রতাপের তথাকথিত মহাসংগ্রামের এক বাস্তব, নিরপেক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন।

গোটা বই জুড়ে ইরা যে ভাবে বিভিন্ন পার্শ্বচরিত্রকে নিয়ে এসেছেন কাহিনির স্রোতে, সেটাও তারিফযোগ্য। কিছু ক্ষেত্রে সেই পার্শ্বচরিত্রগুলির আখ্যান কাহিনির মূল প্লটের থেকে বিচ্ছিন্ন, হয় সময়ের নিরিখে, নয় ভৌগোলিক দূরত্বের নিরিখে। কিছু ক্ষেত্রে আবার— যেমন বৈরাম খাঁর ক্ষেত্রেই— পার্শ্বচরিত্রের সঙ্গে কাহিনির নায়কের প্রত্যক্ষ সংঘাত হয়, এবং নাটকীয় ভাবে ঘটনার অভিমুখ পাল্টায়। প্রাসাদের অন্তঃপুরবাসিনী শক্তিশালী নারী চরিত্রের প্রতি লেখিকা কৌতূহলী। হামিদা বানু এবং গুলবদন বেগমের চরিত্র দু’টি যে ভাবে গড়ে উঠেছে তাঁর আখ্যানে, এবং আকবরের দৃষ্টিভঙ্গি ও শাসনের ওপর তাঁদের যে প্রভাবের কথা লেখায় এসেছে, তা উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ বর্ণনাকে লেখিকা ভেঙে নিয়েছেন ছোট ছোট ভাগে। এমন ভাবে, যাতে পাঠকের আগ্রহে ভাটা না পড়ে। তাঁর বয়ানে উঠে আসে তানসেন, বীরবল ও আবুল ফজলের মতো আকরের সভাসদ, পরামর্শদাতা, বন্ধুদের কথা।

কাহিনি যখন আকবরের জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রবেশ করে, তখন তাতে বাদশাহের ব্যক্তিগত বিচ্ছেদের ঘনঘটা— বীরবলের মৃত্যু, গুলবদন বেগমের মৃত্যু, যুবরাজ সেলিমের নির্দেশে আকবরের ঘনিষ্ঠতম সভাসদ আবুল ফজলের হত্যা। আকবরের জীবন-সায়াহ্নের আখ্যানে লগ্ন হয়ে থাকতেই পারত ভৈরবীর সুরের অন্তহীন বিষণ্ণতা, যদি না স্বয়ং লেখিকাই ভেঙে দিতেন সেই আবহ, যদি না তিনি জানাতেন যে ছকভাঙা ও নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করা বেপরোয়া যুবরাজ সেলিম, অর্থাৎ বাদশাহ জহাঙ্গির বহু ক্ষেত্রেই অবিকল বাপ-কা-বেটা। বইটি শেষ হয় সিকন্দরায় আকবরের সমাধির প্রসঙ্গে। বেশ কয়েক শতাব্দীর অবহেলা আর অযত্নে সেই সমাধি আজও দাঁড়িয়ে আছে এক অসমাপ্তি হয়ে, ঠিক আকবের সুলহ-ই-কুলের অপরিপূর্ণ স্বপ্নের মতোই, আমাদের আজকের প্রগতিশীল, আধুনিক প্রযুক্তির যুগ যে স্বপ্নকে এখনও পূর্ণ করতে পারেনি।

এই বই সম্বন্ধে যদি একটা আপত্তির কথা বলতে হয়, তবে বলব, আপত্তি রয়েছে বইয়ের শিরোনামে ‘দ্য ডেফিনিটিভ বায়োগ্রাফি’ কথাটায়। এই কথাটা কেন এল, তার একটা সূত্র পাওয়া যেতে পারে বইয়ের ব্লার্বে, যেখানে বলা হয়েছে, গত বেশ কয়েক দশকে আকবরকে নিয়ে কার্যত কোনও কাজই হয়নি। অনেক সমালোচকই দেখছি কথাটা সানন্দে মেনে নিয়েছেন। ঘটনা হল, ইরা মুখোটির বইটি প্রকাশিত হওয়ার কিছু দিন আগেই বাজারে এসেছে মণিমুগ্ধ শর্মার আল্লাহ হু আকবর। পার্বতী শর্মার লেখা আকবরের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের জীবনীও কিছু দিনের মধ্যেই প্রকাশিত হওয়ার কথা। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আন্দ্রে উইঙ্ক-এর আকবর। কিন্তু, আমার আপত্তির একটি বৃহত্তর কারণও আছে। কোনও বইকে ‘ডেফিনিটিভ’ বলে চিহ্নিত করে দেওয়ার অর্থ এটা বলে দেওয়া যে এই বইটিই এই বিষয়ে শেষ কথা। এই বইয়ের প্রতিপাদ্য বিষয়ে আর প্রশ্ন চলতে পারে না। কিন্তু, এই বইটির মূল সুর বাঁধা ভিন্ন তারে। সেই সুর নতুন করে খোঁজার, প্রশ্ন করার। এবং, এই গোত্রের কাজের ক্ষেত্রে এই সুরটির গুরুত্ব অপরিসীম।

ইরা বইটি এতই ভাল লিখেছেন যে তার শিরোনামে নিজের ঢাক পেটানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement