গান্ধিজির দৃষ্টিতে আধুনিকতা ও ক্ষমতাতন্ত্র
রাম বসু
১০০.০০, অন্যতর পাঠ ও চর্চা
ইউরোপের আলোকপর্ব বা তজ্জনিত আধুনিকতার যে-ভাবনা নিয়ে পাশ্চাত্যে এখন রীতিমতো বিতর্ক এবং প্রতিনিয়ত নানান প্রশ্ন, সেই ভাবনার দোহাই পেড়েই একদা গাঁধীজিকে আধুনিকতার পরিপন্থী আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে প্রচুর, এমনকী তাঁকে রক্ষণশীল হিসাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত আধুনিকতার দুই পৃষ্ঠপোষক নেহরু আর রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে। কবি রাম বসু (১৯২৫-২০০৭), কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে যাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল, মননে ছিল মার্ক্সবাদের চর্চা, আজীবন যিনি সার্বিক মানুষের সন্ধান করে গিয়েছেন তাঁর কাব্যে, এই বইটিতে তিনি গাঁধীজি সম্পর্কে নতুন ভাবনার খোঁজ করেছেন, আদৌ তিনি আধুনিকতার বিরোধী ছিলেন কিনা সে প্রশ্নেরই পুনর্বিচারে ব্রতী হয়েছেন। এ ভাবেই এগিয়েছে তাঁর এ-বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচনা। যেমন একটি অধ্যায়ের শেষে কবি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ‘‘পশ্চিমীরীতির বাইরে গিয়ে গান্ধিজি আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ দিতে চাইলেন ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তাঁর এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে বলা যায় ভারতীয় নৈতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ।’’ আর-একটি অধ্যায়ে লিখছেন, ‘‘মার্কসের মতো গান্ধীজি বলেন রাষ্ট্র হল পীড়নমূলক যন্ত্র, কোয়ার্সিভ মেশিন। কিন্তু গান্ধিজির নিজেরই সংশয়— মানুষচরিত্রের এতদূর পরিবর্তন কি সম্ভব? তাই রাষ্ট্র ও ক্ষমতা যদি একান্তই লোপ করা সম্ভব না হয় তবে তাকে যতদূর সম্ভব হ্রাস করা আমাদের কর্তব্য। স্বেচ্ছাকৃত সংগঠনই সর্বাধিক কাম্য। (দ্য মডার্ন রিভিয়্যু, ১৯৩৫) গান্ধিজি গুরুত্ব দিলেন রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর নয়, আত্মিক ক্ষমতার ওপর।’’ আসলে গাঁধীজি ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিমি আধুনিকতার অন্ধ অনুকরণ ভারতে কাম্য নয়, এদেশে আধুনিকতাকে নির্মাণ করতে হবে তার নিজস্ব ধাঁচে, আর সেই ধাঁচটিকে হতে হবে সর্বজনগ্রাহ্য। এই বিকল্প আধুনিকতার যে ভাবনা তার সংশ্লেষ ঘটাতে হবে এদেশের গোষ্ঠী, সমাজ, জনমানুষের সঙ্গে। ‘‘বিতর্কিত হলেও গান্ধি এখানেই অনন্য— লেখকের লেখনীতে এই বিষয়টি চমৎকারভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।’’ মনে হয়েছে শোভনলাল দত্তগুপ্তের, তিনি বইটির মুখবন্ধে আরও লিখেছেন, ‘‘গান্ধি(র)... বিকল্প চিন্তাভাবনা বর্তমান সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক, এই বিষয়গুলির গভীরে লেখক অনুসন্ধান করেছেন এবং সেটি তিনি করেছেন অত্যন্ত দক্ষভাবে...।’’