চেতাবনি: ১৯২৭-এ কুইনাইনের বিজ্ঞাপন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
ম্যালেরিয়াল সাবজেক্টস: এম্পায়ার, মেডিসিন অ্যান্ড ননহিউম্যানস ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, ১৮২০-১৯০৯
রোহন দেব রায়
৩০৫৩.০০
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস
ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও তার নিয়ন্ত্রণ সম্প্রতি ঐতিহাসিক গবেষণায় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। উনিশ ও বিশ শতকে ভারতে মহামারি হিসাবে যে সব সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, ম্যালেরিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে নানা চমকপ্রদ আলোচনা আজকাল ইতিহাসপ্রেমী মানুষের সঙ্গে সাধারণ পাঠক সমাজের কাছেও জরুরি হয়ে উঠতে পারে। রোহন দেব রায়-এর সুসংবদ্ধ গ্রন্থ এই ইতিহাস-ধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ম্যালেরিয়া ও তার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সীমাবদ্ধ আলোচনার পরিবর্তে তিনি কতকগুলো অনালোচিত দিকের উপর আলোকপাত করেছেন। অন্য কথায়, ম্যালেরিয়ার সঙ্গে যুক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আঙ্গিকে সিঙ্কোনা, কুইনাইন, মশা ও পরজীবী এই আলোচনায় বিশেষ স্থান পেয়েছে।
আলোচনার সময়কাল ১৮২০ থেকে ১৯০৯। ১৮২০ সালে প্যারিসে কুইনাইনের আবিষ্কার, এবং ১৯০৯-এ ব্রিটিশ ভারতে শিমলায় অনুষ্ঠিত ইম্পিরিয়াল ম্যালেরিয়া কনফারেন্সের সূচনা— এই দু’টি ঘটনাকে ম্যালেরিয়ার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছেন লেখক। অনেক রোগের অধরা কারণ হিসাবে চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া থেকে মশাবাহিত পরজীবীঘটিত একটি অসুস্থতা রূপে ম্যালেরিয়াকে আলোচ্য সময়কালে উপলব্ধি করা হল, এবং তার ফলে ম্যালেরিয়া সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার একত্রীকরণ সম্ভব হল।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসকেরা কী ভাবে ও কেন সিঙ্কোনা বাগিচায় উৎসাহিত হয়েছিলেন। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে সিঙ্কোনা ক্রমশ একটি মূল্যবান ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ হিসাবে পরিগণিত হল, এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান চর্চার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল। সিঙ্কোনা এবং কুইনাইন কেন ব্রিটিশ ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল? এর কি কোনও আর্থিক গুরুত্ব ছিল? এ সব প্রশ্নোত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে লেখক বলেছেন যে, শুধু সরকার নয়, ব্রিটিশ পুঁজিপতিরাও সিঙ্কোনা বাগিচায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং অর্থ বিনিয়োগ করেন। সেই সঙ্গে সিঙ্কোনা কী ভাবে দুই বা ততোধিক প্রতিদ্বন্দ্বী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তুলতে শুরু করে।
ম্যালেরিয়া কী ভাবে একটি রোগনির্ণয়-সংক্রান্ত মার্গে ঘনীভূত হল, তার বিশ্লেষণ আমরা পাই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। ঐতিহাসিক সুনির্দিষ্টতার মধ্য দিয়ে ম্যালেরিয়া দ্রুত জনমানসে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন পুস্তক ও পত্রিকায় এই রোগের স্বরূপ ও ভয়াবহতা বার বার কী ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, সে বিষয়ে লেখক আলোচনা করেছেন। একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে ম্যালেরিয়া চিকিৎসক, রসায়নবিদ, স্যানিটারি আধিকারিক এবং প্রশাসকদের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। তবে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়ার সংজ্ঞা নিরূপণের চিত্রটিও বদলে যায়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে দারিদ্র, খাদ্যাভাব, আবর্জনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অতিজনাকীর্ণতা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ম্যালেরিয়া রোগটিকে চিহ্নিত করা হয়। আবার, ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ম্যালেরিয়া ক্রান্তীয় অঞ্চল ও অত্যুষ্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি বলে ব্যাখ্যা করা হয়।
উনিশ শতকে ম্যালেরিয়ার কথা উঠলে ‘বর্ধমান জ্বর’ উঁকি মারতে শুরু করে। জ্বর কী ভাবে স্থাননামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি মহামারি রূপে বর্ধমান জেলায় আত্মপ্রকাশ করেছিল, রোহন সেই আলোচনা করেছেন তৃতীয় অধ্যায়ে। তবে, এর উপর পুরনো কথা পুনরুক্তির পরিবর্তে লেখক অনুসন্ধান করেছেন, কী ভাবে কতগুলো ভিন্ন অসুস্থতাকে এক সঙ্গে ম্যালেরিয়া নামক একটি একক মড়কের খাপে দীর্ঘ দিন পুরে রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি প্রতিবেদনে বর্ধমান জ্বরের যে পরিচিতি পাওয়া যায়, তা উল্লিখিত হয়েছে। সমসাময়িক বাংলা পত্রিকায় এই জ্বরের ভিন্নধর্মী চরিত্রায়ণ পরিলক্ষিত হয়, এবং কোনও কোনও রচনায় বিস্ময়কর ভাবে একে ‘সিঙ্কোনা ব্যাধি’ রূপে চিহ্নিত করা হয়। এই ধারণা প্রচলিত হয় যে, বাংলায় কুইনাইন চালু হওয়ার ফলেই এই মড়কের প্রাদুর্ভাব। বিভিন্ন প্রবন্ধ, গ্রন্থ ও প্রতিবেদনে বর্ণিত এই মহামারির কারণ উল্লেখের প্রসঙ্গে লেখক এ ধরনের মনোহারী তথ্যের উন্মোচন করেছেন। তাঁর মতে, ১৮৭০-এর দশকে ‘বর্ধমান জ্বর’ ছিল একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক ও প্রশাসনিক রূপরেখা। অধিকাংশ লিখিত বিবরণীতে একে ম্যালেরিয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রে বর্ধমান ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত স্থান হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায়ে আছে ব্রিটিশ ভারতে কুইনাইন প্রস্তুতের কাহিনি। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি সংস্থায় সুলভ ও খাঁটি কুইনাইন তৈরির প্রচেষ্টা সংক্রান্ত আলোচনার আঙ্গিকে কতকগুলো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, এবং কুইনাইনের বিশুদ্ধতা নিরূপণ বিতর্কের আলোকে সেগুলি পর্যালোচিত হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে, বিশেষত মংপুতে প্রস্তুত কুইনাইনের বিশুদ্ধতা বিচারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকটি ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়। লন্ডনের ‘মেসার্স হাওয়ার্ড অ্যান্ড সন্স’ নামে বিখ্যাত ঔষধ বিক্রেতা এ প্রসঙ্গে জানায় যে, মংপুতে উৎপাদিত সিঙ্কোনা ছালের গুণগত মান ছিল দুর্বল এবং অবিক্রয়যোগ্য। এই ভাবে বেসরকারি উদ্যোগে উৎপাদিত কুইনাইনের সঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুত কুইনাইনের তুলনা করা হত। বস্তুত, তুলনার একটা মাপকাঠি রূপে কুইনাইন প্রায়শই প্রতীয়মান হত। এই প্রসঙ্গে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, কী ভাবে মংপুতে সুলভ ও বিশুদ্ধ কুইনাইন প্রস্তুত করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছিল।
উনিশ শতকের শেষ দিকে কয়েকটি বিদেশি কুইনাইন প্রস্তুতকারক ভারতে কুইনাইনের বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ওলন্দাজ-শাসিত জাভা থেকেও কিছু সংস্থা এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ক্রমে তারা অভিযোগ করে যে, ভারতে সরকারি উদ্যোগে প্রস্তুত কুইনাইনের মূল্য বাজারদরের চেয়ে বেশি। মংপুর সরকারি সংস্থা এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করে; প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। মংপুর কুইনাইন উন্নতমানের এবং নিরাপদ— এই নিশ্চয়তা প্রদানে সরকার সচেষ্ট হয়। এই সমস্ত বিষয়গুলি যে কত জরুরি উপনিবেশের ইতিহাসে, তা বোঝা যায় বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে।
লেখকের মতে, অ-মানব বিষয়গুলো— যেমন মশা, ম্যালেরিয়া, কুইনাইন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দারিদ্র ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য— পারস্পরিক প্রভাব বিস্তার করে, এবং তারা একে অপরের উপযোগী ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তিনি দেখান, কী ভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ভারতে বাধ্যতামূলক কুইনাইন গ্রহণ বলবৎ করার মাধ্যমে তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদর্শন করে। বিদ্যালয়, সামরিক শিবির ও সংশোধনাগারে তা কার্যকর করা হয়।
তবে বইটির কিছু সীমাবদ্ধতাও চোখে পড়ে। যেমন, সরকারি উদ্যোগে কুইনাইন প্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও বাংলায় এর জোগান কেন অপর্যাপ্ত ছিল, তার উত্তর জানা গেল না। অন্যতম শৃঙ্খলাপরায়ণ জাতি হিসাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজ শাসকেরা ভারতে ভেজাল কুইনাইনের রমরমা বন্ধ করতে পারেনি কেন, তারও বিশ্লেষণ নেই। বর্ধমান জ্বরের বিস্তারিত বিবরণ সত্ত্বেও এটি ম্যালরিয়া জ্বর না কি কালাজ্বর, সে বিতর্কের মধ্যে লেখক প্রবেশ করেননি। তবু এই বইয়ের তাৎপর্য অপরিমেয়। ম্যালেরিয়ার ইতিহাসে মানবইতিহাসের বাইরেও কিছু বিষয় আছে, যা এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। যুক্তিবাদী, নৈর্ব্যক্তিক ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত এই গ্রন্থ ম্যালেরিয়ার ইতিহাস-দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে। ঔপনিবেশিক সমাজের ইতিহাসকে একটি কম-চর্চিত দিকে আলো ফেলেছে।