দুর্বার: নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধেও ট্যাঙ্ক নামিয়েছিল চিন। তিয়েনআনমেন স্কোয়্যার, ৫ জুন, ১৯৮৯।
দ্য লং গেম: চায়নাজ় গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি টু ডিসপ্লেস আমেরিকান অর্ডার
রাশ দোশি
২৭.৯৫ (ব্রিটিশ পাউন্ড)
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
চিন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই মুশকিল। অনেক ভেবেচিন্তে হয়তো সিদ্ধান্ত নিলেন যে চিনারা খুব কর্মঠ— তখনই জানতে পারবেন যে, চিন দেশে ভাতঘুম দেওয়াটা প্রায় বাধ্যতামূলক। এই রকম পরস্পরবিরোধী উদাহরণ অজস্র, চিনকে বোঝা অতএব কঠিন। তবে যদি হাতে আসে এই বই, তবে বুঝবেন যে আপনি একা নন, আমেরিকাও দীর্ঘ সময় চিনের পরিবর্তন আঁচ করতে পারেনি। লেখক ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাশ দোশি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চিন-বিষয়ক বিভাগের অধিকর্তা, তাঁর অন্যতম মুখ্য চিন উপদেষ্টা। দি ইকনমিস্ট পত্রিকার ভাষায়: ‘হিজ় ভিউজ় ক্যারি ওয়েট’— চিন নিয়ে দোশির কথার ওজন আছে। সরকারে থেকে এই ধরনের বই আগে কেউ লিখেছেন কি না, বলা শক্ত। দোশি যা বলেছেন, এক লাইনে তার অর্থ: শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। দোশি লিখছেন, চিন ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে নিয়মিত— কখনও কৃত্রিম মেধা, কখনও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে অনায়াস বিচরণের মাধ্যমে’। অন্য দিকে, এক গণতন্ত্র বিশ্লেষককে উদ্ধৃত করে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা স্বদেশ সম্পর্কে লিখছেন: “একটি শিল্পহীন, ইংরেজি-বলা ল্যাটিন আমেরিকার প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই দেশের দক্ষতা… জমি-গাড়ি কেনাবেচা এবং সম্ভবত বিশ্বময় কর ফাঁকি দেওয়ায়।” শেষের সে দিন, অতএব, সুবিধার নয়।
চিনে পরিবর্তনের গল্প বুঝতে আমেরিকার সময় লাগার একটা কারণ হল গণতন্ত্র। আমেরিকা গণতান্ত্রিক দেশ বলেই গবেষকদের চিনের সব কিছু নিয়েই নানা মত রয়েছে। দোশি যে গণতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন তা নয়, বরং বলছেন, এই ব্যবস্থায় চিনের মোকাবিলা করা সম্ভব। তবে নানা মতকে এক জায়গায় নিয়ে আসার ক্ষমতা চিনকে যে শক্তিশালী করেছে, তা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে আশির দশকে পার্টি ও বিভিন্ন দলীয় কমিশনের মাথায় থাকা দেং শিয়াওপিং-কে উদ্ধৃত করে দোশি লিখছেন, “দেং বলেছিলেন, লেনিনবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধে হল, এক বার সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্তকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা।” আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সমর-দার্শনিক সান জু-র ‘যুদ্ধে দ্রুত জয়ই কাম্য’ তত্ত্ব বার বার প্রভাবিত করেছে ২,৫০০ বছর পরের কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে।
চিনকে বুঝতে না পারার আরও কারণ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে দোশি আবারও উদ্ধৃত করছেন দেং-কে। দেং-এর তত্ত্ব ‘তাও গুয়াং ইয়াং হুই’, অর্থাৎ ‘সময় না আসা পর্যন্ত নিজেকে আড়ালে রেখে অপেক্ষা করো’, তা চিনকে বোঝার জন্য জরুরি। কিন্তু অপেক্ষাটা কত দিনের? দোশি বলছেন, বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমেরিকা থেকে তাইল্যান্ড, সবাই যুদ্ধবিমান বহনকারী জাহাজ জলে ভাসিয়েছিল। চিন ভাসাল ২০১৭ সালে, বিমান বহনকারী জাহাজ আবিষ্কারের ১০০ বছর পরে। “চিনের আর্থিক সঙ্গতি ও সাংগঠনিক শক্তি ছিল। কিন্তু কোন বিষয় গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে চিনের চিন্তা আলাদা”, লিখছেন দোশি।
এই চিন্তাভাবনা বুঝতে অসুবিধা হয়েছে পশ্চিমের, মত প্রবীণ কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারের। “আমরা বিশেষজ্ঞদের দেশ। সমস্যাকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামরিক সমস্যা বলে আলাদা আলাদা করে ভাবতে অভ্যস্ত। সব সমস্যা মিলিয়ে দেখতে অভ্যস্ত নই।” (১৯৫৮) এই উদ্ধৃতি বইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানেই চিনের বিশেষত্ব— সব কিছুর সঙ্গে সব কিছুর সম্পর্ক আলাদা ভাবে না দেখে জুড়ে দেখার প্রবণতা। দ্য লং গেম-এর অন্যতম প্রধান বিষয় এটাই; যাকে দোশি বলছেন সার্বিক রণকৌশল— ‘গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’। সব কিছুকে মিলিয়ে গোটা ছবিটা বোঝার ক্ষমতা।
চিন পাল্টাতে শুরু করে ১৯৮৯ থেকে, তিনটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে। দোশির ভাষায় ‘ট্রাইফেক্টা’। অভিধানে এর অর্থ, দৌড় প্রতিযোগিতায় পর পর তিনটি ইভেন্টে জয়। চিনের ‘ট্রাইফেক্টা’ শুরু হয় তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে ছাত্রদের উপর গুলিচালনা (১৯৮৯), সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন (১৯৯১) এবং উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার জয়ের (১৯৯১) মধ্যে দিয়ে। ‘ট্রাইফেক্টা’র মাধ্যমে চিন চেনে তার ভবিষ্যতের প্রতিদ্বন্দ্বীকে, বোঝে যে সোভিয়েট আর তার প্রধান শত্রু নয়, সুদৃঢ় করতে শুরু করে ভবিষ্যতের ‘গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’। কী ভাবে করে, তার ব্যাখ্যা রয়েছে বইয়ে। সময়ের নিরিখে এই ‘গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’র তৃতীয় ও বর্তমান পর্যায়ের সূচনা ২০১৬ সালে; জগৎসভায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শ্রেষ্ঠ আসন’ লাভ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে। দোশি লিখছেন, চিনের কাছে ঘটনা দু’টি ‘শকিং’। অর্থাৎ, স্নায়বিক বিক্ষোভ। “পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী গণতন্ত্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বিদায় নিচ্ছে, যে পরিমণ্ডল তারাই গড়ে তুলেছে। চিন বিষয়টিকে ‘ঐতিহাসিক সুযোগের মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করে এশিয়া-সহ গোটা বিশ্ব-ব্যবস্থার উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।” দেং-এর ‘অপেক্ষা করা’র নীতি শি চিনফিং পাল্টে ফেললেন। পাঁচ বছর পরে, ২০২১-এর জানুয়ারিতে তিনি বললেন, “চোখে পড়েনি এমন অনেক পরিবর্তন গত এক শতকে বিশ্বে ঘটেছে। তবে এই (পরিবর্তনের) সময় ও গতি আমাদের পক্ষে।”
এই মন্তব্যের সাত মাস পরে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করল আমেরিকা। ভূ-রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা একমত, এই সিদ্ধান্ত বিপদে ফেলবে আমেরিকাকে। অগস্ট মাসে একটি প্রবন্ধে ৯৮ বছর বয়সি কিসিঞ্জার বলছেন, সেনা প্রত্যাহারের ‘তাড়াহুড়ো আমেরিকার বন্ধুদের অসন্তুষ্ট করবে, শত্রুদের করবে উৎসাহিত আর পর্যবেক্ষকদের বিভ্রান্ত।’ অর্থাৎ, এই প্রত্যাহার-পরবর্তী বিশ্বে কূট-রাজনীতি পাল্টে যাবে। এটা বুঝেই হয়তো জুলাইয়ের শেষে এ বই বার করে প্রায় একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দোশি। আর তা করেছেন লাসলো লাদানি নামে এক হাঙ্গেরীয়-জেসুইট পাদরির কায়দায়। লাদানি ১৯৪৯-এ বিপ্লবের পরে চিন থেকে বিতাড়িত হয়ে হংকং-এ গবেষণা শুরু করেন। এর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে কমিউনিস্ট পার্টির কাগজপত্রের উপরে ভিত্তি করে ধারাবাহিক ভাবে ইংরেজিতে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন: চায়না নিউজ় অ্যানালিসিস। পৃষ্ঠা আষ্টেকের পুস্তিকার ১২০০-রও বেশি সংখ্যা কমিউনিস্ট পার্টিকে বুঝতে আমেরিকার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। এক গবেষককে উদ্ধৃত করে দোশি লিখছেন, ‘বিভিন্ন প্রতীক-নির্দেশিত ভাষা, ধাঁধা, গোপন সঙ্কেত, সাঙ্কেতিক ইঙ্গিত, তীর্যক ভাষ্য ও বিভিন্ন
ভ্রান্ত তথ্যের’ যে বিশ্লেষণ ফাদার লাদানি করেছিলেন, তা না থাকলে চিনের রাজনীতি বুঝতে আরও অসুবিধে হত।
চিনকে বুঝতে প্রভূত পরিশ্রম করেছেন রাশ। তা করতে রাজপরিবার, নেতা থেকে সমর বিশারদের দর্শনের কথা বলেছেন, গল্পের মতো করেই। যে কারণে তথ্যসমৃদ্ধ বইটি পড়তে পড়তে যেন ঘুম আসে না। তবে, চিনের দর্শনকে বুঝতে ও বোঝাতে কয়েকটি বিষয় তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন। যেমন, দেং-এর ‘তোমার সময় আসবে’ বাক্যাংশটি। তা কখনওসখনও পাঠককে ক্লান্ত করবে। কিন্তু এ-ও ঠিক যে, স্থান-কাল পরিবর্তনে চিনা শব্দের অর্থ পাল্টে যায়। একই বাক্যের উপর্যুপরি ব্যাখ্যার জন্যে দোশিকে তাই দোষ দেওয়া চলে না।