অতীত: প্রণব মুখোপাধ্যায়, মনমোহন সিংহ ও সনিয়া গাঁধী। মে, ২০১২। নয়া দিল্লি।
পলিসিমেকার্স জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি
কৌশিক বসু
৬৯৯.০০
সাইমন অ্যান্ড শুস্টার
ভাবছি, এর মধ্যে এক দিন পরীক্ষা করে দেখব, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনও একটা নেতিবাচক মন্তব্য করে শেয়ার মার্কেটে ধস নামাতে পারি কি না। অবশ্য, তার পরেই একটা ইতিবাচক কথা বলে বাজারকে ফের ঠিক জায়গায় ফিরিয়েও দিতে হবে।”— ২০১০ সালের ১০ মার্চ ডায়েরিতে কথাগুলো লিখেছিলেন কৌশিক বসু। লেখককে যাঁরা চেনেন, অথবা না চিনেই যাঁরা এই বইটি পড়ে ফেলেছেন বা পড়বেন, তেমন পাঠকমাত্রেই জানবেন যে, অহঙ্কার বা নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অত্যুচ্চ ধারণার মতো চারিত্রিক গোলমালের ছিটেফোঁটাও তাঁর মধ্যে নেই। যা পূর্ণমাত্রায় আছে, তা হল হাসার ক্ষমতা। চার পাশের ক্ষমতাবান লোকেদের নিয়ে, নিজেকে নিয়েও হাসার ক্ষমতা। দিল্লি এবং ওয়াশিংটন ডিসি-তে অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে কাটানো ছ’বছর ধরে তিনি যে ডায়েরি লিখেছিলেন, তার পাতায় পাতায় এমন হাসির ছটা। কোথাও মুচকি হাসি, কোথাও একেবারে অট্টহাস্য। যে উদ্ধৃতিটা দিয়ে এই লেখা শুরু করলাম, সেটাও এমন হাসিরই উদাহরণ। ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে মাত্র কয়েক মাস কেটেছে তখন। প্রায়শই দেখেন, তাঁর কোনও একটা অকিঞ্চিৎকর মন্তব্যকে ধরেই শেয়ার বাজারের সূচক চড়েছে বেশ কয়েক ধাপ— খবরের কাগজের পাতায় লেখা হয়েছে সে কথা। তার পরিপ্রেক্ষিতেই নিজেকে নিয়ে একটু হেসে নিয়েছিলেন সে দিন। আবার, এক পুরনো বন্ধুর অনুরোধে অসমে এক রাজ্যস্তরের কুইজ় প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসাবে গিয়ে দেখেছিলেন, ‘এই বইটি কার লেখা’, এমন দু’টি প্রশ্নের উত্তর হল ‘কৌশিক বসু’। তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, “নিজেকে ভারী গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। তার পর যখন দেখলাম যে, এক জন প্রতিযোগীও সেই দুটো প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারল না, অমনি পা ফের মাটিতে নেমে এল!”
তখন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। কোনও এক আর্থিক নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। দিনের শেষে কৌশিক বসু তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, “আমি বিশ্বাস করি, এই কথাটা গোটা দুনিয়ায় অজস্র মানুষের বিপুল ক্ষতি করেছে। উল্টো কথাটাই সত্যি— আসলে, আমাদের প্রত্যেকের এটা বোঝা দরকার যে, জীবনে এমন বহু পরিকল্পনা আছে, যার ক্ষেত্রে যতই ইচ্ছা থাক, সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের কিছুমাত্র উপায় নেই।” হাসির ছলে গভীর কথা, না কি গভীর কথার ভাঁজে মুচকি হাসি, ভাবতে ভাবতেই পাতা উল্টে যাবেন পাঠক।
তাঁর এই ডায়েরির দুটো ভাগ— প্রথমাংশ ২০০৯ থেকে ২০১২ অবধি দিল্লির, দ্বিতীয়াংশ ২০১২ থেকে ২০১৬ ওয়াশিংটন ডিসি-র। ভারতীয়দের কাছে দিল্লির অংশটাই বেশি চিত্তাকর্ষক লাগবে, কারণ চরিত্রগুলো তাঁদের চেনা। অবশ্য, কোনও রাজনৈতিক কেচ্ছা, এমনকি দুর্নীতির ফার্স্ট হ্যান্ড নিদর্শন খুঁজলেও হতাশ হতে হবে। কৌশিক জানিয়েছেন, তাঁর জার্নালে দুর্নীতির উদাহরণ নেই, তার কারণ এই নয় যে তিনি যখন দিল্লিতে ছিলেন, তখন দুর্নীতি ছিল না— কারণ সম্ভবত এটা যে, তাঁর মতো এক জন ‘বাইরের লোক’-এর সামনে কেউ দু’নম্বরি লেনদেন করতেন না। অর্থব্যবস্থা পরিচালনা সম্বন্ধে তাত্ত্বিক আলোচনাও এতে নেই। যেটা আছে, ইংরেজিতে তাকে বলে ইর্রেভারেন্স— কোনও কিছুকেই তোয়াক্কা না করার, কিছুতেই অভিভূত হয়ে না পড়ার চলন। আর্থিক নীতি সংক্রান্ত এক দীর্ঘ বৈঠকের পর তিনি লিখেছেন, “অর্থনৈতিক নীতি হামেশাই এমন খারাপ ভাবে তৈরি হয় কেন, সে বিষয়ে এখন আমি নিশ্চিত— সব রাজনীতিকের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করে সেই নীতি প্রণয়ন হয় বলে। যে ভাবে অর্থনৈতিক নীতি তৈরি হয়, একটা বিমান যদি সে ভাবে তৈরি হত, তা হলে সেটা সম্ভবত কখনও উড়তে পারত না।” এক দিন লিখেছেন, তিনি আগে মাঝেমাঝেই এটা ভেবে অবাক হতেন যে, রাজনীতিকরা কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে কত সহজে কথা বলতে পারেন। দিল্লিতে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে তিনি টের পেলেন, যে কথা বলছি, তার কিছু অর্থও থাকতে হবে, এমন খুচরো কিছু নীতিকে বর্জন করতে পারলেই নির্দ্বিধায় যে কোনও বিষয়ে কথা বলা যায়। একই সঙ্গে জানিয়েছেন যে, তিনি নিজেও দ্রুত রপ্ত করে ফেলেছেন এই গুণটি। আমলাতন্ত্র বিষয়ে একটি গল্প: তিনি ২০১০ সালের মিড ইয়ার রিভিউ অব ইন্ডিয়ান ইকনমি তৈরি করে জমা দেওয়ার পর এক উচ্চপদস্থ আমলা আপত্তি জানিয়েছিলেন, এই রিপোর্টে প্রথা ভাঙা হয়েছে— প্রতি বছর রিপোর্টে তিনটি অধ্যায় থাকে, এ বছর চারটি অধ্যায় রয়েছে কেন? ২০১১ সালের হোলির দিন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন মাত্র একটা অনুচ্ছেদ— “সবাই যদি শুধু অর্থপূর্ণ কথা বলত, তা হলে এই পৃথিবীতে অনেক কম শব্দ হত।”
বাজেট পেশ করার আগে অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সে বিষয়ে আলোচনা করবেন, এমন একটা রীতি আছে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের কাছে গিয়েছিলেন কৌশিকও। “তিনি অত্যন্ত ভদ্র, অভিজাত, এবং খুব মিষ্টি এক জন মানুষ। তাঁকে দেখে আমার মেজোপিসির কথা মনে পড়ে গেল। প্রণববাবু বাজেটের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করলেন। অর্থনীতি বিষয়ে মেজোপিসির যতখানি আগ্রহ থাকার কথা, রাষ্ট্রপতিও ততখানি আগ্রহ নিয়েই শুনছিলেন। অবশ্য, শ্রোতার আদৌ আগ্রহ আছে কি না, প্রণববাবুর তাতে কিছু যায়-আসে বলে মনে হল না। তিনি বুঝিয়েই চললেন।”
অবশ্য, শুধু রসিকতা নয়, কিছু মানুষের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাও খুব স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে কৌশিকের জার্নালের পাতায়। তাঁর শিক্ষক ও আজীবনের বন্ধু অমর্ত্য সেন, এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা সুবিদিত। এই জার্নাল হদিস দিচ্ছে সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধারও। এবং, অবশ্যই প্রণব মুখোপাধ্যায়। বিশ্বভারতীর উপাচার্য পদে প্রার্থী নিয়োগের সার্চ কমিটিতে ছিলেন কৌশিক। এক দিন প্রণববাবু তাঁর কাছে এক জন প্রার্থী বিষয়ে বেশ গুণগান করলেন— বুঝতে অসুবিধা হল না যে, অর্থমন্ত্রী সেই প্রার্থীর হয়ে সুপারিশ করছেন। দিনকয়েক ভাবনার পর কৌশিক তাঁকে জানালেন, সেই প্রার্থীকে তিনি যোগ্যতম বলে মনে করেন না। প্রণববাবু দ্বিতীয় বার সেই প্রার্থীর হয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেননি। রাজনীতিকদের মধ্যে এই গুণটি বিরল, মনে করিয়ে দিয়েছেন কৌশিক।
ব্যক্তি কৌশিক বসু কেমন, তার একটা ছবি ফুটে ওঠে এই বইয়ে। ভারত সম্বন্ধে তাঁর গর্ব কোথায়, আবার একই সঙ্গে কেন তিনি প্যাট্রিয়টিজ়মকে খুব মহৎ গুণ বলে মনে করেন না, দুইয়েরই হদিস পাবেন পাঠক। রবীন্দ্রনাথ ও নেহরু কী ভাবে তাঁর চিন্তায় প্রভাব ফেলেন, সেই সন্ধানও পাওয়া যাবে। এবং খোঁজ পাওয়া যাবে তাঁর সাহসেরও। তাঁর ডায়েরি যখন বই হিসাবে প্রকাশিত হল, তখন দেশে নরেন্দ্র মোদীর ত্রাসের রাজত্ব। তবুও তিনি ডায়েরির পাতা থেকে এই লাইনগুলো কেটে দেননি— “আমি বিশ্বাস করি, ২০০২ সালে গুজরাতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে হত্যাকাণ্ড ও হিংস্রতা সংঘটিত হয়েছিল, সব মানুষেরই তার নিন্দা করা উচিত, তা তিনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, অজ্ঞেয়বাদী বা নাস্তিক, যা-ই হোন না কেন।”