দিশারি: গিরিশচন্দ্র সেন, হাছন রাজা ও কাজী নজরুল ইসলাম (বাঁ দিক থেকে ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
বাঙালি হিন্দুর রসুলচর্চা, বাঙালি
মুসলমানের কালীচর্চা
কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত
২৭৫.০০, ২২৫.০০
প্রতিক্ষণ
যখন লেখক বলেন যে, আজ রাষ্ট্রের তৈরি গোষ্ঠী-অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধাচরণ তাঁর বাঙালি হিন্দুর রসুলচর্চা বইটি, তাঁর আদর্শটি বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। বিশেষত সঙ্গে যখন আসে বাঙালি মুসলমানের কালীচর্চা বইটিও, আর কৃষ্ণপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটি মনে করিয়ে দেন: ইউরোপ যেমন সত্যসাধনা জ্ঞানের ব্যাপ্তির মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁছেছে, হিন্দুকে মুসলমানকে তেমনই গণ্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে। লেখক সেই যাত্রা খুঁজেছেন হিন্দুদের লেখা হজরত মহম্মদের জীবনীতে, আর বাঙালি মুসলমানের কালীস্তোত্র ও গানে।
মহম্মদের জীবনী বাংলায় লেখা শুরু হয়েছে উনিশ শতকের শুরুতেই, শ্রীরামপুরে মিশনারি প্রচারকদের হাতে। সেখানে ইসলামকে আপ্রাণ নস্যাৎ করা হত, মহম্মদের জীবনীগুলি ছিল কুৎসাময়। ফলে যখন বাঙালি মুসলমান রসুলের জীবনী লিখবেন, সেখানে খ্রিস্টান পাদরিদের মহড়া নিতেই হবে, একটা প্রতিবয়ান তৈরি করতেই হবে। প্রমিত তৎসম বাংলায় বাঙালি মুসলমান লিখতে শুরু করেন ১৮৮০-র শেষ দিক থেকে। প্রথম জীবনীটি, হজরত মুহম্মদের জীবন ও ধর্ম নীতি, লেখেন শেখ আবদুর রহিম (১৮৮৭), যিনি ইসলামের ইতিহাসও লেখেন, সম্পাদনা করেন সুধাকর, মিহির, মিহির ও সুধাকর নামে উনিশ শতকের শেষ ভাগে প্রকাশিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন-এর মহাপুরুষ মুহম্মদের জীবন চরিত ও কৃষ্ণকুমার মিত্রের মহম্মদচরিত ও মুসলমান ধর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দুই-ই ছাপা হয় ১৮৮৭ সালে। দু’জনেই ছিলেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত, বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মবিষয়ক পঠনের একটি আধুনিক রূপ তুলে ধরতে এঁদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, যা বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের রসুলচর্চাকে প্রভাবিত করেছে। অন্য দিকে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী বয়ানে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামি সংস্কৃতির যে অবমূল্যায়ন, তার বিপরীতে ব্রাহ্মরা ইসলাম-চর্চার এই প্রকল্পে ব্রাহ্মসমাজীয় একেশ্বরবাদের চর্চার প্রসার ঘটিয়েছে।
সংস্কৃতায়িত বাংলা যে হয়ে উঠবে বাঙালি মুসলমানের ইসলামচর্চার ভাষা, তাঁরা তৎসম বাংলার পুরাণগন্ধিতায় পিছু হটবেন না, বরং তাকেই মাতৃভাষার রূপ বলে দাবি করবেন, সেখানে একেশ্বরবাদ লিখনে গিরিশচন্দ্রের তৎসম ভাষাপরিকল্প তাঁদের আশ্বস্ত করেছিল বইকি। কৃষ্ণপ্রিয় বলছেন অতুলকৃষ্ণ মিত্রের নাট্যজীবনী ধর্মবীর মহম্মদ (১৮৮৫), টাঙ্গাইলের রামপ্রাণ গুপ্তের হজরত মোহাম্মদ (১৯০৪), ফরিদপুরবাসী রাজকুমার চক্রবর্তীর হজরত মোহাম্মদ (১৯২০), চট্টগ্রামের রুক্মিণীকুমার চক্রবর্তীর পুণ্য-স্মৃতি (১৯৩৯)-র কথা। সেই সময় জীবনীসাহিত্যের ঘরানায় কৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য ও মহম্মদের মতো মহাপুরুষদের জীবন হয়ে উঠছে ধর্মীয় আধুনিকতা নির্মাণে অবশ্যম্ভাবী। এমন এক সময়ের দিকে লেখক যেতে চান, যেখানে এক দিকে জাতীয়তাবাদের একরৈখিক বয়ানে হিন্দু ধর্মীয় বেড়াজাল তৈরি হচ্ছে, অন্য দিকে সাহিত্যে হয়েছে ভাবনার যাতায়াত: ব্রাহ্ম স্কলারদের ইসলামচর্চায় আগ্রহ যেমন, হিন্দু লেখকদেরও বৌদ্ধধর্মের প্রতি উৎসাহ যথেষ্ট।
ছবিঃ সংগৃহীত।
বাঙালি অমুসলমানের রসুলে আগ্রহ যেমন উপনিবেশিক আমলে শুরু, বিশেষত ব্রাহ্মদের হাতে, বাংলাভাষী মুসলমানের বৈষ্ণব ভক্তিকাব্য ও কালীর স্তুতি অবশ্য আঠারো শতক থেকেই পাওয়া যায়, বিশেষত সুফি ধর্মতাত্ত্বিকদের হাতে। সুফিতত্ত্ব, তন্ত্র ও যোগসূত্র ধরে সৈয়দ সুলতানের হাতে সুফি যোগশাস্ত্রের একটি তত্ত্ববর্গ তৈরি হয়েছিল চট্টগ্রামে, ষোড়শ শতকে। সেখানে আলি রাজা যোগ করলেন নতুন গ্রন্থ ও নতুন ভক্তিপ্রতীক কালী, আলোচনা করেছেন কৃষ্ণপ্রিয়। এই সাধকদের মূল অনুধ্যানের বিষয় অবশ্যই ছিল কোরানভিত্তিক জ্ঞানচর্চা, কিন্তু ওঁরা দেশীয় ভাষায় ইসলামের প্রসারের নানা স্তর তৈরি করেন, দেশীয় ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে সংলাপে, ভক্তির প্রতীকে। কৃষ্ণপ্রিয় মনে করিয়ে দেন, পরমার্থ সাধনার এক পথ কালীবন্দনা।
যেমন বৈষ্ণব অনুষঙ্গ, তেমনই কালীস্তুতি ফিরে আসে উনিশ শতকের শেষে। ১৮৯৬-এ ছেপে বেরোয় প্রায় দু’শো পদ সম্বলিত পরমার্থ সঙ্গীত রত্নাকর অথবা জীবের প্রতি সার উপদেশ, দেখা যায় লেখক মৌলবি বেলায়েত হোসেন শুধু হিন্দু পাঠকসমাজে সমাদৃতই হচ্ছেন না, তাঁর ‘পুরাকালীন সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে’ ব্যুৎপত্তি দেখে তাঁকে কালীপ্রসন্ন উপাধি দেওয়া হচ্ছে। হিন্দু পাঠকদের জন্য যে তা সুখকর হয়েছিল, তা আমরা হিন্দুমহলে শংসার উচ্ছ্বসিত প্রকাশেই বুঝতে পারি। তবে এও ঠিক যে, একটি মাত্র পদ ‘কালী কালী বলে কালী’ থেকে কি কবিকে কালীচর্চাকারী হিসাবে রাখা যেতে পারে? না কি আসলে চিহ্নিত করা যেতে পারে মুসলমান কবিদের মধ্যে পরমার্থবিষয়ক সঙ্গীতবর্গের প্রতি ঝোঁককে, যেখানে বৈষ্ণব ও শাক্ত প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে।
উনিশ শতকের একদম শেষে আবদুল রশিদ চিশতীর মতো সুফি তরিকাভুক্ত কবিদের পাই, যাঁদের কাব্যভাষা ও চলনের সঙ্গে বেলায়েতের মিল আছে। কালীচর্চা বলতে কৃষ্ণপ্রিয় আমাদের অনেক বিস্তৃত সমন্বয়বাদী ভাষার দিকে নিয়ে যান। নিয়ে যান কণ্ঠশিল্পী রমজান খানের কাছে। আর আমাদের কাছে খুলে যায় কলকাতার সেই উস্তাদদের মহল্লা, যাঁরা হিন্দুস্থানি সঙ্গীতজগতের নক্ষত্র, বড়ে গুলাম আলি থেকে রাশিদ খান পর্যন্ত যাঁদের গানের বন্দিশে ঠাঁই নেন কৃষ্ণ থেকে কালী। অতঃপর লেখক আসেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সমন্বয়ের বোধে, হাছন রাজার গানে আল্লা রসুল শিব কালী হরির অনর্গল আনাগোনায়। আসেন যশোরের পাগল কানাইতে, যাঁর গানের সরল লৌকিকতায় ঠাঁই পান আল্লা-রসুল, দুর্গা কালী হরি। আসেন নজরুলে, যাঁর কালীসঙ্গীতের মাধুর্য কখনও ঘরোয়া কখনও ঘোরা মূর্তিতে অতুলনীয়; যিনি ইসলামের নিষ্ঠায় স্থিত, আবার ফারসি গজলের চালে কালীর স্তুতিতে তুরীয় মার্গে।
বই দু’টি একে অন্যের পরিপূরক, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের ধারণাকে প্রশ্ন করে, সংলাপের সহমর্মিতা দেখায়। রসুল-চর্চা’য় লেখক বলেছেন, সেখানে ইতিহাস রচনার ভান-ভণিতা নেই। কালী-চর্চা বইটি অনেক বেশি কথনে ভরা। তবু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে লেখক কী করবেন, কোনও বিষয়ের বিবরণ ও ব্যাখ্যা যদি কোনও সূত্র থেকে আসে, লেখকের ভূমিকা কী হবে। রসুল-চর্চা’য় আনিসুজ্জামান ও রেজাউল করীমের প্রদত্ত তথ্য এসেছে। আনিসুজ্জামান শেখ আবদুর রহিমকে গোঁড়া মুসলমান জাতীয়তাবাদী হিসাবে দেখেছেন। কৃষ্ণপ্রিয় যদি সেটি উদ্ধৃতিতে নিজস্ব বক্তব্য ছাড়াই রেখে দেন, তবে বোঝা মুশকিল কেন শেখ আবদুর রহিম ও অন্য আরও অনেকে মুসলমানের বাঙালিত্ব দাবি করছিলেন, এবং সেই সঙ্গে বাঙালি হিসাবে হিন্দুর হেজেমনিভুক্ত না হয়ে নিজেদের মুসলমানত্ব দাবি করছিলেন। আনিসুজ্জামানের এই কথাটিই যদি আমরা তর্কাতীত ভাবে রেখে দিই যে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের ইতিহাসচর্চা শুরু থেকেই শত্রুভাবাপন্ন, তা হলে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকে বোঝা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের জাতীয় চেতনার জটিলতা বোঝা যাবে না। হিন্দু জাতীয়তাবোধ যেমন দলিতকে, তেমন বাঙালি মুসলমানকেও কেমন মরিয়া করে তুলেছিল, সেই খতিয়ান পাব না।
মুসলমান রচিত মহম্মদের জীবনী আজ পর্যন্ত বাংলা প্রবন্ধে আলোচিত হয়নি, বাঙালি মুসলমান লেখকদের নাম সম্পূর্ণত অপরিচিত। তাই হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখকদের পরিচিতির সঙ্গে শেখ আবদুর রহিম, জামিরুদ্দিন বা আজহার আলি সম্পর্কে তথ্যসূত্র পেলে ভাল হত। রমজান খানের ক্ষেত্রে সাল-তারিখ নেই, যদিও তাঁর শিষ্য লালচাঁদ বড়ালের আছে। কিন্তু, এই বই দু’টি এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তারা আলো ফেলে সেই অজানায়, যেখানে গোষ্ঠীর ধর্মের নবতর বেড়ার বাইরে রচিত হয় নতুন সংযোগ, নতুন উৎসাহ: অপরের ধর্মকে জানার ও বোঝার।