Bengali book

বিভেদ পেরিয়ে মিলনে 

নির্মলকুমার বসু তাঁর সাত জন গবেষক-সহায়ককে পাঠ দিয়েছিলেন এক-একটি অঞ্চলের সামাজিক ইতিহাস কী ভাবে তুলে আনতে হবে, দ্বন্দ্ব-বিরোধ-সমন্বয়ের উপর কী ভাবে লক্ষ রাখতে হবে।

Advertisement

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৩ ০৮:১০
Share:

অতীত: ষাটের দশকের কলকাতা, এন্টালি বাজার অঞ্চল।

কলকাতা: সমাজ ও সংস্কৃতি

Advertisement

নির্মলকুমার বসু, সঙ্কলন ও সম্পা: অভীককুমার দে

৪৫০.০০

Advertisement

অক্ষর প্রকাশনী

বছর দশেক আগে নবেন্দু ঘোষের একটা গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলাম দেশভাগ নিয়ে এক সঙ্কলনের জন্য। ‘ত্রাণকর্তা’ নামে সেই গল্পটিতে আমাদের শহরে ‘এ-পাড়ার হিন্দু’ আর ‘ও-পাড়ার মুসলিম’দের মধ্যে জেগে থাকে এক ডোমপাড়া, যারা নিজেদের হিন্দু পাড়ার সঙ্গে যুক্ত মনে করলেও ‘ভদ্র’ ও ‘অভিজাত’দের কাছে থেকে যায় ‘এ-পাড়ার লজ্জা’! ’৪৬-এর দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে হাড় হিম করা ওই গল্পে পাড়াভিত্তিক জনবিভাজনের ছবিটা মনের কোণে আবার উঁকি দিয়ে গেল কলকাতার সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে নির্মলকুমার বসুর একটি দ্বিভাষিক প্রবন্ধ সঙ্কলন পড়তে পড়তে।

কলকাতা নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাঁর ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধগুলো একত্র করেছেন সম্পাদক অভীককুমার দে। সযত্ন সম্পাদনা ও প্রযোজনায় সম্প্রতি বেরোনো এই বইটিতে বেশ কয়েকটি ম্যাপও আছে প্রধানত ষাটের দশকের কলকাতার বসতি-বিন্যাস ও বৃত্তি-বিন্যাস নিয়ে। যেমন বাঙালি বসতি-বিন্যাসের ম্যাপে দেখতে পাচ্ছি, উত্তর কলকাতার ব্রাহ্মণ-কায়স্থ পাড়ার পাশে গোঁজা হাড়ি ও ডোমপাড়া। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪-র মধ্যে বেশ কিছু মুসলিম অঞ্চলে জনবিন্যাস কী ভাবে বদলে গেছে এবং সেখানকার মানুষজন সরে গিয়ে দু’-চারটি ওয়ার্ডে সম্প্রদায়গত ভাবে থাকছে, ম্যাপে দেখা যাচ্ছে সেটাও।

যে সময়ে নির্মল বসু অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অধিকর্তা ছিলেন (১৯৫৯-৬৪), এই সঙ্কলনের বেশির ভাগ প্রবন্ধ লেখা হয় সে সময় বা তার ঠিক আগে-পরে। স্বাধীনতার পনেরো-ষোলো বছর পর দেশভাগ-দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরে ১৯৬২-৬৪ সালে এই দিকপাল নৃতত্ত্ববিদের নেতৃত্বে ক্যালকাটা ১৯৬৪: আ সোশাল সার্ভে নামক সমীক্ষাটি করা হয়েছিল মূলত দু’টি পরিবর্তনের ধরন বুঝতে চেয়ে।

একটি হল তখনকার কলকাতার ৮০টি ওয়ার্ডে (এখন ১৪৪টি ওয়ার্ড) শহরবাসীদের, যাঁদের মধ্যে আছেন দেশের নানা প্রান্তের নানা ভাষা নানা জাত-ধর্মের মানুষ, পেশার রূপান্তর দু’-তিন প্রজন্ম ধরে কী ভাবে ঘটেছে তার হদিস করা। এক-একটি পাড়ার আদি বাসিন্দাদের খুঁজে বার করে এটা করা হত। যেমন কাঁসারিপাড়াগুলোতে গিয়ে সমীক্ষকরা দেখেছেন যে, বিশ শতকের গোড়ায় পুরনো ধাতুর কাজ ছেড়ে দিয়ে যাঁরা ঘোড়ার গাড়ির কোচ তৈরি আরম্ভ করেন, বা বিশ্বযুদ্ধের সময় পিতলের বোতাম আর ব্যাজ তৈরিতে হাত লাগান, তাঁদের উত্তরপুরুষ সোনা-রুপোর দোকানে কাজ করছেন বা চিকিৎসার যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন।

সমীক্ষার আর একটি অনুসন্ধানের বিষয় ছিল কলকাতায় বিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ-ষাট বছরে স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্থাগুলোর শুরুর ইতিহাস ও কাজকর্মের বিবর্তন নজর করা, যেগুলোর মধ্যে নানা প্রাদেশিক ও বাণিজ্যিক গোষ্ঠী পরিচালিত সংস্থাও আছে, আবার স্কুল-ক্লাব-মন্দির-মসজিদও ধরা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের একটি বিশেষ ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া গিয়েছিল: যে সব সংস্থা মুষ্টিভিক্ষা ও অল্প চাঁদার উপর নির্ভর করে পাড়ায় পাড়ায় অনাথ শিশু বা বিধবাদের পাশে থাকার চেষ্টা করত, সে ধরনের সংস্থা প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে।

এই বইয়ের লেখাগুলোতে ষাটের দশকে শহরে সমাজ সমীক্ষার সূত্রে উঠে আসা নানা দিকে আলো পড়েছে। ভূমিকায় গৌতম ভদ্র মনে করিয়ে দেন জরুরি একটি কথা: নির্মলকুমার বসুর “দেখা ও ভাবা কলকাতা নিছক বাঙালির নয়। বরং আরও অনেক ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠী ও ভিন্ন সাংস্কৃতিক বলয়ের মিশ্র অবস্থানে গড়ে ওঠা শহর।” এই শহরে বিভিন্ন গোষ্ঠীগত ঐক্যের বিভেদকামী দিকের প্রতি বার বার নজর টেনেছেন নির্মল বসু। তাঁর মনে হয়েছে এক-একটি গোষ্ঠী, এক-একটি সম্প্রদায় যেন এক-একটি স্বতন্ত্র দ্বীপ। স্বার্থের খাতিরে সাময়িক ভাবে একে অন্যের কাছাকাছি এসেছে, কিন্তু তাতে বিচ্ছিন্নতা ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান কিছুমাত্র দূর হয়নি। কলকাতার সমাজ-জীবনে প্রভেদকে স্থায়ী করার চেষ্টা দেখে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যোগসূত্র রচনাকারী সংস্থা গড়ে তোলায় জোর দিয়েছেন তিনি। শহরের উন্নয়ন, শিল্প প্রসার ও নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের উদ্যোগের পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠীর মধ্যে আদানপ্রদান ও গঠনমূলক সমাজবোধ তৈরিতে মন না দিলে অসহিষ্ণুতা যে প্রবল হয়ে উঠবে, সেই আশঙ্কা প্রকাশ পায় তাঁর লেখাগুলোতে। প্রভেদ-দূরত্বের যুগ বহুকাল পেরিয়ে বিদ্বেষ-অসহিষ্ণুতার দমবন্ধ-করা পরিবেশে লেখাগুলো পড়তে পড়তে জানতে ইচ্ছা করে, ষাট-সত্তরের দশকের নীতি-নির্ণায়করা কলকাতা নিয়ে এই সমাজ সমীক্ষা তথা অন্বেষণকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংযোগ-আলাপচারিতাকেন্দ্রিক কোনও নতুন উদ্যোগ করার চেষ্টা হয়েছিল কি তখন?

নির্মলকুমার বসু তাঁর সাত জন গবেষক-সহায়ককে পাঠ দিয়েছিলেন এক-একটি অঞ্চলের সামাজিক ইতিহাস কী ভাবে তুলে আনতে হবে, দ্বন্দ্ব-বিরোধ-সমন্বয়ের উপর কী ভাবে লক্ষ রাখতে হবে। তাঁদের মধ্যে এক জন, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এই বইয়ে একটি লেখা দিয়েছেন, ‘এই শহর চিনতে শিখিয়েছিলেন আমায়’ নামে। ছোট্ট লেখাটি আমাদের আগ্রহী করে তুলল বিশদে জানার— কলকাতা নিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে করতে সহায়কদের সঙ্গে প্রধান গবেষকের নিবিড় আলোচনার কথা। ক্যালকাটা ১৯৬৪: আ সোশ্যাল সার্ভে নামে নির্মলকুমার বসুর যে বইটি বেরিয়েছিল ১৯৬৮ সালে, সেটিও বহু দিন মুদ্রিত নেই। বইটির পুনর্মুদ্রণ এবং সেই সঙ্গে সমীক্ষাটি করার সময়কার অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মলবাবুর গবেষক-সহায়কদের পুরনো লেখা অথবা নতুন লেখার সংযোজন এখনকার গবেষকদের নানা ভাবে পথ দেখাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement