কী আশ্চর্য! কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল ২০২০-র সেপ্টেম্বরে ইহলোক ত্যাগ করেছেন, কিন্তু তৎপূর্বে জানুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর কবিতা সংগ্রহ গ্রন্থটির পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতেই তাঁর হৃৎস্পন্দন ঠাহর করছি। এর কারণ তাঁর সুবিস্তৃত কাব্যপরিধি, যে পরিধিতে তিনি তাঁর মেধা-মননে আয়ত্ত জীবনের, বিশেষত বালকবেলার উপলব্ধি, ঘটনাবলি এবং সখ্য পরিচয়ের অগণন ব্যক্তিবর্গকে কবিতায় অবস্থিত করেছেন। পাশাপাশি তাঁর মনোবাসনায় চর্চিত গ্রহ-নক্ষত্রসমূহের অবস্থান গণনা, জ্যোতিষচর্চা, হোমিয়োপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ভেষজ ইত্যাদি চিকিৎসাচর্চার বিষয়েও নিমজ্জিত থেকেছেন, যা ওই কবিতা-পরিধিতে ছায়া ফেলেছে। পার্থপ্রতিমের সঙ্গে আজ বিকেলেই যেন কফি হাউসে দেখা হয়ে যাবে— এই মনোভাব নিয়েই তাঁর বইটি পাঠ করার সুপারিশ করছি।
২০১৮-তে পার্থপ্রতিম লিখেছেন: “নকশালপন্থীদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে স্মরণ করা হচ্ছে।/ প্রকৃতপক্ষে নকশালপন্থীতার পরিকল্পনা ১৯৬৬ সালের/ প্রেসিডেন্সি ও কফিহাউসে ঘটে, ১৯৬৭-তে বিরাট ঘটনা/ নকশালবাড়িতে যা বিষয়টিকে বিরাট খ্যাতি দেয়। ১৯৬৫-র/ নভেম্বর থেকে আমি কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে প্রত্যহ যেতে শুরু/ করি।” (‘প্রতিযোদ্ধার কথা’/ নবান্ন)।
ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকেই পার্থপ্রতিমের কবিতা প্রয়াসের সূচনা। ওই সময়ের বাংলায়, সকলেই জানেন, সময় তখন নাচছিল, সমাজ বদলের স্বপ্ন তখন জেগেছিল। ওই কালটিতে তরুণ পার্থপ্রতিম লিখতে শুরু করেন তাঁর দেবী কাব্যগ্রন্থটির দীর্ঘ কবিতাগুলি, যা বই হয়ে বার হয় ১৯৭০ সালে। আমার বিবেচনায় পার্থপ্রতিম ওই কালটির, ওই রণনৃত্যরত সময়টির বন্দনা করেছেন। সে সময় পার্থপ্রতিমের দেবীবন্দনা আলোড়িত করেছিল তৎকালের হাওয়া-বাতাসকে। উঁহু, এখনও করছে— “রণপ্রণয় দাও আর্ত পৃথ্বীকে, বিশ্ব হোক নবপ্রণীত... তবে জয়দণ্ড তোলো, সুনির্মিত করো স্বর্ণজয়রথ/ দেবী, নির্ধারিত করো ভবিষ্যৎ...”। যে যুগে তরুণপ্রাণ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আঁকড়ে ধরেছিল, সেই কালে দেবী রাঙা ইস্তাহারই মনে হয়েছিল। এতে আক্ষেপ, অভিমানও ছিল: “তুমি/ নির্মাণ করোনি তার স্বচ্ছ ধ্যানভূমি।... প্রস্তুতির কাল কেন এত দীর্ঘ”।
কবিতা সংগ্রহ
পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল
৪০০.০০
আদম
প্রতিভালব্ধ ও চর্চিত আপন কাব্যভাষায় পার্থপ্রতিম তাঁর স্বভাবসঞ্জাত ক্ষিপ্র সপ্রতিভ বিচরণে সদাই ছিলেন স্ফূর্ত। তির্যকতা, কূটাভাসের সঙ্গে ছিল তাঁর রসিক মনের মিশ্রণ। অক্ষরবৃত্তেও তিনি সাবলীল স্ফূর্তি এনে দিয়েছেন ইচ্ছেমতো। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের গানও তাঁর কবিতা শরীরে
বসিয়ে দিয়েছেন। লিখেছেন, পাঠকের সঙ্গে, ব্যক্তিগত কাব্যগ্রন্থ থেকে: “নসিব-ই তো বড়বাবু, কোম্পানি-ছয়লা/ বুঝেশুনে চললেও করে জান কয়লা/ তার পাতা খাঁচাকল — কে বোঝে তা পয়লা?... ওয়্ ওয়্ ওয়্” (‘গীতা আর আশার ডুয়েট’)।
বিবিধ ছন্দে, সাধু ও চলিত গদ্যে অবাধ চলাচল ছিল তাঁর কবিতাপ্রয়াসে। আঙ্গিক, পদ্ধতি, প্রকরণে তাঁর দক্ষতা অতুলনীয়। চতুর্দশপদী লিখেছেন অনেক, যা রয়েছে বর্ণজীবের সনেট কাব্যগ্রন্থটিতে, আর কিছু সনেট আছে এর আগের পাঠকের সঙ্গে, ব্যক্তিগত বইটিতে।
এই কবিতা সংগ্রহ রাতে ছাদে নিয়ে স্বল্পালোকে মেলে ধরলে, গ্রহ-তারা সকল যেন উত্তেজিত, অধিক আলোকিত হয়ে ওঠে। দিবালোকে পৃষ্ঠা ওল্টালে হোমিয়োপ্যাথির মদির কোহলসুবাস ভেসে ওঠে, ভেষজের পত্রপুষ্পে বনজ ঘ্রাণ ভাসে। এই গ্রন্থ পাঠকজনের সুখপাঠ্য তো বটেই, ভাবী কালের কবিতাপ্রয়াসীদের কাব্যসহায়িকা, ব্যাকরণও।