ইরফান খান: দ্য ম্যান, দ্য ড্রিমার, দ্য স্টার
অসীম ছাবরা
৫০০ .০০
রূপা
তখন নতুন শতকের শুরু, শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ থেকে মকবুল ছবি করার প্রস্তুতি চলছে। ঠিক হয়েছে, মূল নাটকের প্রেতস্বরূপার আদলে ছবিতে দুই দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ চরিত্রে অভিনয় করবেন ওম পুরী আর নাসিরুদ্দিন শাহ। নাসিরকে এক দিন পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ এসে জানালেন, তিনি কথা বলছেন কমল হাসনের সঙ্গে, যদি তাঁকে দিয়ে মকবুল (অর্থাৎ ম্যাকবেথ) চরিত্রটা করানো যায়। শোনামাত্র অসম্ভব রেগে গেলেন নাসির। উত্তেজিত ভাবে বললেন, “দেখো, তুমি যদি ওঁর সঙ্গে কথা বলো, তা হলে আমি তোমার ছবিতে নেই।” বিশাল তখন তাঁর তারকা-ভাবনা থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই ইরফানকে মকবুলের জন্য নির্বাচন করলেন, আর এই নির্বাচন প্রসঙ্গে নাসিরের মন্তব্য: “দ্যাট ওয়াজ় আ মাস্টারস্ট্রোক।”
অসীম ছাবরা লিখতে লিখতে এমন ভাবেই সাজিয়েছেন বইটাকে যে, পাঠক ইরফানের হয়ে-ওঠার পরম্পরা বুঝে নিতে পারবেন। যেমন মকবুল-এর প্রেক্ষিতে অসীম জানাতে ভোলেন না যে, ওই ছবিতে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার স্নাতক ইরফানের সঙ্গে অন্য প্রাক্তনীরাও ছিলেন— নাসির, ওম, পঙ্কজ কপূর। খুব যে সচেতন ভাবে বিশ্লেষণের ভঙ্গিতে লেখক পাঠককে শিল্পী হিসেবে ইরফানের অভিপ্রায় চেনাতে সচেষ্ট ছিলেন, তা হয়তো নয়, তবে তাঁর লাগাতার সাক্ষাৎকারভিত্তিক বিবরণী থেকে ইরফানের শিল্পীমনের আদল অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে আসে, অভিনেতার গতিপথটি বোঝা যায়। দেশ জুড়ে লকডাউন জারি হওয়ার একটু আগেই বেরিয়েছে এ বই, বছরের একেবারে গোড়ার দিকে। ইরফান তখনও বেঁচে। তাঁকে বা তাঁর কাজকর্ম নিয়ে এত বিশদ এমন আর কোনও বই বোধ হয় বেরোয়নি।
কম বয়সে, সত্তরের দশকের শেষে যখন রাজেশ খন্না, অমিতাভ বচ্চন বা জিতেন্দ্রর ছবি দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠছেন তিনি, তখন রুপোলি পর্দায় তাঁদের সুদর্শন ব্যক্তিত্বের গ্ল্যামারে কোথাও ধন্দই তৈরি হয় তাঁর মনে— ফিল্মের ‘হিরো’ হওয়া বেশ শক্ত ব্যাপার। আবার, পাশাপাশি ওই দশকেই মৃণাল সেনের মৃগয়া-তে মিঠুন চক্রবর্তীর অভিনয় দেখে তাঁর মনে প্রতীতি জন্মায়— “যদি উনি এক জন অভিনেতা হয়ে উঠতে পারেন, তা হলে আমিও চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
আসলে এ ভাবেই এক জন অভিনেতার জন্ম হয়, শিল্পগুণসম্পন্ন সিনেমার যে আধুনিক অভিনয়, সেই বোধবিশিষ্ট কোনও অভিনেতার, ইরফান ছিলেন তেমনই এক অভিনেতা।
তিনি কোনও দিনই সেই বলিউড ব্র্যান্ডের অভিনেতা ছিলেন না, যে বলিউড অধিকাংশ ছবিতেই চরিত্রাদির মধ্যে মানুষের রক্তমাংস-শিরদাঁড়া সরবরাহ করে উঠতে পারে না।
ইরফান কখনওই নায়কের অভিনয় আর চরিত্রাভিনয় আলাদা ভাগ করতেন না, নিজের অভিনীত ছবিগুলিতে চরিত্রময় নায়কেরই সন্ধান করে গিয়েছেন সারা জীবন। সৌম্য, সুদর্শন, দেবোপম নায়কের অভিনয় থেকে বহু দূরে সরে থেকেছেন বরাবর। কখনওই ভুলতেন না, অভিনেতা দেখতে যেমনই হোন না কেন, তাঁর কাজ হল চরিত্রকে মূর্ত করে তোলা। তাঁর কাঙ্ক্ষিত ছিল সেই সব চরিত্র, যাদের বাহ্যিক আচার-আচরণ থেকে দৈনন্দিন যাপনের মধ্যে ধরা পড়বে মানুষের স্বরূপ, অন্তর্জীবনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বৈশিষ্ট্য।
মকবুল, হাসিল, দ্য নেমসেক, লাইফ ইন আ মেট্রো, পান সিং তোমর, লাইফ অব পাই, দ্য লাঞ্চবক্স, হায়দার, তলওয়র, পিকু, হিন্দি মিডিয়াম, আংরেজ়ি মিডিয়াম... এই মুহূর্তে এক নিশ্বাসে অন্তত এক ডজন ছবির নাম করে ফেললাম, যে সব ছবির চরিত্র বুনতে বুনতে বার বার প্রমাণ করেছেন ইরফান যে, তিনি এক জন ‘অভিনেতা’, তারকা নন, বলিউডে তিনি বরাবরই ‘আউটসাইডার’।