সূত্রধররা উনিশ শতকে মন্দির তৈরির শিল্পী ছিলেন। সে সব শুধু ধর্মীয় ইমারত বা ইতিহাসের প্রত্নসাক্ষ্যের নিদর্শন নয়— বঙ্গজীবনের হারিয়ে যাওয়া সৌকর্য। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী শুধু মন্দিরের রীতি-স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বা মূর্তির বৈচিত্র নয়— মসজিদের গম্বুজের ধাঁচ, পঙ্খের কাজ, রাসমঞ্চ, সমাধিমন্দির, চণ্ডীমণ্ডপ, গির্জা, অট্টালিকার প্রাচীনত্বের চর্চাকেও সেই আলোচনায় এনেছেন। আলোচ্য বইটি পরিচিতিমূলক নিবদ্ধীকরণের বাইরে প্রাগৈতিহাসিক মানবসমাজ ও প্রত্নতত্ত্ব, শিলালিপি ও তাম্রশাসনের আলোচনার সঙ্গে জেলা পরিচয়ের বৃহত্তর পরিসরে পুরাবৃত্ত রচনা। জেলা বর্ধমান বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিম জেলা বিভাগে পরিচিত হয়েছে। পুরাকীর্তির এই আলোচনায় সেটি সার্বিক ভাবে বিবেচিত হয়নি, কারণ লেখক ধারাবাহিক ভাবে অখণ্ড বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। তাই প্রায় চার দশক আগের সংগৃহীত তথ্যের ব্যাপ্তিও এই কাজে প্রতিফলিত। ৬০০ পৃষ্ঠার তথ্য-বিবরণের সঙ্গে ৮০ পৃষ্ঠার আলোকচিত্র নিয়ে বৃহদাকার এই প্রকাশনা।
বর্ধমান জেলার পুরাকীর্তি
যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
৭৫০.০০
অক্ষর প্রকাশনী
তুলনামূলক ভাবে পশ্চিম বর্ধমানে পুরাকীর্তি স্থাপত্য কম থাকলেও বৈশিষ্ট্যগত ভাবে মানকর-সহ বিভিন্ন কেন্দ্র উল্লেখ্য। এই নথিবদ্ধকরণে গ্রাম ও শহর মিলিয়ে পূর্ব বর্ধমানের ৩৮৭টি ও পশ্চিম বর্ধমানের ৮৬টি পুরাকীর্তি কেন্দ্রের পরিচয় আছে, যাতে সব মিলিয়ে প্রায় হাজারটি পুরাকীর্তির নিদর্শনে মসজিদের তালিকা, শৈলীভিত্তিক মন্দিরের তথ্য-তালিকা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বর্ধমানের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মান্য গবেষক হওয়ায়, পূর্ববর্তী তিন খণ্ড রচনার পরবর্তী কালে এটি পরিবর্ধিত খণ্ড হয়েছে। সূত্রধারী এই রচনায় জনপদের প্রাচীনত্ব স্থাপত্যের আকৃতি, পূজিত বিগ্রহ, মন্দির ও মসজিদ সংশ্লিষ্ট মেলা-উৎসব-রীতি-আচারের সঙ্গে টোল-চতুষ্পাঠীর ঐতিহ্যের তথ্য পেরিয়ে কোনও ক্ষেত্রে মুসলমান বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের মতো বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। পুরাকীর্তি কেন্দ্রের তথ্য লিপিবদ্ধ করতে এমন কিছু প্রসঙ্গ সম্পাদনায় পরিমার্জন প্রয়োজন ছিল। এখন মুদ্রিত ছবির মানই বা এত খারাপ কেন?
বর্তমান জেলাচর্চায় লেখকের নথি, তথ্য ও লেখ্যাগারের রসদ মজবুত— সে সবের সম্মিলনও ঘটেছে। প্রাগিতিহাসের সূত্র ধরে জেলার প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শনে পশ্চিম বর্ধমানের বীরভানপুর বা পূর্ব বর্ধমানের পান্ডুরাজার ঢিবি, মঙ্গলকোট ইত্যাদির প্রত্নসম্পদের গুরুত্বও স্বতন্ত্র আলোকপাত করেছেন। আবার, মন্দির ভাস্কর্য অংশের মনোগ্রাহী বর্ণনা, তৈরির খুঁটিনাটি পুরাকীর্তি চর্চার মূল্যবান সংযোজন। লেখকের তালিকাভুক্তিতে জেলায় সৌন্দর্যমণ্ডিত পোড়ামাটির ফলক সমন্বিত মন্দিরের সংখ্যা ১৪৫টি।
বর্তমানের বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি, হাওড়া-সহ অখণ্ড বর্ধমান ও লাগোয়া বীরভূমের বৃহত্তর একটা বৃত্ত কল্পনা করলে বোঝা যায় পোড়ামাটি বা টেরাকোটা শিল্পের ঐশ্বর্য, যা মূলত সতেরো থেকে উনিশ শতকে সূত্রধর শিল্পীদের কর্মশৈলীর নমুনা। পারম্পরিক জনসমাজেই ছিল সেই শিল্পশৈলী তৈরির মূল শক্তি— বর্ধমান রাজের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় তৈরি নিদর্শন সে তুলনায় ছিল নগণ্য। সেখানকার কৃষিভিত্তিক জনজীবনের বহিরঙ্গ আজ বহুলাংশে পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু বাংলার শিল্পশৈলীর ‘গিল্ড’ আর শিল্পীগোষ্ঠীর ধারাসূত্রের আঁচ আজও সন্ধানী হলে কোথাও কোথাও পাওয়া যাবে। এরই পটভূমিতে, জেলা-সংস্কৃতির বিপুল এই তথ্যভান্ডারের উদ্ঘাটনে, লেখকের নিবিষ্টতাই এ কাজের বাস্তবায়নের মূল শক্তি।