মিডনাইটস বর্ডার্স: আ পিপলস হিস্ট্রি অব মডার্ন ইন্ডিয়া
সুচিত্রা বিজয়ন
৬৯৯.০০
ওয়েস্টল্যান্ড বুকস
আলির বাড়ি সীমান্তে, ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ঘেঁষে। মাল পাচারে সুবিধা হবে ভেবে বাংলাদেশিকে বিয়ে করেছিল আলি। পাচারই কাল হল। সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধর্ষিত হল তার বৌ। পুলিশ, লোকের জ্বালায় দেশে ফিরে গেল সে। তাকে আর দেখতে পায়নি আলি। সকলেই গ্রাম ছাড়লেও কারও অপেক্ষায় ভিটা আঁকড়ে পড়ে থাকে আলি। অদূরেই সীমান্তে নতুন বেড়া উঠেছে। বসেছে ফ্লাডলাইট। সন্ধে থেকে ভোর, বাড়ির বুক চিরে থাকা ফ্লাডলাইট আলিকে উন্মাদ করেছে। দরজা-জানলা, খবরের কাগজ-টেপ সাঁটিয়ে আলোর সব পথ বন্ধ রাখে। বিড়বিড় করে, “ওরা আমার দুঃস্বপ্ন কেড়েছে। আমার স্বপ্নও চুরি করেছে।”
না, এটি মান্টোর গল্প না। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে, জলপাইগুড়ির মুড়িখাওয়ার নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকে পড়া আলির হৃদয়বিদারক কাহিনিটি সামনে এনেছেন সুচিত্রা বিজয়ন, তাঁর প্রথম গ্রন্থ মিডনাইটস বর্ডার্স-এ। নিউ ইয়র্ক-নিবাসী আইনজীবী, চিত্র-সাংবাদিক সুচিত্রার জন্ম চেন্নাইয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের হয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে, মিশরে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে কাজ করেছেন। বইটির সূত্রে সুচিত্রা নানা পর্বে আট বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদ-খণ্ডিত ভারতের বিস্তীর্ণ ৯,০০০ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে দুঃসাহসী অনুসন্ধানে দেশভাগ-পরবর্তী অপরাধ-প্রতিক্রিয়ায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। অগুনতি নোটবুক, হাজারেরও বেশি ছবি, ৩০০ ঘণ্টার বেশি কথোপকথন, এবং অজস্র নথির ভিত্তিতে রচিত বইটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সীমান্ত প্রভাবিত মানুষের মর্মান্তিক জীবনযাপনের ‘ভুলে যাওয়া গল্পের জাদুঘর’ হয়ে উঠেছে।
সংখ্যাগুরু ইতিহাস বয়নে আশ্রয় না পাওয়া, ‘সংখ্যা’য় পরিণত হয়ে যাওয়া ‘বিশেষ মানুষ’-এর আত্মপরিচয় খুঁড়ে বার করে এক নয়া জন-ইতিহাস নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন সুচিত্রা। তাঁরাই স্বাধীনতার ‘অন্যমনস্ক বলি’। ঔপনিবেশিকের খামখেয়ালে ভরা অনৈতিহাসিক, অযৌক্তিক, মনগড়া মানচিত্র নির্মিত সীমান্তে ইতিহাস নিরন্তর গড়ে উঠছে— দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক সুদীর্ঘ রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস। সেই স্মৃতি, ইতিহাস দিয়ে এক নতুন মানচিত্র গড়তে চেয়েছেন সুচিত্রা। সেই মানচিত্র কতকটা রাষ্ট্রীয় হিংসার মানচিত্র, সীমান্তের বিপদ এড়িয়ে থাকা বৃহত্তর, সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিকের উপেক্ষারও।
র্যাডক্লিফ-ডুরান্ড-ম্যাকমাহন লাইন, এলএসি-এলওসি’র সীমান্ত জুড়ে এক গভীর গ্রাউন্ড রিপোর্টিং করেছেন সুচিত্রা। তার সূত্রে বইটিতে ব্যক্তিগত আখ্যানের ভিতর দিয়ে দেশভাগ ও সীমান্ত-সঙ্কটের ঐতিহাসিক ও সমকালীন প্রেক্ষিতকে তাঁর পর্যালোচনা, আত্মোপলব্ধি দিয়ে পাঁচটি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন। সীমান্তে চলমান হিংস্রতা, নয়া-জাতীয়তাবাদ, নাগরিকত্ব-বিতর্ক ও রাষ্ট্র-নাগরিকের সম্পর্কের উত্তরহীন প্রশ্নের নিরিখে তিনি ‘ইন্ডিয়া’ নামক আপন দেশে আত্মানুসন্ধানে নেমেছেন। সেই লক্ষ্যে ছুটেছেন প্রজাতন্ত্রের নানা ভগ্নপ্রায় প্রান্তে— কাশ্মীরের বান্দিপোরার আজাস গ্রাম থেকে অসমের বাঙালি ডিটেনশন সেন্টার। অসংখ্য সেনা, ‘জঙ্গি’, সীমান্তরক্ষী এবং জনসাধারণের সাক্ষাৎকার সমৃদ্ধ বইটি। কেবলমাত্র যন্ত্রণাকে প্রত্যক্ষ করা বা নির্বাকদের মুখে ভাষা দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য নয়— তাঁদের ব্যক্তিগত স্মৃতি-ইতিহাস-সংগ্রামের পক্ষে সওয়াল করাও। তাতে ভর করেই সুচিত্রা নেশন-স্টেট, তার সার্বভৌমত্বের স্বেচ্ছাচারিতা, নাগরিক দায়িত্ব পালনে উপেক্ষা, তার সন্ত্রাস-ব্যর্থতা-ভবিষ্যতের বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে একটি ‘ক্রিটিক’ তৈরির চেষ্টা করেছেন।
বড় অনিশ্চয়তার জায়গা সীমান্ত। গাজিরা জানে, সীমান্তে দেশভাগ এখনও অসম্পূর্ণ, চলমান। সীমান্তরক্ষীদের সামনে পানিতারবাসী স্পষ্ট জানায়— তারা ‘খুব ভাল’ আছে, তাদের ‘সমস্যা নেই’, ‘সব আছে’। সেখানে ভারত-বাংলাদেশ ব্যবধান বোঝা দায়। ইছামতীর ধারে ‘বর্ডার পিলার নম্বর-১’ নিছকই ক্রিকেট স্টাম্প। গৌড়ের শতছিদ্র কোতোয়ালি দরজা যেন আধুনিক ভারতেরই প্রতিরূপ। সুচিত্রা যাঁদের গল্প তুলে আনেন, তাঁরা বার বারই নেশন-স্টেটের এই আরোপিত মানচিত্র সম্পর্কে আমাদের সংশয়ে ফেলেন। মানচিত্র ক্ষমতার প্রতিরূপ, সুবিচারের নয়। হয়তো তাই নাগাল্যান্ডে, মায়ানমার সীমান্তে সুচিত্রা শোনেন— “এটা ভারতের অংশ না।” তাঁদের সন্তানদের স্মৃতিস্তম্ভে লেখা থাকে— ‘ভারতের হাতে নিহত’।
সীমান্তরক্ষী, সেনা, আধিকারিকরাও এই আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুচিত্রা খেয়াল করান, এঁদের অধিকাংশই সদ্য কৈশোর পেরোনো। বেশির ভাগই আসছেন নিম্নবর্গীয় শ্রেণি থেকে। স্থানীয় ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস সম্বন্ধে অজ্ঞ। একমাত্রিক সামরিক পৌরুষিকতায় তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিক জগতের বাসিন্দা। সীমান্তের নাগরিকদের তাঁরা পূর্ব-নির্ধারিত আধিপত্যকামী একমাত্রিক চিহ্নিতকরণের মধ্যে দিয়ে দেখছেন। তাঁদের চোখে মানুষ মাত্রেই সন্দেহভাজন। সুচিত্রা লিখছেন, “ষোলো বছরের মেয়েকে গুলি করে মেরে ফেলার অযৌক্তিকতা তাঁরা বুঝতে পারেন না।” ভারত-চিন সীমান্তের রক্ষী তাই ১৯৬২-র যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিপরীত ইতিহাসকে সত্য ভাবে। আবার হরীশের মতো যুবা সীমান্তরক্ষীদের বিচলিত করে ফেলানির মর্মান্তিক মৃত্যুকাহিনি। দিনের শেষে সীমান্তের প্রহরীরাও যে এক গভীর অসাম্যেরই ফল, বুঝিয়ে দেন সুচিত্রা।
বইয়ে সুচিত্রার আবেগ, ক্রোধ, মর্মস্পর্শী মন সর্বত্র নজরে পড়ে। তাই কখনও কখনও তাঁর দৃষ্টিকে একমুখী, পূর্ব-নির্ধারিত এবং রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষুব্ধ বলে মনে হতে পারে। বিশেষ করে সুচিত্রা কাশ্মীর বিতর্কের ইতিহাসের একাংশকে যে ভাবে উপস্থাপিত করেন, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কথা অনুল্লিখিত রাখেন। এ ছাড়া ভারত-ভুটান সীমান্তের অনুপস্থিতি, কেবল এক প্রান্তের (আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত বাদে) ক্ষতের কথাই উঠে আসা, স্বাভাবিক ভাবেই বইটিকে ভারতকেন্দ্রিক ডিসকোর্সে সীমাবদ্ধ করেছে। তাতে সীমান্তের অর্ধেক ছবিই ফুটেছে। সুচিত্রার বইয়ের প্রতিটি ছবিই ক্ষতগুলোকে আরও গভীরতা দিয়েছে। সীমান্তগুলিকে বুঝতে দরকার ছিল আরও মানচিত্রের।
১৯৪৭-এর এক ‘মিডনাইট’-এ ভারতবাসীকে নয়া ভোরের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নেহরু। ২০২১ সালে, ‘মিডনাইট’ শব্দে নতুন চাল দিয়েছেন সুচিত্রা। আরোপিত সীমান্তের ব্যক্তিগত যন্ত্রণাগুলিকে জড়ো করে দিল্লিশাসিত ‘এক ও অভিন্ন ভারত’-এর আইডিয়াকে প্রশ্ন করেছেন। তাঁর ‘মিডনাইট’ একটি হিংস্র জন্মের প্রতীক-মুহূর্ত। যে হিংস্রতা ক্রমে রাষ্ট্র দ্বারা বিধিবদ্ধ হয়েছে, আছড়ে পড়েছে ক্ষমতার দূরবর্তী প্রান্তে। মূলত এঁদেরই আশ্রয় দিয়েছেন সুচিত্রা। দেশভাগের হিংসার ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়ে আগেও কাজ হয়েছে। কিন্তু, সুচিত্রা দেশভাগ পর্বের ব্যক্তিস্মৃতির সংগ্রহেই থামেননি, সীমান্তে চলমান তার ক্ষতের সম্প্রসারিত স্মৃতিকেও হাজির করেছেন। সব থেকে বড় কথা, তিনি নয়া জাতীয়তাবাদী-হিন্দুত্বের রথে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদীর ভারত-সমকালকেও এই তর্কের অংশ করে আধুনিক নেশন-স্টেট, তার আরোপিত সীমান্ত, নাগরিকত্বের ধারণা সম্পর্ককে এই জন-ইতিহাসের একটি বৃহৎ প্রেক্ষাপটের প্রশ্নের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
আর্থিক ও প্রযুক্তির বিশ্বায়ন বিশ্বের প্রতিটি নাগরিককে একাত্ম করেছে। কিন্তু, আমাদের রাজনৈতিক ডিসকোর্স আজও সীমান্তের বেড়াতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনীতির এই বোধ তার ক্ষুদ্র সীমানা ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে ব্যর্থ। তার কুফল ভোগ করছেন নেশন-স্টেটের চৌহদ্দিতে থাকা নাগরিক। বিশেষ করে সীমান্তের। আমরা আজও জন্মের ভিত্তিতে (যা দুর্ঘটনামাত্র) মানুষকে অগ্রাধিকার, বৈধতা-অবৈধতার প্রাক্-আধুনিক মাপকাঠিতে ফেলার নীতিকে আঁকড়ে। আধুনিক নেশন-স্টেটের এমন এক গভীর উদ্বেগ-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সুচিত্রার এই নিপীড়নের জন-ইতিহাস রাষ্ট্র ও তার প্রশাসনিক ভূমিকা, রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্ক, নাগরিকত্বের ধারণার নতুন মূল্যায়নের গুরুত্ব ও বিকল্প সম্ভাবনাগুলি নিয়ে ভাবার সুযোগ দিয়েছে।
পাক সীমান্তে সুচিত্রাকে বৃদ্ধ সুজ বলেছিলেন, “সীমান্ত আমাদের মনকে সঙ্কীর্ণ করেছে।” আজও যখন সেনার হাতে নিহত বাবার মৃতদেহ চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে কাশ্মীরের কিশোরী, নাগাল্যান্ডে নিমেষে ঝরে যায় তেরোটি প্রাণ, অসমে মইনুলদের নিথর দেহের উপরে পড়ে রাষ্ট্রের লাথি— প্রশ্ন জাগে। ‘ইন্ডিয়া’ কি এখনও তাঁদের দেশ হতে পেরেছে?
‘ইন্ডিয়া’ কাদের দেশ হয়েছে?