নাট্যমুহূর্ত: রক্তকরবী নাটকে তৃপ্তি মিত্র ও শোভেন মজুমদার
‘নাটক যখন পড়েন তখন আপনার কল্পনা কী ভাবে জড়িয়ে যায়’, দেবাশিস মজুমদারের এই প্রশ্নের উত্তরে থিয়েটারের কথা-র বক্তা বলেন, “নাটক পড়তে পড়তে অনেক সময়... মনে মনে উচ্চারণ করতে করতে তার স্বাদটা নেবার চেষ্টা করি… নানা সংঘাত আসে… নাটকীয়তা তৈরি হয়।” (২১) শঙ্খ ঘোষের পাঠক ফিরতে পারেন সুপুরিবনের সারি-র কিশোর নীলুর কাছে, যে মামাবাড়ির চিলেকোঠায় উপুড় হয়ে পড়ত কত নাটক; ভাবত, সিরাজউদ্দৌলা নাটকটা বইতে কত আলাদা, রেকর্ডে যা শুনেছে তার থেকে। নাটকের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের আবাল্য নৈকট্য বিছিয়ে আছে এই কথালাপে; সেই সূত্রে পাঠকের মনে পড়ে চব্বিশ বছর আগে প্রকাশিত ছোট্ট একটা স্কুল-এর ‘নিজের কাজ নিজে’, ‘আপনখুশির পড়াশোনা’, ‘ইস্কুলের নট’, ‘চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার’-এর মতো স্নিগ্ধ আখ্যানগুলি। ছোট্ট স্কুলের হেডমাস্টারমশাই মণীন্দ্রকুমার ঘোষ যে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘এ নেশন ইজ় নোন বাই ইটস স্টেজ’! ঘোষ পরিবারের ছেলেমেয়েরা ফিরে ফিরে অভিনয় করেছে মন্মথ রায়ের চাঁদ সদাগর-এ, তাদের সুন্দরকাকু দেবেন্দ্রকুমারের পরিচালনায়। মণীন্দ্রকুমারের বড় ছেলে সত্যপ্রিয় কলেজজীবনে পাঠ্য ম্যাকবেথ শুধু অনুবাদই করেননি, ভাইবোনদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন ব্যাঙ্কো-র ডাইনিং দৃশ্য। পাঠকের নাগালে এ সব ছিল ঠিকই, কিন্তু এ বইয়ের বক্তার রচনাসম্ভারের বিশাল পরিধিতে নাগালটুকু নিয়ে পাঠক হয়তো কিছুটা অনিশ্চিত ছিলেন। দেবাশিস মজুমদারের প্রশ্নের সংবেদনে এবং ‘পাঠ সহায়ক প্রসঙ্গ-তথ্য ও টীকা’-র পরিশ্রমী বিন্যাসে সে অনিশ্চয়তা অনেকখানি কেটে গেল।
নতুন কথাও আছে। ‘বহুরূপী’-র বিসর্জন দেখে সুন্দরকাকুর মনে হয়েছিল, কিছুই হয়নি— ভ্রাতুষ্পুত্রের অসহমতে তিনি কোনও গুরুত্বই দেননি। তেইশ বছরের শঙ্খ রক্তকরবী দেখে বহুরূপী দফতরে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা নাটক নিয়ে লেখা কবির প্রথম গদ্য। শঙ্খ ঘোষের অনুবাদে পিকাসোর নাটক তো এই বইতেই প্রথম গ্রন্থিত হল। ভূমিকায় দেবাশিস জানিয়েছেন, শঙ্খ ঘোষের থিয়েটার-সংলগ্ন অভিজ্ঞতা এবং আনুষঙ্গিক চিন্তা-চেতনা প্রসঙ্গে যে পঞ্চাশটি প্রশ্ন তাঁর ছিল, তার অনেকটাই অনুক্ত থেকে গেছে। ২০১৯-এর ৭ মে যে কথালাপ শুরু হয়েছিল, ২০২০-র ১৫ জানুয়ারির পর তা আর সম্ভব হয়নি। অথচ সংলাপ ফুরায়নি বক্তার— মৃত্যুর এগারো দিন আগেও বলেছেন, “আমিও তো বলতে চাই, আমারও তো বলতে ভালো লাগে।” (৮-৯) প্রকৃতির প্রতিকূলতার মুখোমুখি তাঁদের অসহায় বেদনার কথা দেবাশিস আর সুকৃতি লহরী কথালাপের সূচনায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
থিয়েটারের কথা
শঙ্খ ঘোষ, গ্রন্থক: দেবাশিস মজুমদার, লিখন সহযোগী: সুকৃতি লহরী
৬০০.০০
প্যাপিরাস
এ কথালাপের জোরের জায়গা হল, কোনও পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার অন্যায্য তাড়না এখানে নেই। রবীন্দ্রনাটকের ধরতাই কোথায় শেক্সপিয়রীয় রীতি ভেঙে বেরিয়ে আসছে, সেখানে মালিনী-র গুরুত্ব কতখানি, সে কথকতা যেমন আছে, তেমনই আছে রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চ-সম্ভাবনা যথার্থ অভিনিবেশে লক্ষ করার প্রসঙ্গে পরবর্তী নাট্যব্যক্তিত্বদের সফলতা-ব্যর্থতার কথা। শিশিরকুমারের ব্যর্থতার কথায় বক্তার বিষাদ এবং সম্মানবোধকে যেমন ছোঁয়া যায়, তেমনই শম্ভু মিত্রের সার্থক অভিনিবেশে রক্তকরবী প্রযোজনা এক নতুন যুগকে চেনাল, এ উচ্চারণও নিছক কোনও আবেগে বাঁধা পড়ে না। ১৯৬৪-র পরে শম্ভু মিত্রের সৃষ্টির চৌহদ্দিটা যে আগের মতো থাকছে না, অন্য থিয়েটারে তখন এক দিকে উৎপল দত্তের কীর্তি, অপর দিকে বাদল সরকারের পরীক্ষানিরীক্ষা, তার পর বিশিষ্ট সম্ভাবনা নিয়ে আসছেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, এ সব বিন্যাসের যুক্তিগ্রন্থি অমলিন। বাষট্টি বছরের শম্ভু মিত্রের চার অধ্যায়-এ অতীনের ভূমিকা যে অভিনেতার কোনও বিচ্যুতিকে চিহ্নিত করে না, তা প্রমাণ করতে দাদা সত্যপ্রিয়র সঙ্গে শঙ্খের প্রবল তর্কের গল্প যেমন আছে (৯৯), তেমন আছে আবৃত্তির স্বরক্ষেপে নাট্যস্বরের বাড়তি নিয়ে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে তাঁর অসহমতের প্রসঙ্গ (১০৪)। অভিনয়ে উৎপল যতটা আন্ডারটোন, শম্ভু মিত্র সর্বদা তেমন নন, একটু উচ্চকিত, যেখান থেকে ম্যানারিজ়ম তৈরি হতে পারে (৮৬), এমন অভিমতের পাশাপাশি চাঁদ বণিকের পালা-র মতো নাটক যে পঞ্চাশ বছরে বাংলায় লেখা হয়নি (১০২), এ বক্তব্যে এতটুকু ইতস্তত নেই। উৎপল দত্তের গিরিশ মানস-এর শঙ্খ ঘোষ কৃত সমালোচনা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার যত বিবরণ এ কথালাপে পাওয়া গেল, (৫৩-৫৪, ১০৫), তা তো থিয়েটারের কথা পেরিয়ে জীবনের কথায় বার বার মেশে। তাই কথালাপের পছন্দমতো পাঠ বানাতে গিয়ে পাঠক যদি বক্তার মতামতের দ্যোতনাটুকু হারিয়ে ফেলেন, তা হবে জরুরি বইটির প্রতি অবিচার, বক্তার সম্মানের প্রতি আঘাত।
বিদেশে থাকাকালীন হেলেনে হ্বাইগেল অভিনীত মাদার কারেজ দেখে মনে হয়েছিল শঙ্খ ঘোষের, নাটকের শেষে ক্রোধের বদলে স্তব্ধতা। বাংলা মঞ্চে সব দিক থেকেই একটা উচ্চকিত ব্যাপার আছে, যেটা “বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে শেষ হয়ে যাচ্ছে না। রয়ে যাচ্ছে।” (৮৬-৮৭) মঞ্চে স্তব্ধতার প্রয়োগ প্রসঙ্গে প্রশ্নোত্তরে তাঁর আরোপ আর উদ্ভাবন গ্রন্থের ‘অলীক ভবিষ্যৎ’ নিবন্ধের ‘অলীকপ্রত্যাশী’ কথাটি ফিরে ফিরে এসেছে। নীরবতার সাধনা হবে মঞ্চের অঙ্গীকার, এই স্বপ্নের লালনেই কি হ্বালটের হাসেনক্লেভার-এর ডি মেনশ্চেন/ দ্য পিপল-এর অনুবাদ করেন শঙ্খ ঘোষ— মানুষ? পূর্বোক্ত নিবন্ধেরই উক্তি ‘যে নাটকে কবিতা নেই তা নাটকও নয়’-এর সূত্রে দেবাশিস এ সাক্ষাৎকারের অন্যতম বিশিষ্ট প্রশ্নটি করেন, ‘অভিনয় কী ভাবে কবিতা হয়ে ওঠে’। এর উত্তর দীর্ঘ, যেখানে আছে “গদ্যের মধ্যে কবিতা বলতে যা বোঝায়— বাংলার নাট্যকারেরা, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া… বুঝতে পারেননি… যদি বলি… ডাকঘর নাটকটি মূলত একটি কাব্যনাট্য— অনেকেই আপত্তি করবেন। অথচ যথার্থ কাব্যনাট্য সেটি। গদ্যভাষায় কবিতা বলা।” (৯১) উত্তরও যেন কবিতা হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে জুড়ে যায় নাটকের জগৎ থেকে এলিয়টের সরে যাওয়ার প্রসঙ্গ। শূন্যতার বোধ থেকে বাদল সরকারের ফেরা সামাজিক মুক্তিবোধের দিকে, বুদ্ধদেব বসুর প্রবেশ শূন্যতার বোধের জগতে, সবেতেই ওই প্রশ্নের উত্তর বিছানো।
তবু কত কিছুই অনুক্ত রইল। ম্যাক্সমুলার ভবন প্রযোজিত এক্সপেরিমেন্টাল আন্তিগোনে (১৯৭৯) প্রসঙ্গে কত দূর যাওয়া যেত, তা অজানা রইল। আর তাঁর উত্তর থেকে তৈরি হল যে সব জিজ্ঞাসা? পেশাদার মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন প্রযোজিত না হওয়ার যে কারণ দর্শেছেন তিনি (২৮), তার সঙ্গে কি যোগ করতেন কোনও রকমফের, যদি সুযোগ পেতেন? শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিতে, যে বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে পরবর্তী নাট্যপ্রবাহের প্রবক্তায় চিহ্নিত করেছেন বাদল সরকার (৬১), দেবাশিস মজুমদার তেমন কোনও বইয়ের হদিস পাননি (১৪৪-৪৫)। স্মৃতি পরিমার্জনের ক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত শঙ্খ ঘোষ ছিলেন আশ্চর্য সজাগ। এখন তা-ও অলীক। তবু শুরুটা যে জানা গেল, তার জন্য দেবাশিস মজুমদারকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। শেষ তো অজানাই থাকে আমাদের। সব প্রশ্ন উচ্চারিত হলেও কি আর তা জানা যেত?