তপোবন: জাপানের কারুইজ়াওয়া পাহাড়ে টোকিয়োর মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের গ্রীষ্মকালীন শিবিরে (১৯১৬) বক্তৃতারত রবীন্দ্রনাথ।
১৯১২ সালে তৃতীয় বারের জন্য বিলেত যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, মার্চ মাসে যাওয়ার দিন সকালে অসুস্থতার কারণে যাত্রা স্থগিত হল। শিলাইদহের নির্জনে কিছু দিন কাটাতে চলে গেলেন। এই সময়ে নিজের লেখা গান ও কবিতা থেকে বেছে বেছে অনুবাদ করার নেশায় মেতেছিলেন। দেখতে দেখতে ‘‘একটি ছোট্ট খাতা ভরে এল। এইটি পকেটে করে নিয়ে জাহাজে চড়লুম।’’ অনুবাদের ধারা চলতে লাগল, ‘‘এক খাতা ছাপিয়ে আর এক খাতায় পৌঁছন গেল।’’ এ বারের বিদেশ যাত্রার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল অর্শ রোগের চিকিৎসা করানো আর তাঁর শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ভাবনার কথা জানানো। সেখানকার বিদ্যাজীবী সমাজের সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছেটাও ছিল। বিলেত যাত্রার আগে নির্ঝরিণী সরকারকে লিখেছিলেন, ‘‘আমি দূর দেশে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্চি। আমার সেখানে অন্য কোনো প্রয়োজন নেই— কেবল কিছু দিন থেকে আমার মন এই কথা বলচে যে, যে পৃথিবীতে জন্মেছি সেই পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে নিয়ে তবে তার কাছ থেকে বিদায় নেব।’’ নববর্ষের ভাষণ ‘যাত্রার পূর্ব পত্র’-এ জানালেন, ‘‘মানুষের জগতের সঙ্গে আমাদের এই মাঠের বিদ্যালয়ের সম্বন্ধটিকে অবারিত করিবার জন্য পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিবার প্রয়োজন অনুভব করি।’’
লন্ডনে পৌঁছে শিল্পী রদেনস্টাইনের হাতে তুলে দিলেন তাঁর অনুবাদ খাতাটি। প্রত্যাশার প্রাপ্তি ছাপিয়ে তা গড়ল অন্য ইতিহাস। লন্ডনে ‘‘মানুষের ভিড়ের মাঝখানে’’ কবির মন অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। অনুবাদ খাতাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেই রওনা হলেন আমেরিকার পথে। আরবানায় এসে কবিমন তৃপ্ত, ‘‘কোথাও কোনো গোলমাল নেই— আকাশ খোলা, আলোক অপর্য্যাপ্ত, অবকাশ অব্যাহত।… ঠিক মনে হয় যেন দেশে আছি।’’ কয়েক দিন কাটাবার পরেই স্থানীয় ইউনিটি ক্লাব থেকে উপনিষদ সম্বন্ধে বলবার জন্যে অনুরোধ এল। প্রথমে অরাজি ছিলেন, ‘‘উপনিষদের ঋষিদের প্রতি আমার কর্তব্য পালনের জন্য শেষ মুহূর্তে আমাকে রাজি হতে হল।’’ আরবানা থেকে অজিতকুমার চক্রবর্তীর চিঠির উত্তরে লিখলেন, ‘‘লিখেছ শান্তিনিকেতনের আইডিয়াগুলো ইংরেজি ভাষায় এ দেশের লোকের সামনে উপস্থিত করলে ভাল হয়। আমারও অনেকবার একথা মনে হয়েছিল যে কেবল কবিতায় আমাদের পুরো কথাটা ত এরা পাবে না— কিন্তু আমার কোনোদিন মনে হয় নি যে ইংরেজি গদ্যে এ সমস্ত কথা আমি প্রকাশ করতে পারব— . . . বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলুম।’’
শুরু হয়ে গেল রবিজীবনের আর একটি অধ্যায়, লন্ডনে ছিল পদ্যের ধারা এখানে শুরু হল গদ্যের। ভাষণ দেওয়ার জন্য অন্যদের ডাকেও সাড়া দিতে হল। আমেরিকার অন্যত্র, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আমন্ত্রণ এড়াতে পারলেন না। বিদেশে তাঁর প্রথম ভাষণগুলির সঙ্কলন সাধনা (১৯১৩) গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল। তত দিনে রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিখ্যাত কবি ও চিন্তক। বলতে গেলে সারা পৃথিবী থেকে বার বার আহ্বান এসেছে, কবি নিজেও ব্যগ্র তাঁর নতুন নতুন ভাবনাগুলি বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করতে। দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন কবি, সে জীবন প্রবাহিত হয়েছিল সারা বিশ্বের নানা ঘটনায় মানবজাতির বিবিধ উন্নতি ও জটিলতার আবর্তের ভিতর দিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার ফলাফল তো তাঁর অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির আলোয় দেখা গেলই তার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষ হিংসায় বিদ্বেষে পরস্পরের মুখোমুখি অস্ত্র হাতে দাঁড়াল তার সূচনাটাও দেখেছিলেন। ন্যাশনালিজ়ম-এর প্রবন্ধগুলোতে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবকে সতর্ক করে ক্ষুদ্রতার সীমানা অতিক্রম করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁর নিজের মতো করে উপনিষদের উপলব্ধি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন সাধনা-য়। হিবার্ট ভাষণ দেওয়ার আমন্ত্রণে মানুষের ধর্মের কথা বললেন তাঁর রিলিজিয়ন অব ম্যান-এ।
দেশে দেশে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার ধারা বহুমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল। বিশ্ব পরিক্রমার এই বিপুল ভাণ্ডারকে ইতিহাসের দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণে আত্মমগ্ন হয়েছেন রীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বাভাবিক প্রবণতাতেই তিনি পূর্ব ও পশ্চিম বিশ্বকে দুটি পৃথক সীমানায় বেঁধেছেন। বইটির প্রথম অধ্যায়ে আছে: ১. ইংল্যান্ড ২. আমেরিকা: ইউএসএ, কানাডা, দক্ষিণ আমেরিকা ৩. পশ্চিম ইউরোপ: ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ৪. মধ্য ও উত্তর ইউরোপ: জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইৎজ়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং সুইডেন ৫. রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপ: রাশিয়া, পূর্ব এবং পূর্ব-মধ্য ইউরোপ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে: জাপান, চিন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পারস্য: ইরান এবং ইরাক।
রবীন্দ্রনাথ টেগোর্স লেকচার্স অ্যাব্রড/ আ ক্রিটিক্যাল এনকাউন্টার
রীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১১৯৫.০০
সেরিবান
রবীন্দ্রনাথের জীবনী গ্রন্থগুলিতে পর্যায়ক্রমে তাঁর বিদেশ ভ্রমণ ও তাঁর ভাষণগুলির চুম্বক বা প্রাসঙ্গিক অংশ আছে, আছে সমবিষয়ে ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ। যেমন রবীন্দ্রনাথের ইতালি ভ্রমণ নিয়ে ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় অবন্তীকুমার সান্যালের প্রবন্ধ নেপথ্যবর্তী নানা মূল্যবান তথ্য উদঘাটিত করেছিল, তেমনই আরও বহু উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের বিদেশ ভ্রমণ ও প্রদত্ত ভাষণ নিয়ে বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে নানা প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের টক্স ইন চায়না (১৯২৪) অনেক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। জাপানে রবীন্দ্রনাথ যে বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন বহু কাল তাঁর কোনও সঙ্কলন প্রকাশিত হয়নি, বিবরণ বলতে ১৯১৭ সালে পেয়েছিলাম জাপান-যাত্রী, তবু বহু তথ্যই অবিদিত ছিল। কিছু কাল আগে প্রকাশিত হয়েছে টক্স ইন জাপান (২০০৭)।
আলোচ্য বইটিতে সারা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত সব ভাষণের ‘ক্রিটিক্যাল এনকাউন্টার’ লেখিকার অভিপ্রায়। বহু তথ্যের ভিড়ে সেই অভিপ্রায় কতটা সার্থক হল সে সংশয় থেকে যায়। নীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ বহু লেখকের উদ্ধৃতি সারা বইতে ছড়িয়ে আছে। সেই বাহুল্যের ভিতর থেকে রবীন্দ্রভাবনার স্বকীয়তা ও বিংশ শতাব্দীর এই কবি-মনীষীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় কিছু যে পেলাম এমন কথা বলতে পারি না। ভূমিকায় খুব যে একটা নতুন কথা আছে তাও নয়। বস্তুত নতুন কোনও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টির বিচার আছে এমন কথা মনে হল না। লেখিকা আধুনিক সভ্যতার নতুন মূল্য বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতার নবমূল্যায়ন করতে চেয়েছেন, বিষয়টি যে সম্পূর্ণ নতুন তা তো বলা যাবে না।
প্রায় সাড়ে সাতশো পাতার বইতে দু-চারটে বানান ভুল অস্বাভাবিক নয়, লজ্জা বোধ হয় যখন গ্রন্থ পরিচয়ে গ্রন্থকারের নাম ভুল থাকে, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য হয়েছেন অমিত্রসূদন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্তকুমার পাল হয়েছেন প্রশান্ত পাল (পৃ ৩৮), মেরি এম লাগো হয়েছেন মেরি লাগো (পৃ ৩৯)। দৃষ্টান্ত আর বাড়িয়ে লাভ নেই, এমন কাঁটা বিস্তর। আর একটি ত্রুটির উল্লেখ করতে হয়— সারা পৃথিবী জুড়ে ভাষণ দিলেন রবীন্দ্রনাথ আর গ্রন্থের প্রসঙ্গ সেই ভাষণগুলি, কবির ভাষণরত কয়েকটি আলোকচিত্র বইটিকে অলঙ্কৃত করতে পারত।