আ প্যানডেমিক অ্যান্ড দ্য পলিটিক্স অব লাইফ
রণবীর সমাদ্দার
৪৫০.০০
উইমেন আনলিমিটেড
আমরা অতিমারিকে চিনেছি উপন্যাসে, ছবিতে। আলব্যের কামুর দ্য প্লেগ, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী, ২০১১ সালের তৈরি ফিল্ম দ্য কন্টাজিয়ন। সে সবই দূর থেকে দেখা। সময়ের দূরত্ব বা ভৌগোলিক দূরত্ব। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে অতিমারিকে আমরা দেখছি আমাদেরই দৈনন্দিনতায়। নিশ্বাস-প্রশ্বাসে, চলাফেরায়, কথাবার্তায়, প্রতি মুহূর্তের হৃৎস্পন্দনে তাকে অনুভব করছি। আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতায় ও অনুভূতিতে অতিমারির ধারাবিবরণী তৈরি হচ্ছে, তাকে ঘিরে সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মানুষের প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণে ও ক্রিয়াকলাপে। জীববিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রতি দিন নতুন ব্যাখ্যা পাচ্ছে। প্রতি দিন তার নতুন চিত্রকল্প তৈরি হচ্ছে।
এই ধারাবিবরণী, ব্যাখ্যা, চিত্রকল্পের মধ্যে কী কোনও ছক আছে? প্রকৃতি ও সমাজবিজ্ঞানের যে সব ছকে আমরা অতিমারিকে দেখতে অভ্যস্ত, সেই ছকের মধ্যেই কি আমরা বর্তমানকেও বন্দি করতে পারি? রণবীর সমাদ্দারের বইটি সেই পথে আমাদের সহায় হতে পারে। বইটি অতিমারির প্রথম ঢেউয়ের চলার সঙ্গী হয়ে লেখা। তিনটি অধ্যায়ের প্রথমটিতে তিনি দেখাচ্ছেন, কী ভাবে অতিমারি সারা বিশ্ব জুড়ে নতুন সীমানা তৈরি করছে। যুদ্ধ, জাতি, জাত, মতাদর্শ দেশের ও সমাজের সীমানা তৈরি করে জানি; লেখক দেখাচ্ছেন, পাশাপাশি অতিমারি কী ভাবে আমাদের মানসে সীমানার নতুন ধারণা নিয়ে আসছে। অতিমারির সময়ে পশ্চিমে ব্যক্তির গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা-নির্ভর জীবনে রাষ্ট্রের সীমানা কোথায়; শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী পরিযায়ী শ্রমিক এবং হাউসিং-এ থাকা শৃঙ্খলাবদ্ধ মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমানা, শহরের স্থায়ী বাসিন্দা এবং অস্থায়ী শ্রমিকের মধ্যে সীমানা। একের পর এক উদাহরণ দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন সীমানা তৈরির প্রক্রিয়া, যার মূল চেষ্টা ছিল জনস্বাস্থ্যের নামে জনতাকেই বহিরাগত করে তোলা। পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়ি ফেরার আখ্যান এই প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। শুধু বহিরাগত করে তোলা নয়, তাদের অদৃশ্য করে তোলা, দৃশ্যে রাখা থালা-বাজানো, মোমবাতি-জ্বালানো মধ্যবিত্তকে।
অতিমারি যত এগিয়েছে, তত চারটে সঙ্কট এক সঙ্গে দেখা দিয়েছে— জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট, পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্কট, অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কট। প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কটই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও অতিমারি জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। সেটাই তার স্বভাব। রাষ্ট্র ও সমাজ কী ভাবে তার মোকাবিলা করবে, তার উপর নির্ভর করে সঙ্কটের চরিত্র ও গভীরতা। যে রাষ্ট্র তার জন্মের প্রথম ১৫ বছরে গুটি বসন্ত, কলেরা ও ম্যালেরিয়ার মোকাবিলায় অনেকটাই সাফল্য পেয়েছিল, পোলিয়ো নির্মূল করতে পেরেছিল, সেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কেন ও কী ভাবে এত বিধ্বস্ত হয়ে গেল? বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে নানা দিক থেকে এই প্রশ্নটাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন লেখক। দেখাচ্ছেন কী ভাবে নয়া উদারবাদ, ক্রূর অর্থনীতি, সমাজনীতির দুর্বল কাঠামো এবং জনস্বাস্থ্যের ধার করা মডেল দেশের কোভিড মোকাবিলাকে পঙ্গু করেছে।
এই আখ্যানের কেন্দ্রে আছে পরিযায়ী শ্রমিক। পুলিশ দিয়ে ঠেঙানো, গায়ে ডিডিটি স্প্রে করা, রাজ্যের সীমানায় আটকে দেওয়া, ‘কোনও পরিযায়ী শ্রমিক রাস্তায় নেই’ বলে সরকারের হলফনামা, ‘খাবার তো দেওয়া হচ্ছে তাহলে আবার পয়সার কী দরকার’ বলে সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, পরিযায়ী শ্রমিকের অনুপস্থিত পরিসংখ্যান— এক দিকের ছবি। অন্য দিকে, ‘হাসপাতাল নয়, ঘরে নিভৃতবাসে থাকুন’, ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন’, ‘পরিযায়ী শ্রমিকরাই কোভিড ছড়িয়েছে’, কিংবা ‘কোভিড ছড়ালে গোষ্ঠীগত প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে, বয়স্করা তো এমনিতেই মৃত্যুপথযাত্রী’ ধরনের ডারউইন-প্রভাবিত তত্ত্বকে লেখক নিপুণ ভাবে আলাদা করে চিনিয়েছেন। দেখিয়েছেন, কী ভাবে কোভিড মোকাবিলার প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কটের মূলে আছে নয়া উদারবাদ ও সামাজিক ডারউইনবাদ।
তৃতীয় অধ্যায়ে এসে দেখছি লেখক এই সর্বাঙ্গীণ সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে— যেখানে জনতার রাজনীতি তৈরি হয় প্রতিনিধিদের ভাবনায়, আচরণে, সিদ্ধান্তে ও নীতিতে— গন্ডগোল কি সেখানেই? প্রতিনিধিদের মুখ যেখানে জনতার মুখের বিকল্প, যেখানে রাজনীতি প্রতিনিধিদের হাতে সমর্পিত, লেখক মনে করছেন যে, সেখানে প্রতিনিধিরা তাদের মতো করে জনতার চিত্রকল্প তৈরি করে। প্রতিনিধিদের তৈরি জনতার এই রূপকে লেখক নাম দিয়েছেন ‘উপর থেকে চাপানো বায়ো-পলিটিক্স’। যে ‘পাবলিক’-এর ধারণা আমরা পশ্চিমি আলোকায়ন থেকে পেয়েছি, নয়া উদারবাদ আর উপর থেকে চাপানো বায়ো-পলিটিক্স’এর প্রভাবে সেই পাবলিক এখন শৃঙ্খলিত, বিনত, পরিশোধিত জনতা, আমাদের চিরচেনা জনতা নয়। জনতা তাই নিজেদের রাজনীতি নিজেরা খুঁজছে, যাকে লেখক বলেছেন নীচ থেকে উঠে আসা বায়ো-পলিটিক্স, নাম দিয়েছেন ‘জীবনের রাজনীতি’। জনতার একাংশ প্রতিনিধিত্বমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্যে রাজনীতির উদ্দেশ্য-বিধেয় না খুঁজে নিজেরাই গোষ্ঠীগত ও সম্মিলিত ভাবে জীবনের নিজস্ব রাজনীতি নির্মাণের চেষ্টা করছে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এই রাজনীতির একটা স্পষ্ট রূপ দেখা যাচ্ছে, যার ভিত্তি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা, দ্বন্দ্ব নয়; যার সাফল্য বাজেটের টাকা, অতিমারির পরিসংখ্যান আর পাওয়ার-পয়েন্ট দিয়ে মাপা যাবে না, মাপা যাবে কত ব্যক্তি সহমর্মিতার মধ্যে জীবনের মানে খুঁজতে এগিয়ে এসেছেন।
রণবীরের বইটি তাত্ত্বিকদের জন্য, কারণ প্রতিনিধিদের তৈরি নয়া-উদারবাদ, সামাজিক ডারউইনবাদ আর ক্রূর অর্থনীতি-সমাজনীতির বাইরে জীবনের রাজনীতির নতুন তত্ত্বের আজ বড়ই প্রয়োজন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে পৌঁছে এ প্রশ্ন আরও বেশি করে উঠছে। প্রশ্নটা এখন নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রকে নিয়ে নয়, ফৌজদারি রাষ্ট্রকে নিয়ে, যে রাষ্ট্রের মূল অঙ্গটি আমাদেরই প্রতিনিধিত্বে তৈরি। দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে দেখছি, সীমানা তৈরির প্রকল্প এখন ভ্যাকসিন, অক্সিজেন, ওষুধে ছড়িয়ে গিয়েছে; কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা, অর্থ, শাসনের সীমানা তো আগে থেকে ছিলই, এখন তা আন্তর্জাতিক সীমানার চেহারা নিয়েছে।
নতুন রাজনীতির যে ক’টি ইঙ্গিত এই সময়ে পাচ্ছি, তার মূলে আছে স্থানীয় ও অ-স্থানীয় স্তরে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা— অনেকটাই স্বায়ত্তশাসিত। দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের পুঁজির থেকে জনতার পুঁজি অনেক বেশি উদার, মানবিক, কল্যাণকামী, দক্ষ ও সেকুলার। এটা এক নতুন বাস্তবতা। লেখক ইঙ্গিত করেছেন, বামপন্থী ভাবনায় এই বাস্তবতা নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক কাজ কম হয়েছে। কথাটা ঠিক। কিন্তু প্রশ্নটা কি নতুন? প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ও জনবাদী রাজনীতির বাইরে থেকে সরাসরি জীবনের রাজনীতির জোরে রাষ্ট্রতন্ত্রকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করার কাজটা নতুন নয়, গত ৩০ বছরে বহু গণ-আন্দোলন তা প্রমাণ করেছে— জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, কৃষির পরিসরে, জমির অধিকারের জগতে, নারী অধিকারের বিষয়ে; সাফাই কর্মচারী, জঙ্গলবাসী, যৌনকর্মী, পরিবেশকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার নতুন আদর্শ উপহার দিয়েছে। এ সবই জনগণের নিজস্ব বৌদ্ধিক ও সামাজিক পুঁজি থেকে এসেছে, রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক ও আর্থিক পুঁজি থেকে নয়। কোন পুঁজিতে বেশি বিনিয়োগের দরকার ও কী ভাবে, সে আলোচনা ফের বিস্তৃত আকারে শুরু হোক।