book review

Book Review: ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিল যে ‘পশ্চিম’

বেসান্তকে বলা যায়   বইটির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিন-চতুর্থাংশ আইরিশ পরিচয়ের ইংরেজ তিনি, আদ্যন্ত রাজনৈতিক বোধে প্রাণিত সাম্রাজ্যবিরোধী।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২২ ০৪:৪১
Share:

প্রতীকী ছবি।

আমাদের কবি বলেছিলেন, এ কলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কলকাতা। আর আমাদের ইতিহাস বলছে, ওই পশ্চিমের মধ্যে আছে আর এক পশ্চিম। সাম্রাজ্যবাদের খরসূর্যালোকে দাঁড়িয়েও সেই আধো-চেনা পশ্চিম সভ্যতার দিকে কী ভাবে তাকানো উচিত, শেখায় রামচন্দ্র গুহর এই বই। আমরা যখন কেবলই শুনছি ওরা বনাম আমরা, পুব বনাম পশ্চিম, ভারত বনাম বিদেশ— সেই সময়ে এই বই তুলে ধরে সেই মানুষগুলিকে, যাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রকমসকম, বিশেষ করে ভারতের ‘ব্রিটিশ রাজ’-এর ধরনধারণ দেখে দিক পাল্টে ফেলে ‘রাজ’-এর সমালোচক, এমনকি শত্রু হয়ে উঠেছিলেন, উপনিবেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। অ্যানি বেসান্ত বলেছিলেন, ভারতের মানুষ খারাপ-ইংরেজদের চেনেন, কিন্তু যে ইংরেজরা উদার আদর্শে বিশ্বাস করেন, অত্যাচারিতের জন্য সাহসে ভর করে ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন, তাঁদেরকেও ভারতের চেনা দরকার। প্রথমেই স্পষ্ট করে দেন রামচন্দ্র গুহ, তাঁর আলোচ্য ব্যক্তিরা কিন্তু ডালরিম্পল-এর ‘হোয়াইট মুঘলস’ নন, তাঁরা কোনও ব্যক্তিগত পাওনাগন্ডার হিসাবে কলোনিতে থেকে যাননি। এই বইয়ের চরিত্ররা সকলেই আদর্শ-উদ্বুদ্ধ প্রতিরোধী প্রতিস্পর্ধী— যাঁরা সাম্রাজ্যের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাম্রাজ্য-যুগে বসেই।

Advertisement

অ্যানি বেসান্তকে বলা যায় বইটির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিন-চতুর্থাংশ আইরিশ পরিচয়ের ইংরেজ তিনি, আদ্যন্ত রাজনৈতিক বোধে প্রাণিত সাম্রাজ্যবিরোধী। ভারতকে নিজের (দ্বিতীয়?) মাতৃভূমি করে নিয়েছিলেন তিনি। নতুন মাতৃভূমির জন্য ভারতীয় কংগ্রেসকে তৈরি করার ব্রতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ‘দ্য ডিপেস্ট, গ্রেভেস্ট রং দ্যাট গ্রেট ব্রিটেন হ্যাজ় ইনফ্লিক্টেড অন আ ওয়ান্স মাইটি অ্যান্ড ইম্পিরিয়াল রেস’-এর বিষয়ে বিশ্বকে অবহিত করার কাজটা নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন। ভারতের হোমরুল অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, এবং, অবধারিত ভাবে, গ্রেফতার হয়েছিলেন। এমন এক সময় ছিল যখন সারা ভারতের রাজনীতি যেন তাঁর সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, শ্রদ্ধায়, সম্ভ্রমে। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হলেন বেসান্ত, ১৯১৭ সালে। এ সব তথ্য আমরা মোটামুটি জানি। কিন্তু রামচন্দ্র গুহ যে কাজটা সবচেয়ে ভাল করতে পারেন, এখানেও তা-ই করেছেন: গোটা তিনেক অধ্যায় ধরে এই অসামান্য নারীর জীবনের ছবিটা চমৎকার ভাবে এঁকে দিয়েছেন।

বি জি হর্নিম্যান-এর আ ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন অ্যানি বেসান্ত: “ওয়ান অব দোজ় অল টু ফিউ ‌ইংলিশমেন হু ক্যারি দেয়ার ব্রিটিশ প্রিন্সিপলস উইথ দেম হোয়েন দে কাম টু ইন্ডিয়া।” কী সেই ‘প্রিন্সিপলস’? লিবার্টি অব স্পিচ, অব পার্সন, অব দ্য প্রেস: ইংল্যান্ডের মাটিতে যে সব বস্তু ‘টেকন ফর গ্রান্টেড’, আর ভারতে যার জন্য শাসকের দয়ার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকতে হয়। লিবারাল আদর্শের কথা অনবরত বলে গিয়েছেন হর্নিম্যান, যদিও তাঁর অবস্থান ছিল— সাম্রাজ্যবিরোধিতা নয়— দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সাম্রাজ্যশাসকদের কাজ। এ কথা বলার অপরাধেই তাঁকে ভারত থেকে ‘ডিপোর্ট’ করা হয়েছিল ১৯১৯ সালে। অভিযোগ: তিনি ‘হেট্রেড অ্যান্ড কনটেম্পট (এগেনস্ট) দ্য গভর্নমেন্ট এস্টাবলিশড বাই ল ইন ইন্ডিয়া’ ছড়াচ্ছেন।

Advertisement

রেবেলস এগেন্সট দ্য রাজ: ওয়েস্টার্ন ফাইটারস ফর ইন্ডিয়া’জ় ফ্রিডম

রামচন্দ্র গুহ

৭৯৯.০০

পেঙ্গুইন ও অ্যালেন লেন

স্যামুয়েল এভান্স স্টোকস আমেরিকা থেকে বিশ শতকের প্রথম দশকে ভারতে এসে পৌঁছেছিলেন, ‘দ্য ল্যান্ড অব মাই অ্যাডপশন’-এ। সাদা মানুষের ভাবনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়ানো জাতিবিদ্বেষ: মনে হত তাঁর। ১৯১৩ সালে ‘ইন্ডিয়া অব দ্য ফিউচার’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন ভারতের অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা, যে অর্থনীতি কেবল পশ্চিমের সঙ্গে টেক্কা দেবে না, কিন্তু ভারতের গ্রাম-শহরের গরিব মানুষকে নতুন জীবনের আশা দেখাবে। স্বভাবতই গান্ধীর সঙ্গে বিশেষ মতৈক্য হয় তাঁর, ঘনিষ্ঠতাও। এলাহাবাদে দু’জনে ১৯২১ সালে কংগ্রেসের সভা করেন। সেখানে ঝরঝরে হিন্দিতে নিজের বক্তব্য বলেন স্টোকস। “মি. স্টোকস ইজ় আ কনভিন্সড নন-কোঅপারেটর অ্যান্ড কংগ্রেসম্যান, নো ইন্ডিয়ান ইজ় গিভিং সাচ ব্যাটল টু দ্য গভর্নমেন্ট অ্যাজ় মি. স্টোকস,” এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন গান্ধী।

ভগিনী নিবেদিতা যেমন এসেছিলেন বিবেকানন্দের টানে, মেডলিন স্লেড তেমনই ভারতে চলে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর আশ্রমে থাকার বাসনায়। সেটা ১৯২৫। ‘মীরা’ পরবর্তী কালে গান্ধীর কত বড় ভরসার কন্যা হয়ে উঠবেন, সে আমাদের জানা কাহিনি। যখন ইয়েরওয়াড়া জেলে বন্দি গান্ধীকে কোনও ভারতীয় পুরুষ বা মহিলা দেখতে যাওয়ার অধিকার নাকচ করে সরকারি আদেশ হল ১৯৩২-এ, তার মধ্যে নেহরু, পটেল, সরোজিনী প্রমুখের সঙ্গে মীরার নামও রইল। আর প্রসন্ন মীরা একটি চিঠিতে লিখলেন, “আই অ্যাম হ্যাপি টু গেট মাই ফুল শেয়ার অ্যাজ় অ্যান ইন্ডিয়ান!”

আরও অনেকের কথা এই বইতে, অনেক গল্প। সব এই পরিসরে বলা যায় না। কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেন-এর সক্রিয় সদস্য ফিলিপ স্প্যাট-এর কাহিনি যে ভাবে বলেন রামচন্দ্র গুহ, সেও এই বইয়ের আর এক সম্পদ।

আশ্চর্য লিখনকৌশলে বইয়ের অনেক চরিত্রকেই তিনি প্রথমে এক অধ্যায়ে আলাপ করিয়ে দেন, তার পর বইয়ের দ্বিতীয়াংশে আবার ফিরিয়ে আনেন তাঁদের জীবনের পরবর্তী কালের ভারতসংযোগের ঘটনাবলি। খুবই বিশেষ বলতে হবে পদ্ধতিটিকে। থিম, ব্যক্তি ও চলমান সময়কাল— এই তিনকে ধরে কী ভাবে এগোনো যায়, যে কোনও ইতিহাসগ্রন্থ-রচয়িতার কাছেই সে এক বিশেষ বিবেচনার বিষয়। এটুকু বলা যেতে পারে, রামচন্দ্র গুহ’র এই বইয়ের লিখনপদ্ধতি যে সমাধানসূত্রটি এগিয়ে দিল, তা একাধারে চিত্তাকর্ষক, পাঠক-সহায়ক, এবং অবশ্যই, দুর্লভ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement