পুস্তক পরিচয়

অন্তরঙ্গ জীবনকথার খোঁজে

বোম্বাইয়ের মোঢ় বানিয়াদের যিনি মাথা, সেই শেঠ ডাকলেন জরুরি সভা। জানিয়ে দিলেন, সমাজ তাঁর লন্ডনযাত্রা সমর্থন করছে না। গাঁধীও স্পষ্ট বললেন, তিনি মত বদলাবেন না। এ রকম ব্যাপারে জাত বা সমাজের হাত দেওয়া ঠিক নয়।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৩২
Share:

গাঁধী/ অ্যান ইলাসট্রেটেড বায়োগ্রাফি
প্রমোদ কপূর
৯৯৫.০০, রোলি বুকস

Advertisement

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ছিলেন গুজরাতের রক্ষণশীল মোঢ় বানিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে মা-কে রাজি করিয়ে ফেললেও জাতভাইদের মন পাননি তিনি। বোম্বাইয়ের মোঢ় বানিয়াদের যিনি মাথা, সেই শেঠ ডাকলেন জরুরি সভা। জানিয়ে দিলেন, সমাজ তাঁর লন্ডনযাত্রা সমর্থন করছে না। গাঁধীও স্পষ্ট বললেন, তিনি মত বদলাবেন না। এ রকম ব্যাপারে জাত বা সমাজের হাত দেওয়া ঠিক নয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জাতিচ্যুত করা হল এবং সমাজের কেউ তাঁকে সাহায্য করলে তাঁরও পাঁচ সিকে জরিমানা ধার্য হল। জাতিচ্যুত গাঁধী ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ লন্ডন যাত্রা করলেন, তাঁর বয়েস তখনও পুরো আঠেরো হয়নি। অবশ্য ১৮৯১ সালে তিনি যখন ভারতে ফিরে আসেন, তখন এই সামাজিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

৬ নভেম্বর ১৯১৩ ট্রান্সভালের পথে দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহীদের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হল গাঁধীজির নেতৃত্বে। চার দিনের মধ্যে তিন বার গ্রেফতার হলেন গাঁধী। এই সময়েই ডারবানে এক জনসভায় তিনি পশ্চিমি পোশাক ত্যাগ করলেন, আর কখনও তা পরেননি।

Advertisement

১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে চম্পারনের এক নীলচাষি রাজকুমার শুক্ল কংগ্রেস নেতাদের জনে-জনে বলছিলেন সেখানকার চাষিদের দুর্দশার কথা। কেউ বিশেষ পাত্তা দেননি তাঁকে, এমনকি গাঁধীও। শুক্ল ছাড়বার পাত্র নন, লেগে থাকলেন গাঁধীজির সঙ্গে। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, শুক্লও সেখানে। একটাই অনুরোধ, এক বার চলুন চম্পারন। শেষে খানিকটা উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতোই গাঁধীজি রাজি হলেন। ভাগ্যিস হলেন, সৃষ্টি হল স্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন অধ্যায়।

মহাত্মা: সত্যাগ্রহী গাঁধী ও কস্তুরবা। দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯১৩।

আন্দোলনের নানা পর্যায়ে গাঁধীজির অনুগামী হয়েছেন বহু মহিলা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবী চৌধুরানীও। লাহৌরে তাঁর অতিথি হয়েছিলেন গাঁধী, সরলার স্বামী রামভুজ দত্ত চৌধুরী তখন কারাগারে। ক্রমে দু’জনের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে গাঁধী সরলাকে তাঁর ‘স্পিরিচুয়াল ওয়াইফ’ আখ্যা দেন। শেষে অবশ্য গাঁধীই সরে আসেন।

কলকাতার হায়দরি মঞ্জিলে গাঁধী ও মনুবেন, ১৯৪৭। বই থেকে

এমন সব টুকরো টুকরো ঘটনা দিয়েই প্রমোদ কপূর সাজিয়েছেন তাঁর সচিত্র গাঁধীজীবনী। কালানুক্রম বজায় রেখেছেন, কিন্তু টানা বিবরণী লেখেননি। আসলে ব্যক্তি গাঁধী ও জননায়ক গাঁধীর সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক জটিলতাকে অন্তরঙ্গ চরিত্রায়ণে খুঁজতে চেয়েছেন প্রমোদ। গাঁধীর জীবনী তো অনেক লেখা হয়েছে, আর নতুন কী বলা যাবে? প্রমোদের আশা, অন্তরঙ্গ মানুষটিকে যদি তুলে আনা যায়, তা হলে অন্তত নতুন ভাবে দেখার সুযোগ তৈরি হবে। বড় বড় ঘটনার ছায়ায় ছোট ছোট ঘটনা, বড় ইতিহাসের পাশাপাশি ছোট ইতিহাস তিরতির করে বয়ে যায় ফল্গুধারার মতো, অনেক সময়েই অন্তঃসলিলা। তাকে খুঁজে পাওয়া কি সহজ কাজ? এ জন্য প্রমোদ অবশ্য নির্ভর করেছেন পরিচিত বইগুলির উপরেই। তা থেকেই তুলে এনেছেন নানা ঘটনা। কোথাও কোথাও আর একটু গভীরে ঢুকতে চেয়েছেন— যেমন বড় ছেলে হরিলালের সঙ্গে সম্পর্ক, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মতবিরোধের প্রসঙ্গ, অনুগামী মহিলাদের পরিচিতি, ইত্যাদি। সাহায্য নিয়েছেন ছবির, স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করেছেন কাহিনি থেকে ছবিতে, আবার ছবি থেকে বয়ানে। স্বাভাবিক ভাবেই, ১৯৫১-র লুই ফিশার থেকে শুরু করে আজকের রাজমোহন গাঁধী কি রামচন্দ্র গুহের জীবনীগ্রন্থ (গাঁধী বিফোর ইন্ডিয়া) যাঁদের পড়া, তাঁদের কাছে তথ্যের দিকে চমকপ্রদ তেমন কিছু আলোচ্য বইয়ে নেই। মূলত বিঠলভাই জাভেরি ও কানু গাঁধীর সংগ্রহ থেকে পিটার রুহে-র তিনশো ছবির সঙ্কলন (গাঁধী), জেরাল্ড গোল্ড-এর চিত্রজীবনী ইত্যাদিতে নজরে পড়বে অনেক দুর্লভ ছবিও। তবু নতুন প্রজন্মের কাছে এর অনেক কিছুই অপরিচিত ঠেকতে পারে, তাঁদের কথা ভেবেই প্রমোদ যত্ন করে সংগ্রহটি তৈরি করেছেন। এটুকু বলা যায়, দুর্লভ ছবি আর কাহিনি গ্রন্থনায় তাঁর কৃতিত্ব অনেকটাই।

গাঁধীজি চেয়েছিলেন তাঁর জীবনটা যেন সবার কাছে খোলা বইয়ের মতো থাকে। সাধারণের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গ ভাবে মিশতেন, জনপরিসরে তাঁর ভূমিকা সুপরিজ্ঞাত। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নথিবদ্ধ হয়েছে নানা সূত্রে, বিশ্লেষিত হয়েছে এবং আজও হয়ে চলেছে শতাধিক বছর ধরে। কিন্তু ব্যক্তিমানুষ গাঁধীর সব দিক আজও আলোকিত নয়, হয়তো কোনও দিনই তা হবে না। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত তাঁকে অনেকটা পাই তাঁর আত্মকথায়। পরের তিন দশক গাঁধীর তথা জাতির জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনা-পরম্পরার কার্যকারণ বুঝতে হলে তাঁকে বোঝা নিতান্ত জরুরি। একমাত্র পরিবারের সদস্য আর ঘনিষ্ঠ জনের বিবরণ বা তাঁদের সংরক্ষিত নথিপত্র থেকেই ব্যক্তি গাঁধীর পরিচয় উঠে আসতে পারে। তার অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, বাকিটা সহজলভ্য নয়। যেমন প্রমোদ কপূর যখন তাঁর বইটির জন্য তথ্য সংগ্রহে নামেন, তখনও গাঁধীর ব্যক্তিগত সচিব পিয়ারেলালের ব্যক্তিগত কাগজপত্রের বিপুল সম্ভার সবার জন্য পুরো উন্মুক্ত হয়নি। বর্তমানে নেহরু স্মারক সংগ্রহালয় তা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, এবং রামচন্দ্র গুহ তাঁর গাঁধীজীবনীর সাম্প্রতিক খণ্ডটির জন্য এই নথিসংগ্রহের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন। ফলে প্রমোদ যে খুব অজানা তথ্য দিতে পারেননি তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

তবে ছবির উপর যখন এতটাই জোর দিয়েছেন প্রমোদ, তখন তাঁর কাছে আর একটি বিষয় প্রত্যাশিত ছিল। তিনি এত ছবি ব্যবহার করেছেন, কোনও ছবিতেই আলোকচিত্রীর নাম নেই। বইয়ের পিছনে স্বীকৃতির দীর্ঘ তালিকায় সিংহভাগ জায়গা অধিকার করেছে বাণিজ্যিক চিত্র-সরবরাহকারী সংস্থা। অথচ জীবনের শেষ দশকে গাঁধীজির সব থেকে অন্তরঙ্গ ছবিগুলি যাঁর তোলা, সেই ‘বাপুর হনুমান’ নামে পরিচিত কানু গাঁধী তো এখন অন্তত আর ততটা অজ্ঞাত নন। পিটার রুহে-র বইটির ভারতীয় সংস্করণ প্রমোদের সংস্থা রোলি বুক্‌সই প্রকাশ করেছিল, সেখানে কানু গাঁধীর তোলা ছবি তো অনেক। কয়েক বছর আগে প্রশান্ত পাঞ্জিয়ার কানুর ছবিগুলি নিয়ে বিভিন্ন শহরে প্রদর্শনীর সঙ্গে কানুজ় গাঁধী (নজ়র ফাউন্ডেশন) শীর্ষকে একটি চমৎকার অ্যালবামও প্রকাশ করেন, যেখানে কানু গাঁধীর তোলা ৯২টি ছবি আছে। আলোচ্য বইয়ের গ্রন্থপঞ্জিতে এই দুটি বই-ই অনুপস্থিত। এখানে সীমান্ত গাঁধীর দেশে গাঁধীজির সফর, কস্তুরবা’র প্রয়াণের পর শোকস্তব্ধ গাঁধীজি ইত্যাদির মতো কানু গাঁধীর অনেক বিখ্যাত ছবিই স্বীকৃতিহীন ভাবে ঠাঁই পেয়েছে। অন্তরঙ্গ সচিত্র জীবনীতে অবহেলিত থেকে গেলেন সব থেকে অন্তরঙ্গ আলোকচিত্রীই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement