প্রতীকী ছবি।
রোগশয্যায় শায়িত এক বৃদ্ধ, তাঁর স্মৃতিবিভ্রম ঘটছে। ছেলেকে মনে করছেন তাঁর ফেলে আসা পূর্ববঙ্গের ভিটের বন্ধু, সেই বন্ধু যার বাঁশির সুর আর এক বার শোনার জন্য আকুলতা থেকে গেল আক্ষরিক অর্থেই আজীবন। “তোর বাঁশিতে পান্নাবাবুর ঢঙ। একটু সারঙ বাজাবি... নে ধর। ছেলেরা আসার আগে তোর সঙ্গে গল্পগুলো সেরে নিই।” ছেলে গান শোনায় বাবাকে, বাবা ভেবে নেন, বাঁশিই বাজছে বুঝি। বইয়ের শুরুতেই শেষ হয় একটা যাত্রা। যাঁর নামে বইয়ের নাম রেখেছেন লেখক, সেই জাহ্নবীরঞ্জন মিশ্রের— লেখকের পিতার যাত্রা।
এক অর্থে এ বই পিতৃতর্পণ। কিন্তু, সেটুকুই নয়। দেবজ্যোতি যা লিখেছেন, তা একটা সময়ের গল্প, আবার এক স্থানিক ইতিহাসও বটে। অন্য দিকে আবার একটা সাঙ্গীতিক যাত্রার পাশাপাশি বারে বারে ফিরতে চাওয়া অসেতুসম্ভব এক অতীতে, যাকে বিচ্ছিন্ন করেছে রাজনীতির কাঁটাতার। বেশ কয়েকটা ধারায় এই বইয়ের আখ্যান চলতে থাকে, মিশে যায় একে অপরের সঙ্গে, ফের পৃথক ধারায় প্রবাহিত হয়। এই বইয়ের স্থানিক বিন্দুটি কলকাতার দক্ষিণ উপকণ্ঠে টালিগঞ্জের উদ্বাস্তু কলোনি, যেখানে টানাটানির সংসারে উপচে পড়ে সুর। তাঁদের কলোনির ঘরের রেডিয়োতে বাজত মোৎজ়ার্ট— “এখন ভাবতে বসলে মনে হয়, কেউ কল্পনা করতে পারবে যে সেই অস্ট্রিয়া থেকে, সুদূর অস্ট্রিয়া থেকে টালিগঞ্জের বিজয়গড় কলোনিতে, টালিগঞ্জ চণ্ডীতলার একটা কলোনিতে... মোৎজার্ট বাজছে।” অবশ্য, সেই ঘরেই বাজত আবদুল করিম খাঁ-র ‘যমুনা কে তীর’-ও। পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মৈনাক বিশ্বাসের স্থানীয় সংবাদ ছবির দৃশ্য, সন্ধে নামা কলোনির ঘর থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেওয়াজের সুর। মনে হয়, উচ্চবর্ণ ও পূর্ববঙ্গে মোটের উপর সম্পন্ন মানুষদের বর্তমান দারিদ্র ও ‘স্ট্রাগল’-এর প্রত্যক্ষদর্শী উদ্বাস্তু কলোনির পরিসরের বাইরে এমন যাত্রা মুশকিল, যেখানে চাকরি-খোয়ানো বাবা রাস্তার এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে অন্য ল্যাম্পপোস্টের দূরত্বকে অনায়াসে ভেবে নিতে পারতেন মিউজ়িকের এক-একটা বার।
সময়ের গল্পও বটে। ঠাকুমার সঙ্গে রাতের কীর্তনের আসর, আর বাবার সঙ্গে চিনতে শেখা কী ভাবে সলিল চৌধুরী মোৎজ়ার্টের ৪০তম সিম্ফনি থেকে গ্রহণ করেন বারে বারে, অথচ নিজের মতো করে— কখনও ‘ইতনা না মুঝসে তু প্যার বাড়হা’-য় পাল্টে দেওয়া সমে, আবার কখনও ‘যদি নাম ধরে তারে ডাকো’-তে ব্যবহৃত মিড়ে— এটাও ঘটতে পারে সময়ের একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতেই। সলিল চৌধুরীর কথা ফিরে ফিরেই আসে এই বইয়ে। দেবজ্যোতি তাঁকেও পিতারই মর্যাদা দিয়েছেন, ফলে এ বই তাঁরও তর্পণ। ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ গানটার চলন সম্বন্ধে লিখেছেন দেবজ্যোতি— “বার বার সা থেকে রে, রে থেকে গা এইভাবে এগোচ্ছে। কিন্তু পিছনের একটা note নিয়ে এগোচ্ছে। এই এক পা, এক পা করে পেছনের একটা note-কে নিয়ে এগোনো— যেন পেছনের সঙ্গীকে সঙ্গে করে নিয়ে এগোবো।” এই গান, এবং পিছিয়ে পড়া সহযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার দায়বদ্ধতা, তাও কি একটা বিশেষ সময়ের চিহ্ন বহন করে না সর্বাঙ্গে?
একদা জাহ্নবী তীরে
দেবজ্যোতি মিশ্র
৫৫০.০০
রাবণ
এই বইয়ের লেখাগুলি দু’টি পর্বে বিন্যস্ত— প্রথম পর্বটির নামেই বইটির নাম; আর দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘গানের ওপারে’। দুই পর্বের লেখাগুলিকে এক সূত্রে বেঁধেছে সুর। জাহ্নবীরঞ্জন ও তাঁর স্ত্রী গৌরী পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু। এই বিশ্বের ইতিহাস জানে, প্রত্যেক উদ্বাস্তুই বুকের মধ্যে বহন করেন এক অনতিক্রম্য বিচ্ছেদ। যে যাঁর ভাষায় প্রকাশ করেন সেই অপূরণীয় ক্ষতির কথা, অথবা প্রকাশ করেন না, বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখেন আমৃত্যু। জাহ্নবীরঞ্জন বলতেন একটা বাঁশির কথা, যাতে একটা কোমল ‘নি’ ছিল। সেই বাঁশিটা ‘ফোর্সের লোকেরা’ ভেঙে দিয়ে যায়, তাই তাকে আর এ পারে নিয়ে আসা হয়নি। “আমার কোমল ‘নি’ ওইপাড়ে রইয়্যা গেলো।” “কোমল-‘নি’টা রাইখ্যা আইলাম। তারপরে বুঝলা তারপরে এইখানে তেমন আর কোমল-‘নি’ লাগে নি।” উদ্বাস্তু মানুষ জানেন, তাঁদের জীবনের কোনও না কোনও একটা সুর পূর্বাশ্রমে ফেলে আসতেই হয়, পরবর্তী জীবন কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে চায় না সেই সুরটা না থাকায়। পরিবারের পরিসরে এই অপূর্ণতার অনুভূতির কথা বারে বারেই এনেছেন দেবজ্যোতি।
তেমনই বিচ্ছিন্নতার আখ্যান জানেন ভাচাগান থাদেভোশিয়ানও। তিনি আর্মেনিয়ার মানুষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দ্বন্দ্বে জীর্ণ দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন এই কলকাতায়। ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার পেশাদার বাজিয়ে। ভাচাগান বাজান ‘দুদুক’ নামে এক যন্ত্র। তিন হাজার বছরের পুরনো আর্মেনিয়ান বাঁশি। সেই বাঁশিতে বিষাদ ছাড়া অন্য সুর ফোটে না তেমন। অথবা হামিস হুসেন— কলকাতার এক ইহুদি পরিবারের ছেলে, গ্র্যান্ড হোটেলে পিয়ানো বাজাতেন তিনি, এখন প্যারিস প্রবাসী। এই বইয়ে তাঁদের কথা আছে। তাঁরা নিজেদের সুর নিয়ে জন্মভিটে ছেড়ে চলে যান অনেক দূরে। সব সুর নিয়ে যেতে পারেন কি?পারা যায়?
তবু সুর নিত্যধারা। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে, উড়নচণ্ডী স্বামীর খামখেয়ালিপনা সত্ত্বেও কী ভাবে সংসার বেয়ে নিয়ে যেতে হয় কোনও চড়ায় ঠেকে না গিয়েই, বাঙালি সেই আশ্চর্য ম্যাজিক নিজেদের জীবনে দেখেছে বহু বার। দেবজ্যোতিও দেখেছেন। এই বইয়ের আর একটি প্রবাহ সেই আটপৌরে সংসারযাত্রায়, তাঁর মা গৌরী দেবীর কথা। অল্প কথায়, ব্যক্তিগত কথায় এক সমষ্টিগত কাহিনি শুনিয়েছেন। রাগ করে একাধিক বার দাদার বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, ফিরেও আসতেন সেই সংসারেই। “নতুন শুরুর স্বপ্ন নিয়ে, আমাদের পুরোনো বাড়িতেই।” তানপুরার মতো সুর ধরে রাখার মানুষ ছিল বলেই বোধ হয় খামখেয়ালির সংসারও শেষ অবধি সুরেই বাজত।