ঠ্যালার নাম বাবাজি। কখনও কি ভেবেছি ভাইরাস আমার মনের মধ্যে এতটা জায়গা নিয়ে বসে থাকবে? দেখা যায় না, ছোঁওয়া যায় না, ঘ্রাণে ধরা পড়ে না, এমন এক অর্ধ-প্রাণী, যা অন্যের শরীরে না প্রবেশ করলে নিজের ‘প্রজনন’ পর্যন্ত করতে পারে না, তাকে নিয়ে ভাবব? কিন্তু এখন এই রকমই একটি অর্ধ-প্রাণী, নোভেল করোনাভাইরাস বিশ্বায়িত ধনতন্ত্রের চাকা বন্ধ করার উপক্রম করেছে, মানুষের অবস্থাও তথৈবচ। ফলে ভাবলাম ‘শত্রু’-কে জানি। ভাইরাস, ভাইরাস আবিষ্কারের ইতিহাস, ভাইরাসের নিজস্ব ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে একটু পড়তে শুরু করলাম।
আমি যে হেতু ডাক্তার বা বিজ্ঞানী নই, তাই সাধারণ শিক্ষিত মানুষের জন্য লেখা বই পড়তে গিয়ে প্রথমেই যে কয়টি বই হাতে এল, তার মধ্যে ডেভিড কোয়ামেন সাহেবের ‘স্পিলওভার: অ্যানিমাল ইনফেকশন্্স অ্যান্ড দ্য নেক্সট হিউম্যান প্যানডেমিক’ বেশ মনোগ্রাহী ও সুখপাঠ্য। বইটির বিষয়— এক জন্তু বা পাখির শরীর থেকে জীবাণু যখন অন্য জন্তুর (এখানে মনুষ্য নামক জন্তুটির কথাই বেশি আছে) শরীরে গিয়ে বিভ্রাট বাধায়, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘জ়ুনোটিক’ অসুখ, সেই সব অসুখের ইতিহাস। কোয়ামেন সাহেব নিজে বিজ্ঞানী না হলেও যথেষ্ট গবেষণা ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করে লিখেছেন বইটি। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে নামী লেখক।
বইটি ২০১২ সালে প্রকাশিত, ফলে তারও আগে লেখা। এত আগে লেখা এই বইয়ের ২০৭-২০৮ পৃষ্ঠায় এসে চোখ আটকে গেল। কোয়ামেন সাহেব লিখেছেন, ‘সার্স’-এর সময় যে করোনাভাইরাস মানুষকে বিপদে ফেলেছিল সেখানে মানুষের একটি সুবিধে ছিল, ‘‘অসুখটা ছোঁয়াচে হওয়ার আগেই— পরে নয়— মানুষের শরীরে অসুখটার চিহ্ন ফুটে উঠত।’’ কিন্তু এর পরই আছে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো কয়েকটি কথা। ‘‘আজকাল সব কিছুই অনেক তাড়াতাড়ি গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করে ফেলে, ভাইরাসও তাই।... আরও মন-অন্ধকার করা একটি গল্প বলা বাকি আছে, তা এই (সার্সের) করোনাভাইরাস নিয়ে নয়, অন্য কোনও (করোনাভাইরাস) নিয়ে। যখন পরের বড়টি (দ্য নেক্সট বিগ ওয়ান) আসবে, তখন তার ধরনটা হবে বেয়াড়া। অসুখের চিহ্ন ফোটার আগেই অসুখটা খুব ছোঁয়াচে হয়ে দাঁড়াবে।’’
স্পিলওভার: অ্যানিম্যাল ইনফেকশন্স অ্যান্ড দ্য নেক্সট হিউম্যান প্যানডেমিক
ডেভিড কোয়ামেন
ডব্লিউ ডব্লিউ নর্টন অ্যান্ড কোং, ২০১২
ভাবুন, আট বছর আগের এই উক্তি! বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে এক জন সাংবাদিক যা জেনেছিলেন তা কি বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না? ২৯০ পৃষ্ঠায় পড়ছি: ‘‘সারকথা: যদি মানুষ সংখ্যায় অনেক হয়, আর তাদের বাসস্থানে জনঘনত্ব খুব বেশি হয় আর তারা যদি নতুন জীবাণু আসার পথ অরক্ষিত রাখে, তা হলে সেই পরের বিরাট মহামারি আসাটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।’’ আসল প্রশ্ন হল, সেই নতুন ভাইরাস যে আসবে সে কি আমাদের গলায়, নাকে, চোখে ঢুকে সেখানে অস্বস্তি, যন্ত্রণা ইত্যাদি সৃষ্টি করে মানুষের কাশি বা হাঁচিকে অবলম্বন করে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারবে? তার পর অন্য শরীরে প্রবেশ করে সেই শরীরের কোষে ঢুকে নিজের লক্ষ লক্ষ কপি ছড়িয়ে দিতে পারবে? (পৃ ২৯১) ‘সৌভাগ্যবশত সব ভাইরাস তা করতে পারে না।’ (ওই)
এই সৌভাগ্যই মানুষের টেকেনি। নোভেল করোনাভাইরাস এমন সব কাণ্ড করতে পারে যা অন্য অনেক ভাইরাস পারে না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে আট বছর আগেই যে বিপদের সম্ভাবনার কথা জানা ছিল, সে বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার ও ওয়াকিবহাল মহল কেন আরও সাবধানতা অবলম্বন করল না? আমরা কি শুধুই সৌভাগ্য নির্ভর হয়ে বসে ছিলাম? সতর্কবাণী থাকা সত্ত্বেও আমরা এই মহামারিটা হতে দিলাম কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। কিন্তু বিভিন্ন সরকার যে সমস্ত সতর্কবাণী হেলায় অবহেলা করে মানুষের জীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দিতে পারে, তার পরিচয় আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে পেয়েছি। কোনও ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকের গবেষণায় এর কার্যকারণ প্রকাশ পাবে। কিন্তু আজকাল মানুষের সমাজে মহামারির বিপদ কেন বাড়ছে তার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন কোয়ামেন সাহেব। ৪০-৪১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘একেবারে সারসংক্ষেপ করে বলতে গেলে, এই: মনুষ্যজনিত চাপের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে জন্তুর শরীরের জীবাণুর সঙ্গে মনুষ্যগোষ্ঠীর সংযোগ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর মানুষের প্রযুক্তি ও ব্যবহার তাকে বেশি বেশি করে ছড়িয়ে দিচ্ছে।... আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছিঁড়ে ফালাফালা করছি।’’ দ্বিতীয়ত, এই সব প্রাকৃতিক অঞ্চলে কোটি কোটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য পরভৃৎ জীবাণুর বাস। এবং এরাই প্রাণিজগতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলো ধ্বংস করে আমরা এই জীবাণুদের বাইরের জগতে ছেড়ে দিচ্ছি। তখন জীবাণুগুলো যাবে কোথায়? তাদের হয় বেঘোরে মারা পড়তে হয় অথবা বাঁচতে গেলে অন্য কোনও অতিথি-শরীর ধরতে হবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষকে আশ্রয় করার সুবিধে হল এই মানুষ তাদের হাতের কাছেই, কারণ মানুষই তাদের বাসস্থানে হানা দিয়েছে, তারা তো আর মানুষকে খুঁজে নেয়নি। আর মানুষ সংখ্যায় প্রচুর আর খুব সামাজিক এবং তারা নানান সূত্রে ভ্রাম্যমাণ (কেউ মুনাফার লোভে, কেউ জীবনধারণের তাগিদে)। ফলে জীবাণুদের নতুন ও বাড়বাড়ন্তের জীবনের জন্য মানুষের শরীর এক আদর্শ বাসা!
পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাসে ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি আদি প্রাণী। প্রাণের বিবর্তনের ইতিহাসে এদের অনেক সদর্থক ভূমিকাও আছে। আমাদের শরীরের ভিতরেও কোটি কোটি জীবাণুর বাসা। তারা অনেকেই আমাদের শরীরে বন্ধুর কাজ করে। সংখ্যালঘু কিছু জীবাণু আছে, যাদের সঙ্গে আমাদের বৈরী ভাব। এখানে সাবধানতা মানুষকেই অবলম্বন করতে হবে। কোয়ামেন সাহেবের বইটি পড়ে মনে হল যে, হ্যাঁ, সংখ্যায় যে মানুষ অনেক বেড়েছে গত দু’শো বছরে ও বিশেষ করে গত সত্তর বছরে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই এত মানুষকে পৃথিবীর ‘প্রচুর ভাঁড়ার’-কে অবলম্বন করেই বাঁচতে হবে, তা নিয়েও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র হল জীববৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখা। বন্যেরা বনে সুন্দর— এই একেবারে গোড়ার কথাটা কি ধনতন্ত্রের মালিকশ্রেণি ও রাষ্ট্র-চালক রাজনৈতিক নেতারা বুঝবেন ও মনে রাখবেন?