শ্রমী: বাজারে রঙিন চুড়ির পসরা নিয়ে ছত্তীসগঢ়ের জনজাতি মেয়েরা
র্যালফ ফক্স-এর রাজনৈতিক দর্শন বা সক্রিয়তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। এমনকি, উপন্যাসের ব্যাকরণ নিয়ে ১৯৩৪ সালে লেখা তাঁর বই দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য পিপল-এর সঙ্গেও কিছু বিপক্ষতা সম্ভব। কিন্তু, “ব্যক্তিবিশেষের নিয়তিকে উপন্যাসের রূপ দিতে হলে সমগ্রের একটা অবিচল ধারণা থাকতে হয়”, তাঁর এই উপলব্ধিকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। উপন্যাস তো ‘কেবল কল্পনাশ্রয়ী গদ্য নয়’, উপন্যাস হচ্ছে “মানুষের জীবনের গদ্য; মানুষকে সমগ্রতায় গ্রহণ করা ও তাকে সেই ভাবে রূপ দেওয়ার ব্যাপারে প্রথম শৈল্পিক প্রচেষ্টা।” তাই ঔপন্যাসিককে স্পষ্ট বুঝতে হয়, যে বহুল বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আলাদা আলাদা জীবন গড়ে ওঠে, সেগুলো ঠিক কী রকম। যাঁরা সেটা বুঝতে পারেন, দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য পিপল-এর এক আলোচক ডোনা টর-এর কথায়, তাঁরাই পারেন আমাদের চোখ খুলে দিতে; রীতি, মতান্ধতা, মন্থর বিষপ্রয়োগে বোধি-নিঃসাড়তা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে।
কাজটাকে কঠিন বললে কাঠিন্যের অবমূল্যায়ন হয়। এক দিকে একক ব্যক্তির দ্বন্দ্ব ও সম্মিলনে গড়ে ওঠা নিজস্বতা, আর অন্য দিকে ছোট ছোট সমগ্র নিয়ে মহীরুহের মতো উদার এক নির্মাণের প্রক্রিয়াকে দেখতে পাওয়ার মতো অন্তর্দৃষ্টি ও প্রশস্ত অবলোকনশক্তি থাকলেই কেবল হয় না— দরকার হয় বোধি ও হৃদয়ের সম্মিলন, আর অবিমিশ্র শ্রম। উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে শ্রমজীবীর কথা। তাই রচনাও আবশ্যক ভাবে হয়ে ওঠে শ্রমজ। এ ভাবে শ্রমজীবীর কথা যখন শ্রমনিবিড় লেখনীর সাহচর্য পায়, তা হয়ে ওঠে এক ভিন্নতর আত্মকথন। সে কথনে অবিরাম বিচ্ছিন্ন ও অবিরাম একত্রিত মানবজীবনগুলো তাদের নিজস্ব মহিমা ছাড়িয়ে এক পরম মানবত্বে উত্তীর্ণ হয়। আর পঠনের শ্রমে পাঠকও হয়ে ওঠে উপন্যাসের অংশ। এমনটা সম্ভব হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর মহাকান্তার-এ।
মহাকান্তার
অনিতা অগ্নিহোত্রী
৩৫০.০০
দে’জ পাবলিশিং
ব্যাকরণ মেনেই এ রচনা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বিপুল এই ভারত ভূখণ্ডের বিপুলতর মানবজীবনের একটি ছবি আঁকতে গিয়ে লেখিকা নির্ভর করেছেন প্রশস্ত এক ভূগোল ও গভীর এক ইতিহাসের উপর। সে ভূগোলের নাম মহাকান্তার—কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামক বিরাট মৃত্তিকাখণ্ডের অংশবিশেষ। একদা যা ছিল বিরাট এক মহাদেশ, প্রকৃতির খেয়ালে তা নানা রাজনৈতিক ভূগোলে বিভাজিত। খণ্ডিত সেই ভূমির বিরাট একটি অঞ্চল জুড়ে, ওড়িশার দক্ষিণভাগ থেকে নিয়ে অন্ধ্র, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ হয়ে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত প্রসারিত পর্বত ও বনভূমি, নদী ও কৃষিক্ষেত্রের মধ্যে মধ্যে বসত গড়ে থাকা মানবসমাজগুলির মধ্যে থেকে গেছে প্রাচীন গন্ডোয়ানার অবশেষ, ভারতের বৃহত্তম আদিবাসী সম্প্রদায় গোন্ডদের জীবন-জীবিকা-ভাষা-সংস্কৃতির ধারাপ্রবাহে। সেই প্রবাহ— লোককথা বলে যে— একক ছিল না। তার মধ্যে ছিল নানা ধারার মিশ্রণ। গোন্ডদের পাশাপাশি বসত ছিল কর্মকার, গোপালক এবং অন্যান্য শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজের। এক দিন যাঁরা ছিলেন এক বিরাট লোকদেশের বাসিন্দা, প্রকৃতির সঙ্গে বাক্যালাপের মধ্য দিয়ে যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব স্বেচ্ছাধীন সমাজ, রাজনীতির আগ্রাসী বণ্টনে সেই লোকসমাজ আজ ভারত নামক রাষ্ট্রীয় অবয়বের মধ্যে সমাধিস্থ— এক কোটির বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট গোন্ডদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল আপন অবয়ব থেকে। মার্ক্স-বর্ণিত বিচ্ছিন্নতা কেবল ইউরোপীয় শিল্পশ্রমিকের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, মানবসমাজের নানা খণ্ডেই তার প্রযোজ্যতা সমান। ওড়িশা থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকতে বাধ্য হওয়া এই লোকসমাজ আজ নিজের ঘরেই ভিনদেশি, সংখ্যালঘু। যে পাহাড় তাঁদের দেবতার আবাস, যে অরণ্যে বিচরণ করে তাঁদের পূর্বজদের ইতিহাস, যে কৃষিক্ষেত্র নির্মাণের কাহিনি পুষ্ট হয়েছে তাঁদের ‘বুঢ়া’ রাজার আশীর্বচনে, আজ সেই প্রকৃতি থেকে তাঁরা, এবং তাঁদের থেকে সেই প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন— পাহাড়ের অধিকার নিচ্ছে খনিজসন্ধানী পুঁজি, নদীর প্রবাহকে রুদ্ধ করেছে উন্নয়নের ছদ্মবেশ পরা লোভ, আর কৃষিজমির দখল নিয়েছে হিন্দু জাতিকাঠামোর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতাপের মিশ্রণে গড়ে ওঠা মূর্তিমান অশুভ।
মহাকান্তার এই ভূগোল ও ইতিহাস, মানুষ ও প্রকৃতি, দেহশ্রম ও মননের অনুশীলনের এক দীর্ঘ, প্রসারিত, এবং স্বাভাবিক ভাবেই জটিল অনুসন্ধান। নিখিল নাম পরিত্যাগ করে চিরন্তন নাম নেওয়া এক লোকসাহিত্যের সংগ্রাহকের হাত ধরে এগোলেও এ উপন্যাসের কোনও একক নায়ক নেই। লোকবিশ্বাসে নির্মিত যমজ ভাইবোন সুনাদেই ও বুঢ়ারাজা, পরম্পরায় কথিত হয়ে আসা প্রথম মানব-মানবী এ উপন্যাসের ততটাই প্রধান চরিত্র, যতটা হচ্ছেন জীবনের প্রতিটি দিক, প্রতিটি মুহূর্তকে গানের মধ্যে ধরে রাখা গীতকুড়িয়া নিয়ামাটি, সালোয়া জুডুমের অত্যাচারে উচ্ছেদ হওয়া পইরাম পন্নু, পরজা কন্যা দেবকী ঝোড়িয়া, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেওয়া ফাঁসিতে প্রাণ দেওয়া আদিবাসী নেতা লক্ষ্মণ নায়েক, পাহাড় দখলের একটা বিরুদ্ধ-আন্দোলন গড়ে তোলা নেতা শংকর পরজা, গরু-ছাগলের মতো ট্রেনে-বাসে বোঝাই হয়ে কাজের সন্ধানে যাত্রা করা দলে দলে মানুষ, বঙ্গভূমি ছেড়ে স্বাধীন ভারতে আশ্রয় নিতে এসে দণ্ডকারণ্যে চালান হয়ে আসা উদ্বাস্তু মানুষ, এবং তথাকথিত মূলস্রোত থেকে ছিটকে আসা গবেষিকা থেকে সমাজকর্মী হয়ে ওঠা গায়ত্রী।
পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ বেঁচে থাকতে চায় তার স্বভূমির নামে। তাই যখন আমাদের রাজ্যের নিকটবর্তী মশানজোড়ে ১৪৪ মৌজা ডুবিয়ে নির্মিত হল বাঁধ, তখন উচ্ছেদ হওয়া গ্রামবাসীরা যেখানে বসত গড়লেন, সে সব গ্রামের নাম রাখলেন নিজেদের আদি গ্রামের নামে। শুনেছি, সেই আদিগ্রামের নামটিও নেওয়া হয়েছিল আদিতর এক গ্রাম থেকে। কিন্তু বঙ্গভূমি থেকে উৎখাত হওয়া লোকেরা নিজেদের বসতের একটা নাম পর্যন্ত পেলেন না— তাঁদের গ্রামের নাম হল, এম ভি ১, ২, ৩…। এম ভি হল মালকানগিরি। এই বাইরে থেকে আসা মানুষদের স্ব-গ্রামের নাম না পাওয়াটাও এ উপন্যাসে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা জরুরি ইন্দ্রাবতীর বাঁধে ডুবে যাওয়া স্থানীয় ‘আদিবাসী’দের ভূগোল, ইতিহাস ও সমাজব্যবস্থা।
লেখিকা এক দিকে যেমন সযত্নে পরিহার করেছেন বাংলা রচনার এক প্রাচীন অসুখ: লোকসমাজ সম্পর্কে অবহিতি জাহির করতে একটা কৃত্রিম ভাষা গড়ে তুলে সেটাকে লোকভাষা বলে চালানোর চাতুর্য; তেমনই আবার তিনি নিজেকে সংযমে বেঁধেছেন ‘আদিবাসী’ ঐশ্বর্যের মধ্যে ভারতীয় বিশ্ব খুঁজে পাওয়ার মতো উপাদেয় লোভ থেকে। তার জায়গায় তিনি ঝুঁকি নিয়ে গড়ে তুলেছেন দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক কাঠামোর সঙ্গে এই অঞ্চলের বিবর্তনকে, এবং সেই সঙ্গে ভারতের বহুত্বমূলক সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যে নানাবিধ মিশ্রণের পটভূমি ও বাস্তবতাকে। এ কাহিনি উত্তীর্ণ হয় পরতের পর পরতে বসানো, জটিল থেকে জটিলতর এক মানব-আখ্যানে। বদলে যাওয়া কৃষি-অর্থনীতি, শোষণের পদ্ধতি, প্রকৃতির উপরে পুঁজির অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় নামিয়ে আনা আগ্রাসন, রাষ্ট্র আয়োজিত ইতিহাস ও ভূগোলের মূলোচ্ছেদের পরিকল্পনা, ভাষা ও সংস্কৃতি, মানবমন ও লোকসংহতির উপর সরকারি তন্ত্রের বিজাতীয় আক্রমণ, আর এ সবের বিরুদ্ধে ক্ষীণ অথচ জেদি প্রতিরোধের কাহিনিগুলিও হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র অথচ পরস্পর সংযুক্ত উপাখ্যান। পাঠকের সামনে খুলে যায় মানবজীবনের নানা অজানা প্রকোষ্ঠের তালা। একটাই বিধিবদ্ধ সতর্কতা: পাঠককেও শ্রমের ঐক্যে বিশ্বাসী হতে হবে।