—প্রতীকী চিত্র।
১৯৪২-এ ঘোর বিপর্যয়ের দিনে ইয়াঙ্গন থেকে ভারতীয় শরণার্থীদের নিয়ে শেষ জাহাজ চলেছে আকিয়াবের পথে; সহকারী পাইলট জানাচ্ছেন আশঙ্কার কথা। জলের গভীরে আছে জাপানি সাবমেরিন, যে কোনও সময়ে টর্পেডো মেরে উড়িয়ে দিতে পারলেও তারা কেবল অনুগ্রহ করেই তা করছে না। কারণ জাহাজে শুধু উদ্বাস্তুরা, ব্রিটিশ সৈন্যরা তো আর নেই! এমন রোমাঞ্চকর তথ্যসমৃদ্ধ সঙ্কলনগ্রন্থ মৃন্ময় প্রামাণিকের বইটি। ১৯৬০-এর দশকে বর্মাবাসী বাঙালি প্রগতি নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশ করে, তারই কয়েকটি সংখ্যার সঙ্কলন বইটি। সংযোজিত হয়েছে একটি ভূমিকা-সহ সম্পাদকের আরও দু’টি লেখা।
১৯৩৭-এ ব্রহ্মদেশ ব্রিটিশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তার পর থেকে সুবর্ণভূমির বাঙালিরা কেমন ছিলেন? ১৯৬৪-তে মায়ানমারের ‘ন্যাশনালাইজ়েশন’-এ উৎখাত করা হয়েছে পুরনো ভারতীয় স্মারক, স্থাপত্য, স্মৃতিচিহ্ন। ধ্বংস হয়েছে সুভাষচন্দ্রের আবাস, স্থানীয় টেগোর কলেজ। এমনকি সংগ্রহালয়, স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশন, গ্রন্থাগার, দূতাবাস, কোথাও বাঙালির দীর্ঘ বর্মাবাসের তেমন কোনও প্রমাণ মেলে না। এই প্রেক্ষিতে সঙ্কলনটি তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৬১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রগতি প্রথম বেরোয়, এবং জাতীয়করণ পর্যন্ত মাত্র তিন বছর চলেই তা বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয়করণে ভারতীয়দের অধিকার খর্ব হওয়ার এও এক নমুনা। প্রতি সংখ্যায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদের সঙ্গে থাকত ধর্মীয় উপদেশ, ভারত পাকিস্তান বর্মার খবর, শ্রদ্ধার্ঘ্য, খেলার খবর, স্থানীয় বাঙালিদের বিয়ের খবরও।
এই পত্রিকা ঘিরে বর্মার বাঙালিরা রাষ্ট্রীয় ঝঞ্ঝায় এক অখণ্ড আত্মপরিচয় নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিল। ঔপনিবেশিক আমলে ব্রহ্মদেশে আমলা, ডাক্তার, শিক্ষক ইত্যাদি পদে বাঙালি একচেটিয়া ভাবে কাজ করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ও স্বাধীনতার সময় তারা দলে দলে ভারতে ফিরে আসাই শ্রেয় মনে করে। ফিরে আসার পথের মর্মন্তুদ বিবরণ মেলে প্রগতি-তে, উপেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ধারাবাহিক লেখায়। যারা থেকে গিয়েছিল তারাও ছিল দিশাহারা।
পত্রিকার ‘স্বাগত সাহিত্য সম্মেলন’ শিরোনামের প্রবন্ধে আত্মসমালোচনা করে লেখা হল, “যে দেশের অন্নে পরিবার, পরিজন প্রতিপালন করেছি, সে দেশকে, সে দেশের মানুষকে আপন করে নিতে আমরা চাই না।... এদেশে আইনসঙ্গত ভাবে, স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার এদেশের উদারপ্রাণ সরকার আমাদের দিয়েছেন। যাঁরা এদেশে থেকে যাবেন... তাঁদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চূড়ান্ত (সিদ্ধান্ত) এখনই গ্রহণ করতে হবে।... মাতৃভূমির মনীষীবৃন্দ তাঁদের কি রায় দেবেন?” বর্মার প্রবাসী বাঙালির আত্মিক টানাপড়েন, সঙ্কট ও সঙ্কটমোচনের অভিপ্রায়ে মাতৃভূমির মানুষের মতামতের কাছে আত্মসমর্পণ বুঝিয়ে দেয় তাদের মানসিক দ্বিধা।
ভারত, পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ ও বর্মায় রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ কী ভাবে উদ্যাপিত হবে, তার বিবরণ আছে পত্রিকার প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায়। পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে শিলাইদহ ও সাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও যাপন নিয়ে দু’রিলের একটি তথ্যচিত্র তৈরির কথাও বিবেচিত হয়।
সঙ্কলনের একটি প্রবন্ধে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, নেতাজি মান্দালয়ে রাজবন্দি থাকায় কি বর্মায় বিপ্লবী ছাত্ররা অনুপ্রেরণা পায়? অজ্ঞতা ও সামাজিক মেলামেশায় জড়তা থাকার জন্য যে ছাত্রসঙ্ঘ ১৯২৫-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েও তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি, তাদেরই ক’জন বাঙালি তরুণ ১৯৩২-এ রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপ্লব ঘোষণাত্মক পুস্তিকা ছাপিয়ে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছেন। এই যুবকদের সান্নিধ্যে থেকেছিলেন তিন বর্মি ছাত্র উ নু, উ রসিদ, বীর বোজোক আউঙ সান— এঁরাই ১৯৩৬-এর বিখ্যাত ছাত্র আন্দোলন ঘটাচ্ছেন। প্রবন্ধের বক্তব্য ভেবে দেখার মতো।
বাংলা অভিবাসী সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই সঙ্কলন অমূল্য সংযোজন। প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায় আরও প্রকাশ পায় কবি জসীমউদ্দিন রচিত বহুল প্রচলিত ‘আমায় ভাসাইলি রে/ আমায় ডুবাইলি রে’ গানটি। বেদার উদ্দিন আহমেদের স্বরলিপিটিও সংযুক্ত হয়েছে এখানে।
পত্রিকায় অজস্র বিজ্ঞাপন, সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। ‘নিউ মাতৃ ভাণ্ডার’ বা ‘নির্মল প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ এর বাংলা বিজ্ঞাপন বর্মা মুলুকে বাঙালির আধিপত্য প্রকাশ করছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু চমকে যেতে হয় এমন বিজ্ঞাপনে: “প্রতি বাড়ীতে বেরাল পোষবার আর প্রয়োজন নাই।” আসলে এটি এক ধরনের ইঁদুরের বিষের প্রচার। আবার কোনও এক থানডং টি-এস্টেট বিজ্ঞাপনে লিখছে, “আমার নাম চা, আমার পেশা পরোপকার।” শুধু মায়ানমারের বাঙালির রাজনৈতিক সঙ্কট চেনার জন্যই নয়, তাঁদের আর্থ-সামাজিক জীবন বোঝার জন্যও এই বইটি পড়ার প্রয়োজন আছে।
তবে প্রগতি-র প্রতিটি পাতায় অজস্র বানান ভুল ছিল, ভাষাগত সমস্যাও ছিল। সঙ্কলক পুরনো পত্রিকা থেকে নতুন ভাবে উদ্ধারের সমস্যার কথা বললেও, দেখা যাচ্ছে তাঁর নতুন সংশ্লিষ্ট রচনা দু’টিতেও বেশ কয়েকটি মুদ্রণপ্রমাদ আছে। প্রতিটি সংখ্যার প্রগতি-র শেষাংশে একটি সংশোধনী সংযুক্ত হতে পারত। তবুও মৃন্ময় প্রামাণিকের সুদূর মায়ানমার থেকে পত্রিকাগুলিকে উদ্ধার এবং একত্রে প্রকাশের প্রয়াসকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের চিন্তন প্রকল্প— অর্থাৎ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যের বিস্তৃত মানচিত্রের পুনর্গঠনের ইচ্ছা ও পুনর্বার সমষ্টির স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছেন তিনি। এই দায়িত্ববোধ ধন্যবাদার্হ।
চেনা দূরের কথা: বর্মাবাসী বাঙালির সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রগতি’
সংগ্রহ ও সম্পা: মৃন্ময় প্রামাণিক
৫০০.০০
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা