মহানগর: উনিশ শতকের শেষ ভাগের কলকাতা। উইকিমিডিয়া কমনস
বিগত কিছু বছর ধরে এক ঝাঁক গবেষক ব্রতী হয়েছেন আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায়, ইতিহাসচর্চায় এক উজ্জ্বল উদ্যোগ৷ এক সময় আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন নিখিলনাথ রায়, সতীশচন্দ্র মিত্র, যতীন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ বিশিষ্ট গবেষক, তবে তা ছিল বিভিন্ন জেলার ইতিহাস৷ সেই ধারার প্রতিফলন ঘটেছে বাংলার শহরগুলির ইতিহাস চর্চায়৷ আলোচ্য বইটি মোট পনেরোটি নিবন্ধের একটি মনোগ্রাহী সঙ্কলন৷ দু’-একটি ছাড়া সবই বিশেষ কোনও শহরের ইতিহাস, কালের বিচারে কোনওটির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে, কোনওটির ঘটেছে বৃদ্ধি৷
নগরায়ণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিত মোটামুটি একই কথা বলেছেন৷ সুনীলকুমার মুনশি ডায়নামিক্স অব আরবান গ্রোথ ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থভূমিকায় লিখেছেন, সাদামাটা অর্থে নগরায়ণ হল নগর বা শহরে মানুষের ঘনীভবন৷ এই ঘনীভবন হতে পারে বিভিন্ন কারণে; ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি বিভিন্ন উপাদান তৈরি করে শহরের উত্থানের পটভূমি৷ ম্যাক্স ওয়েবার বাজারের অবস্থানকেও নগরায়ণের শর্ত হিসাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, তবে তা অপরিহার্য নয়৷ আলোচ্য বইয়ে দেখা যায়, দিনাজপুর শহরের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক কেন্দ্র রূপে৷ রাজশাহীর বিকাশ ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র রূপে স্বীকৃতি পেয়ে৷ চট্টগ্রাম আধুনিক শহরে রূপান্তরিত হয়েছে বন্দরের গুরুত্বের প্রভাবে৷ ব্যারাকপুর শহর গড়ে ওঠার কারণ, সেখানে কোম্পানির সেনানিবাস নির্মাণ৷ মেদিনীপুর শহরের বিকাশ ঘটে কোম্পানির রেসিডেন্সি সেখানে স্থানান্তরিত করার ফলে৷ তবে, শহরগুলির ইতিহাসের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, সেগুলি আধুনিক শহর হিসাবে পরিচিতি লাভ করে ঔপনিবেশিক শাসনের সংস্পর্শে এসে৷ অবশ্য শহরগুলির প্রাচীন ইতিহাসও কম আকর্ষণীয় নয়৷ প্রবন্ধকাররা কেবল শহরের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক তথ্য পরিবেশেই তুষ্ট থাকেননি, আলোচনায় এনেছেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসও৷ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যজ্ঞেশ্বর চৌধুরীর নবদ্বীপ এবং সুখেন্দু দাসের গোবরডাঙা শহর নিয়ে লেখা দু’টি৷ নগরায়ণ যে অনেক সময় বাধা পায় প্রকৃতির প্রতিকূলতায়, দেখিয়েছেন শর্মিষ্ঠা দে৷
বাংলার শহর ২
সম্পা: শেখর ভৌমিক, অরিন্দম চক্রবর্তী
৪৫০.০০
আশাদীপ
নিবন্ধকারদের কৃতিত্ব, তাঁরা এমন এমন শহরের ইতিহাসের উপর আলোকপাত করেছেন যাদের ইতিহাস রীতিমতো সমৃদ্ধ৷ গোবরডাঙার মতো একটা ‘গ্রামীণ’ শহরের যে বলার মতো একটা ইতিহাস থাকতে পারে, নিবন্ধটি পড়ার আগে অভাবনীয় বোধ হয়৷ প্রতিটি নিবন্ধ গবেষকদের পরিশ্রমের ফসল, বোঝা যায় সূত্রনির্দেশ লক্ষ করলে৷ শর্মিষ্ঠা দে ও শেখর ভৌমিক সরকারি নথিপত্রের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন৷ সম্প্রতি কিছু ইতিহাসবিদ ও গবেষকের মধ্যে লেখ্যাগারিক তথ্য সম্পর্কে যে উন্নাসিকতার ভাব দেখা দিয়েছে, তার প্রতিষেধক নিবন্ধ দু’টি৷
দেবাশিস বসুর ‘কলকাতার নগরায়ণ: ইতিহাসের শিক্ষা’ নিবন্ধটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে৷ তিনি লিখেছেন, “কলকাতার ঔপনিবেশিক নগরায়ণের উদ্গাতা যদি কারোকে বলতে হয়, তবে সে শিরোপা পলাশির যুদ্ধজয়ের নায়ক ক্লাইভের প্রাপ্য৷” সত্যিই কি তা-ই? নান্দনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ওয়েলেসলি কলকাতার নগরায়ণের রূপরেখা টেনেছিলেন শহরের সমস্যাগুলি উপলব্ধি করে, বলা যায় নির্দ্বিধায়। তাঁর পরিকল্পনা মাথায় রেখে উত্তরসূরিরা এগিয়েছিলেন নগরায়ণের প্রক্রিয়ায়৷ তাঁর ১৮০৩-এর ‘মিনিট’-কে (জুডিশিয়াল ক্রিমিনাল প্রসিডিংস, ১৪ জুলাই ১৮০৩, নং ২৫) কলকাতার নগর-পরিকল্পনার নীলনকশা বললে অত্যুক্তি হয় না৷ তা শুরু হয় এ ভাবে, “কলকাতার প্রসার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ও সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের আসন কলকাতার প্রয়োজন সরকারের সুগভীর মনোযোগ৷ এই মহানগরের বহুসংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা প্রণয়ন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷” কলকাতা নগরের উন্নয়নে তাঁর ভাবনা, পরিকল্পনা গত শতকের ইতিহাসবিদদের গবেষণায় আসেনি৷ তাঁকে অনুচ্চারিত রেখে কলকাতার নগরায়ণের ইতিহাস রচনা অসম্ভব৷ কলকাতার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হল স্থানিক বিকাশ ও জনবিন্যাস, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য, বস্তি উচ্ছেদ, পুর প্রশাসন ইত্যাদি। লেখ্যাগারের নথিপত্র না ঘাঁটলে এগুলি আলোচনায় আনা মুশকিল, আবার স্বল্প পরিসরে এত সব বিষয়ে আলোকপাতও সহজ নয়৷