—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কথাসাহিত্য সময়ের আয়না বটে, তবে সেখানে সময়কে তুলে ধরার নানা কৌশল অবলম্বন করেন লেখকেরা। ছোটগল্প, যা আসলে জীবনেরই খণ্ডিত বা টুকরো নমুনা, সেখানেও কত না প্রকরণের ব্যবহার: প্রতীক বা রূপক, আখ্যানের অন্তর্ঘাত, কখনও পাঠক বা গল্পকারেরই ইচ্ছাপূরণ। এই সবই, এবং আরও অনেক প্রকৌশলই বাংলা ছোটগল্পে মিশে আছে অদ্যাবধি। তবে কোনও কোনও কলম এই আচরিত অভ্যাসগুলিকেও সপাটে প্রত্যাখ্যান করে— তসলিমা নাসরিন যেমন। বিতর্কিত বিশেষণটি তাঁর সঙ্গে জুড়তে বাঙালি যত আগ্রহী, তাঁর কলমের ছানবিন করতে তত আগ্রহী নয়। অথচ এ কাজটিই প্রয়োজন বেশি, তসলিমা যে ভাবে লেখেন সেই ‘ভাব’ ও ‘ভঙ্গি’র শুধু বিষয়গত নয়, সাহিত্যগত মূল্যায়নও জরুরি।
এই বইটি তসলিমার সাম্প্রতিক কালে লেখা কিছু ছোটগল্পের সংগ্রহ। লেখার ভঙ্গিটি চেনা: তাঁর পত্রপত্রিকার লেখা, জার্নালধর্মী লেখা, সাক্ষাৎকার, উপন্যাস এমনকি সমাজমাধ্যমের লেখার সঙ্গেও যে পাঠকের পরিচয় আছে তিনি বুঝতে পারবেন লেখিকার দর্শন— স্রেফ পড়তে ভাল লাগবে বলে তিনি তাঁর গল্পের চরিত্র বা প্লটকে চিনির রসে ডোবাবেন না। যেন ‘গল্প লিখছি’, এই ব্যাপারটা লেখিকার অবচেতনেও নেই। যে জীবন ও মানুষগুলিকে তিনি সামনে থেকে দেখে এসেছেন এত কাল, এখনও দেখছেন— তাঁরা এতই নিরাভরণ নিরাবরণ যে সাহিত্যের বেশভূষা তাঁদের গায়ে চড়ালেও তা লাগবে নিতান্ত অশ্লীল: এ-ই তাঁর বিশ্বাস। তাই ঢাকা নেত্রকোনা বা কলকাতা, দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী বা সৌদি আরব— তাঁর গল্পের পটভূমি নানা জায়গা ঘুরে এলেও থিতু হয় রক্তমাংসের মানুষের রক্ত ও মাংসে, আক্ষরিক অর্থেই।
চুম্বন
তসলিমা নাসরিন
৩৫০.০০
সপ্তর্ষি প্রকাশন
এই সময়ের বাঙালি জীবনকে ক্রমাগত তাড়িত করছে যে হিংসা, তসলিমার গল্পের চরিত্রেরা তার অকপট ‘কেস স্টাডি’। এই হিংসা যেমন দাম্পত্য বা পারিবারিক অপ্রেম থেকে উঠে আসা, তেমনই জাতি বর্ণ ধর্ম পেশাগত বৈষম্য থেকেও। হিন্দু-মুসলমান, উচ্চ-নীচ, শহর-গ্রামের বিভেদ লেখিকা তুলে আনেন সাম্প্রতিক নানা চুম্বকে। হনুমানজয়ন্তী ঘিরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ভেঙে পড়া, বাংলাদেশি নারী-শ্রমিকের সৌদি আরবে অমানুষিক নির্যাতন, সমকামী যুগলের সামাজিক নিপীড়ন, মুক্তমনা মানুষের প্রকাশ্য হত্যা, মাদ্রাসার অন্তরালে যৌন নির্যাতন ও ধর্মান্ধতার চাষ— এমনই আরও অনেক আতশকাচে দেখা যাপিত জীবন। তবে এই কাচ রক্তাক্ত করে, এ একটা বড় তফাত।
প্রচারমাধ্যমের সৌজন্যে এই ঘটমান বর্তমান আমাদের চেনা, কিন্তু এ কালের কথাসাহিত্যে তারা ধরা পড়ে কতটুকু! যেটুকু পাওয়া যায় তাকেও দেখা যায় লেখকদের রাজনৈতিক বিশুদ্ধতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টায়, বা এক ধরনের ফোলানো-ফাঁপানো আদর্শবাদী ইচ্ছাপূরণের গোলকধাঁধায় পথ হারাতে। তসলিমার কলম এ সবের পরোয়া করেনি, এই গল্পগুলিতেও তিনি একই রকম একরোখা, নাছোড়। এতটাই যে, জীবন আর গল্পের বাস্তব একেবারে মিলেমিশে গেলে যে কোথাও সাহিত্যরসের একটু হলেও হানি হয়, এ যুক্তি অন্তত এই গল্পগুলির কলম স্বীকার করে না। দু’-একটি গল্প পড়তে রীতিমতো অস্বস্তি হয়: সুইসাইড নোটের বয়ানে এক পিতার যৌন পছন্দ ও আচরণের রাখঢাকহীন বিবরণ পাঠককে ছিন্নভিন্ন করার ক্ষমতা রাখে। তারই পাশে আছে বিরল নরম প্রেমের গল্পও, যার শুরু ইন্দ্রিয়পরতার ভূমিতে, শেষ ভালবাসার ভূমায়। গল্প এরা তো বটেই, তারও বেশি সত্য।