বহু শতাব্দী ধরেই ভারতীয় সমাজ আর অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন কৃষি। বহু শতাব্দী ধরেই এখানে সমাজ আর অর্থনীতির বৈষম্যকে লালন করে চলেছে সামন্ততন্ত্র। যুগে-যুগে সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষিজীবীরা আন্দোলন, অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহের সূত্রে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। সব সময় তাঁরা হয়তো সাফল্য পাননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের তোলা রুটি, রুজি, সম্পদ আর মানবিক অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি অমীমাংসিতই থেকে গিয়েছে। কৃষিজীবীদের আন্দোলনও নানা মাত্রায় জারি থেকেছে ধারাবাহিক ভাবে। আর, জারি আছে অতীত আন্দোলনগুলি নিয়ে বৌদ্ধিক অনুশীলন।
অবশ্য গড়পড়তা ইতিহাস-নির্মাণে (ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হিস্টোরিয়োগ্রাফি’) প্রাধান্য পায় আধিপত্যবাদী শক্তি বা বিজয়ী পক্ষের গুণগান। সেই একদেশদর্শী ভাষ্যের মোকাবিলায় লেখা হয় প্রতি-ইতিহাস বা ‘কাউন্টার হিস্ট্রি’, যেখানে আলোটা পড়ে বিজিত পক্ষের প্রতিবাদী স্পর্ধা আর প্রত্যাঘাতের উপর। আলোচ্য বইটিও এই রকম এক প্রতি-ইতিহাসের অংশ। এ দেশের সবচেয়ে সাড়া-ফেলে-দেওয়া কৃষি-আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া ‘ক্রোধ আর দ্রোহের কাল’টির দিকে ফিরে তাকানো হচ্ছে পঞ্চাশ বছর পরে।
অবশ্য ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ নিছক কৃষি আন্দোলন ছিল না। ১৯৬৭ সালের মে মাসে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ি জনপদে কৃষিজীবীদের অধিকার আদায়ের জন্য জঙ্গি অভ্যুত্থানে এর সূত্রপাত। কিন্তু পরবর্তী দশ বছর ধরে তা কৃষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের গণ্ডি ছাড়িয়ে সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে এক পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সংগ্রামের চেহারা নিয়েছে। মার্ক্স, লেনিন আর মাও ৎসে তুং-এর চিন্তাধারায় দীক্ষিত সংগ্রামের নেতারা বুঝেছিলেন, কৃষিজীবী এবং সাধারণ মানুষের অধিকার আদায় করতে হলে আগে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে। ফলে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান অচিরেই পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রশক্তিবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধে।
দ্য এজ অব রেজ অ্যান্ড রেবেলিয়ন: ফিফটি ইয়ার্স আফটার দ্য স্প্রিং থান্ডার (আ ফ্রন্টিয়ার অ্যান্থোলজি)
সম্পা: তিমির বসু, তরুণ বসু
৩০০.০০
ফ্রন্টিয়ার পাবলিকেশন
এখানেই ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ ভারতের কৃষক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ব্যতিক্রম। এটি যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্বে ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া তেলঙ্গানা, পুন্নাপ্রা-ভায়লার আর তেভাগার উত্তরসূরি, তেমনই আরও আগে কৃষক আর নিম্নবর্গের মানুষদের দ্বারা সংগঠিত বাংলার নীল বিদ্রোহ, পুব বাংলায় পাবনার কৃষক অভ্যুত্থান, সমসাময়িক মরাঠওয়াড়া অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহ, মালাবারের মোপলা বিদ্রোহ, জঙ্গলমহলের চুয়াড় বিদ্রোহ, ওড়িশার পাইক বিদ্রোহ, সাঁওতাল পরগনার আদিবাসী মানুষদের দ্বারা সংগঠিত সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ আর ওঁরাও বিদ্রোহগুলিও এর পূর্বসূরি। এমনকি ধর্মীয় পরিসরে জন্ম নেওয়া কিন্তু মূলত কৃষিজীবী মানুষদের নিয়ে সংগঠিত ফরাজি আর ওয়াহাবি আন্দোলনগুলিও এক অর্থে ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’-এর পূর্বসূরি। কৃষিজীবী মানুষদের অধিকার আদায়ের এই সব আন্দোলনে প্রতিপক্ষ ছিল স্থানীয় সামন্তপ্রভুরা। অধিকাংশ আন্দোলনের রাজনৈতিক ভিত্তিও ছিল দুর্বল। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক সরকার প্রয়োজন বুঝে সামন্তপ্রভুদের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠে রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন দমন করেছে। তবে তেলঙ্গানা, পুন্নাপ্রা-ভায়লার আর তেভাগা আন্দোলনে বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব স্পষ্ট। এবং এই সব আন্দোলনের মোকাবিলায় রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকাও প্রত্যক্ষ। সদ্য-স্বাধীন ভারতের নতুন সংবিধান কার্যকর হওয়ার দেড় বছরের মধ্যেই সেটির প্রথম সংশোধনীটি পাশ করানোর পিছনে এই আন্দোলনগুলির পরোক্ষ চাপও যে ছিল, তা আইনসভার কার্যবিবরণী দেখলেই বোঝা যাবে। সেই ঐতিহ্যকেই আরও পুষ্ট করে নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান মতাদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রশক্তিবিরোধী কার্যক্রমের উপর জোর দিয়েছিল।
সরাসরি রাষ্ট্রশক্তিকে আঘাত করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল বলেই নকশালবাড়ি আন্দোলন ব্যতিক্রম। গ্রামের কৃষিজীবীরা ছাড়াও এই আন্দোলনে শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষদের অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যাঘাতও ছিল অভূতপূর্ব। এই কারণেই আন্দোলন নিয়ে লাগাতার চর্চা জারি ছিল সেই সময়। খবরের কাগজ আর পত্রপত্রিকা তো বটেই, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্য মাধ্যমগুলিও হয়ে উঠেছিল এই চর্চার ক্ষেত্র। ফলে সাংস্কৃতিক পুঁজির এক উল্লেখযোগ্য সম্ভার তৈরি হয়েছে আন্দোলনটিকে ঘিরে। সেই পুঁজির এক গুরুত্বপূর্ণ আধার ছিল সমর সেন প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পাদিত ফ্রন্টিয়ার পত্রিকা। আন্দোলনের নানা খুঁটিনাটি ধারাবিবরণীর মতো প্রকাশিত হত পত্রিকার পাতায়। প্রকাশিত হত তাত্ত্বিক বিতর্ক। অভ্যুত্থানের দশ বছরের মাথায় সে সবের নির্বাচিত সঙ্কলন বেরিয়েছিল সমর সেনের নেতৃত্বে গঠিত সম্পাদকমণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে, নকশালবাড়ি অ্যান্ড আফটার নামে দুই খণ্ডে। তার পরেও এই পত্রিকার পাতায় আন্দোলনটিকে ঘিরে আলোচনা থেমে থাকেনি।
আলোচ্য বইটি অভ্যুত্থানের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে ফ্রন্টিয়ার-এর পাতায় প্রকাশিত একগুচ্ছ প্রবন্ধের নির্বাচিত সঙ্কলন। নকশালবাড়ি অ্যান্ড আফটার সঙ্কলনটির নামকরণেই সামনে তাকানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তখনও পশ্চাদপসরণকে মনে হচ্ছিল সাময়িক। অধিকাংশ লেখাতেই ফুটে উঠেছিল হার-না-মেনে ফিরে আসার জেদ। আলোচ্য সঙ্কলনে মূল সুরটা পিছনে ফিরে দেখার। সঙ্কলনের লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায়, তখনকার ছাত্র যুবক শিক্ষক আর সাংবাদিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আজও কেমন একাত্ম বোধ করেন আন্দোলনের সঙ্গে। বেশির ভাগ লেখাই হয় স্মৃতিচারণ, নাহয় পুরনো ঘটনার কার্যকারণ সমীক্ষা আর ফলাফলের বিশ্লেষণ। স্মৃতিচারণ করেছেন যাঁরা (যেমন শুভেন্দু দাশগুপ্ত বা সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়), তাঁরা দেখিয়েছেন কী ভাবে সমসাময়িক রাজনীতির প্রেক্ষিতে একদল ব্যক্তিমানুষের চেতনা রূপান্তরিত হয়েছিল। জীবন আর জীবিকার ঝুঁকি আছে জেনেও বহু মানুষ এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন— সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে, এক মহান আদর্শের টানে। আর সমীক্ষামূলক বা বিশ্লেষণাত্মক লেখাগুলোয় ফুটে ওঠে আত্ম-সমালোচনার সুর। জীবনপণ সংগ্রামে লক্ষ্যপূরণের জন্য সাহস, জেদ আর অস্ত্রই যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হলে দরকার যথাযথ রণনীতি আর রণকৌশল। সন্তোষ রাণা বা দেবব্রত পান্ডার মতো লেখকেরা জানিয়েছেন, সশস্ত্র বিপ্লবে গেরিলা যুদ্ধ করার পাশাপাশি গণ-সংগঠনের এক ব্যাপক ভিত্তি তৈরি করার দরকার ছিল। গেরিলা যুদ্ধের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে ব্যাপক জনসমর্থনের উপর। অথচ লড়াই যখন তুঙ্গে, তখন জনসমর্থন আর গণ-সংগঠনের বিষয়টি অবহেলিত হয়েছিল। উপযুক্ত জন-সংযোগের অভাবে আন্দোলন বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। ছড়ানো হয়েছে বদনামও, যার জের এখনও চলছে। কয়েকটি লেখা— বিশেষ করে রণবীর সমাদ্দারের প্রবন্ধটি— বলে আন্দোলন থেকে উদ্ভূত সাংস্কৃতিক পুঁজির কথা। পাশাপাশি লরেন্স লিফসুল্জ, ইয়ান মিরডাল বা ফারুক চৌধুরীর মতো বিদেশি ভাষ্যকারের লেখায় ফুটে ওঠে আন্দোলনের আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা। ফলে একটা বহুমাত্রিক চেহারা পেয়ে যায় সঙ্কলনটি।
এই বহুমাত্রিকতার পাশাপাশি আছে একটা ধ্রুবপদ। ‘ব্যর্থতা’ সত্ত্বেও নকশালবাড়ি আন্দোলনের মূল অভিমুখগুলো আজও প্রাসঙ্গিক— অর্থনৈতিক শোষণ আর চিন্তার পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। উনিশ বা বিশ শতকের আর কোনও আন্দোলন একই সঙ্গে এই দু’টি আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়নি। এ কথা মনে রেখেই ১৯৭৮ সালে সমর সেন লিখেছিলেন, নকশালবাড়ির পরে কিছুই আর আগের মতো থাকল না। তাঁর কথাগুলোই ফিরে ফিরে এসেছে সঙ্কলনের অনেক লেখায়। লেখকরাও অনেকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, আজকের মাওবাদীদের কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রেই ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’-এর অনুসারী, যদিও আঘাত-প্রত্যাঘাতের মাত্রাগুলি এখন অনেকটাই বেশি।