সম্মিলন: চিত্রাঙ্গদা-র কলাকুশলীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, দিল্লিতে।
ভারতের সংস্কৃতির ইতিহাস লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে খুঁটি ধরে এগোতে গেলে হ্যাঁচকা টান পড়ে এক দিকে শাস্ত্রীয় শুদ্ধতা প্রমাণের, অন্য দিকে আঞ্চলিকতা বা বাঙালিয়ানার শিকড় রক্ষার দায়ের। এ দেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং ঐতিহ্যের সংস্কৃতি যখন মূলত ধ্রুপদী বা লোকায়ত পথে চলে, তখন রবীন্দ্রনাথের আন্তর্দেশিক, আধুনিক ও মিশ্র ধারার নৃত্যগীত জন্মগত ভাবেই খাপছাড়া, এ কথা তিনি নিজেও জানতেন। ১৯৩৮ সালে চণ্ডালিকা রচনার সময় অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছিলেন, “খ্যাতির দিক থেকে এর দাম নেই বললেই চলে। প্রথমত, বিদেশী হাটে রপ্তানি করবার মাল এ নয়, দ্বিতীয়ত, দেশের মাতব্বর লোকেরা এর খাতির করবেন বলে আশাই করিনে। যদি করেন তবে প্রভূত মুরুব্বিয়ানা মিশিয়ে করবেন।”
তাঁর রচনার শ্লেষবিদ্ধ সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর। জাতীয় রাষ্ট্রনীতিতে যখন উচ্চগ্রাম রাজনীতির আস্ফালন, তখন পুরুষোচিত কর্মকাণ্ড থেকে কিছুটা দূরে থেকেই মন দিয়েছিলেন ‘নারীসুলভ’ নৃত্য-গীতের মঞ্চায়নে। মাঝে মাঝে তাঁর মন বলেছে যদিও, “লাগিব দেশের হিতে/ গরমে বাদলে শীতে/ কবিতা, নাটকে, গীতে/ করিব না অনাসৃষ্টি।” তবে সুর বদলেই পরমুহূর্তে বলছেন, “অসম্ভব আশাতীত/ অনাবশ্য অনাদৃত/ এনে দাও অযাচিত/ যত কিছু অনাসৃষ্টি।” সেই আশাতীত অনাসৃষ্টিরই নানা রূপ ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নাচে, গানে, নাটকে। তবে, তাঁর সঙ্গীত ও নৃত্যের জগৎ নিয়ে বৌদ্ধিক বিশ্লেষণ তুলনায় কম। বিশেষত কলাবিদ্যার প্রয়োগ বা পারফর্ম্যান্স যখন অক্ষরে ও শব্দে আটকে না থেকে স্টেজের উপর সশরীর অবয়ব ধারণ করে, তখন সেই বিমূর্ত আখ্যান থেকে মূর্ত উপস্থাপনা ‘অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্স’-এর বিচার্য হয়ে ওঠে না সব সময়।
দ্বিধা রয়ে যায় দু’তরফেই— অ্যাকাডেমিক এবং/বনাম পারফরমারের। সেই দোটানা থেকেই বোধ হয় এক রবীন্দ্র-গবেষক অতীতে লিখেছিলেন যে, নিছক তাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে পারফর্মিং আর্টের অন্দরমহলে ঢোকা যায় না। ‘তেহাই’, ‘তৎকার’, ‘ভ্রমরী’ কী সেটা পদক্ষেপ দিয়েই বুঝতে হয়— নচেৎ তাল কেটে যায় তত্ত্বে আর নৃত্য-গীতে। শুধু দর্শক ও পাঠক হয়ে প্রায়োগিক শিল্পকলার চর্চা ঝুঁকির কাজ। কার্যক্ষেত্রে যদিও এই তাল-বেতালের ভারসাম্য না রেখেই অনেকে— যাঁরা তথাকথিত ভাবে ‘নাচ-টাচ’ বোঝেন না— তত্ত্ব সহকারে নানা বিদগ্ধ প্রবন্ধ রচনা করেন; আর যাঁরা নাচ-গান করেন, তাঁরা সচরাচর গবেষণার পথে হাঁটেন না। ফলত তত্ত্ব আর প্রয়োগের ফারাকটা রয়েই যায়।
শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় ও সমীপেষু দাস সম্পাদিত নৃত্য ও সংগীতকলায় রবীন্দ্রনাথ সেই ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। সাধুবাদ প্রকাশনাকে। দুই মলাটের ভিতর এমন ষোলোটি গবেষণা-প্রবন্ধ তাঁরা তুলে এনেছেন যা পারফর্মিং আর্টের অ্যাকাডেমিক জ্ঞানচর্চা ও পেডাগজিকে সমৃদ্ধ করবে। যে এক ঝাঁক গবেষক এখানে রবীন্দ্র-অনুধ্যানের তৎকালীন ও সমসাময়িক নানা বিষয়ে নতুন করে আলো ফেললেন, তাঁরা একাধারে শিক্ষক-গবেষক, আবার অভিজ্ঞ শিল্পীও।
নৃত্য ও সংগীতকলায় রবীন্দ্রনাথসম্পা: শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৫০০.০০
কারিগর
নানা ভাবে ছড়িয়ে পড়া রবীন্দ্রনাথের গানকে এক সময় গোছানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী ও শৈলজারঞ্জন মজুমদার। ইন্দিরা বলেছিলেন, “আমার জীবনের যতদূর পর্যন্ত দেখতে পাই যেন সামনে এক বিস্তীর্ণ স্বরলিপির মরুভূমি পড়ে রয়েছে, তাঁর মাঝে মাঝে রেফ ও হসন্তের কাঁটাগাছ।” এই সঙ্কলনে রোশ্মিতা নন্দী বিশদে আলোচনা করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসারে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর অবদান। অন্য দিকে, কৌশিক সরকার আলোকপাত করেছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদারের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার নানা দিক নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গের গানে পাখোয়াজ চর্চা ও রবীন্দ্র-সৃষ্ট তালে পাখোয়াজের ব্যবহার নিয়ে লিখেছেন অভি ঘড়াই। শান্তিনিকেতনের নৃত্য, রবীন্দ্রসাহিত্য-নির্ভর নৃত্য, রবীন্দ্র প্রবর্তিত নৃত্য— কতগুলো ধারা পেরিয়ে কী ভাবে এক মিশ্র শিল্পরূপ রবীন্দ্রনৃত্য হয়ে উঠল, তার সজীব আলোচনা করেছেন সমীপেষু দাস। মেয়েদের মধ্যে মণিপুরির প্রসার আর তথাকথিত ‘পুরুষোচিত’ নাচে কথাকলির প্রয়োগ নিয়ে লিখেছেন যথাক্রমে সোনম দত্ত ও সুকান্ত বাগদী। সোমঋতা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, কী ভাবে রবীন্দ্রনাথের অধিনায়কত্বে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে সৃষ্ট নৃত্য মধ্যবিত্ত মেয়ের শখ থেকে জ্ঞানচর্চা ও জীবিকা হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-রোমন্থন ও পত্রাবলিতে জাভা-বালির নৃত্যগীতের খবর যতটা পাওয়া যায়, বর্তমান রবীন্দ্রনৃত্যে ততটাই আবছায়া হয়ে এসেছে গেমলান ও শ্রিম্পী নাচের ছায়া। বালি দ্বীপে তিন বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার নিরিখে পম্পী পাল জাভা ও বালি দ্বীপের নাচ, গান ও পোশাকের বিশদ আলোচনা করেছেন ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের কথোপকথনে। রবীন্দ্রোত্তর যুগে সমকালীন নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের নৃত্যনির্মাণে রবীন্দ্রনৃত্যের বিনির্মাণ নিয়ে লিখেছেন ডালিয়া কর্মকার। রবীন্দ্রভারতী ও শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার তফাত, রবীন্দ্রনৃত্যের নানা ধারা ও পরিবেশনার কথা লিখেছেন ইলিয়া দাস মুখোপাধ্যায়। কাবেরী সেন প্রশ্ন তুলেছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত আধারিত যে কোনও নৃত্যই কি রবীন্দ্রনৃত্য? না কি যে কোনও শাস্ত্রীয় শৈলীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নৃত্য কি আবার হয়ে যায় শাস্ত্রীয় নৃত্য? রবীন্দ্রনৃত্যের মূল মাইলফলকগুলিকে ধরার চেষ্টা করেছেন মেহেলী সাঁই। রত্নদ্বীপ রায় ত্রিপুরা-শাসিত উদয়পুরে রবীন্দ্রনৃত্য-চর্চার হদিস খুঁজে পেয়েছেন। শুভদীপ সরকার বেছে নিয়েছেন বৌদ্ধ ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যগুলিকে। একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ও পরিপ্রেক্ষিতে তমালিকা দে ও সন্তু মণ্ডল লোকসংস্কৃতির সঙ্গে রবীন্দ্র-সংস্কৃতির চলাচল লক্ষ করেছেন।
তবে, আরও একটি বেশি ছড়ানো যেত গবেষণার ক্ষেত্রকে। পাদটীকার পুনরাবৃত্তি এড়ানো যেত। রবীন্দ্র-গবেষণার বিশ্বজোড়া বিস্তৃত রূপকে ধরা যেত আর একটু হাত বাড়িয়েই। রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ও সঙ্গীতের জগৎ ভাবনার ক্ষেত্রেও এক মুক্ত পরিসর রচনা করেছিল; তিনিই স্বয়ং পথ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘মহাজনের ওস্তাদি’কে কদর না করে ভাঙাচোরা এক ‘উচ্ছৃঙ্খলার ইডিয়ম’ আয়ত্ত করতে। দরবার বা মন্দির নয়, শাস্ত্রীয় বা লোকায়ত নয়, প্রাচীন, স্থির ও ধ্রুব ঐতিহ্যের বাইরে তাঁর সৃষ্ট নৃত্য এবং সঙ্গীত নানা মুহূর্তে নানা কিছু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছে আজও। এই গ্রন্থে সেই সম্ভাবনা অনেকটাই সফল আকার ধারণ করেছে।