উদয়াস্ত: দিনের কাজ শেষে ঘরে ফেরা। ঝাড়খণ্ডের হাজারীবাগ জেলায়
যুদ্ধক্ষেত্র বলতে পিয়ের বেজ়ুকভ জেনে এসেছে ইতিহাসের বইয়ে পড়া বর্ণনা আর ছবিতে আঁকা যুদ্ধের দৃশ্য। তার কাছে এগুলোই যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা। অথচ, প্রকৃত এক যুদ্ধক্ষেত্রে এসে সে দেখছে, “এক জীবন্ত ভূ-দৃশ্য”, যেখানে “এমনকি আমাদের সৈন্যদেরকে সে ওদের সৈন্যদের থেকে আলাদাও করতে পারছে না।” ঊনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়াতে টলস্টয় ওয়র অ্যান্ড পিস-এ বেজ়ুকভের চোখ দিয়ে ধারণা ও বাস্তবের যে বৈপরীত্য তুলে ধরছেন, একবিংশ শতাব্দীর সমাজচর্চায় সেটা বোধ হয় অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমাদের কালের সমাজচর্চা অনেক এগিয়েছে, তার পরিসর বেড়েছে, কিন্তু পাশাপাশি সমাজকে খণ্ড খণ্ড ভাবে জানার এবং দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য সহজ মোটরগাড়ির রাস্তা ধরার ঝোঁকও বেড়েছে অনেক বেশি। এরই মধ্যে, সুখের কথা, কেউ কেউ মেঠো পথে হাঁটার ক্লেশকেই জীবনের অর্জন হিসাবে গ্রহণ করেছেন। একদা সমাজকর্মী, অধুনা বিদ্যানুশীলক নিত্যা রাও এই দ্বিতীয় গোত্রের সমাজ বিশ্লেষক। তাঁর সাম্প্রতিক বইটি তিন দশক ধরে আক্ষরিক অর্থে হেঁটে হেঁটে জ্ঞান আহরণের ফসল।
কত পথ হেঁটেছেন, তার বিবরণ তিনি লেখেননি, কিন্তু ঝাড়খণ্ড রাজ্যটির অতীত ও বর্তমান সম্পর্কিত যে বহুমাত্রিক আলোচনা এ বইতে আছে, তা থেকে বোঝা যায়, জ্ঞান সঞ্চয় করার জন্য বহু জায়গাতেই হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। দীর্ঘ আন্দোলনের ফল হিসাবে, ২০০০ সালের নভেম্বরে তৎকালীন বিহার রাজ্যের দক্ষিণ ভাগের জেলাগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় আলাদা রাজ্য ঝাড়খণ্ড। যদিও বিহার রাজ্যের ৭০ শতাংশ রাজস্ব আসত এই অঞ্চল থেকেই, কিন্তু ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলা শোষণ ও বঞ্চনার ধারাবাহিকতায় অঞ্চলটির বিকাশের জন্য মোট সরকারি ব্যয়ের অতি তুচ্ছ অংশই বরাদ্দ থাকত। এই ক্ষেত্রের ভূমিকে কৃষিযোগ্য করে তুলেছিলেন আদিবাসীরা। তাঁদের বিরাট অংশ নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পরবাসী হলেন, আর যাঁরা থেকে গেলেন তাঁরা পরিণত হলেন দিনমজুরে। এর “অর্থ দাঁড়াল, তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি এবং রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক অবস্থান হারিয়ে ফেলা।” এর বিরাট প্রভাব পড়ল সামাজিক পরিসরে, বিশেষত নারীজীবনে। টিকে থাকার সংগ্রামে দেশান্তরি মজুর হিসাবে যোগ দেওয়াটা যেন হয়ে উঠল মেয়েদের বিধিলিপি। আবার, নিজভূমে আদিবাসীদের যেটুকু জমির মালিকানা থাকল, তাতেও মেয়েদের অধিকার থাকল না, আদিবাসী পরম্পরাগত ব্যবস্থা তাঁদের ভূমির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করল। অন্য দিকে, রাষ্ট্রীয় নীতিগত বঞ্চনার কারণে আদিবাসীরা সাধারণ ভাবে যে অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অপুষ্টি ও রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতার শিকার হলেন, নারীদের ক্ষেত্রে তা বিশেষ কুৎসিত রূপ ধারণ করল।
কোয়েস্ট ফর আইডেন্টিটি: জেন্ডার, ল্যান্ড অ্যান্ড মাইগ্রেশন ইন কন্টেম্পোরারি ঝাড়খণ্ড
নিত্যা রাও
১১৯৫.০০
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস
ঝাড়খণ্ড এবং অন্যত্র বসবাসকারী আদিবাসীদের নিয়ে সমাজ-বৈজ্ঞানিক চর্চা কিছু কম নেই। কিন্তু, সমস্যা হল, যে কথা গোড়াতেই উল্লেখ করেছি, বিষয়টাকে খণ্ড খণ্ড ভাবে দেখা। উদাহরণ হিসাবে, গত শতাব্দীর শেষের দিকে তৎকালীন ভারতে অগ্নিবর্ষী নারীবাদী হিসাবে পরিচিত মধু কিশোয়ার আদালতে একটা মামলা করলেন। হো আদিবাসী মহিলা, মাকি বুই ও সোনামুনি কুই, পরম্পরাগত ব্যবস্থার কারণে জমির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন। সুপ্রিম কোর্ট বহু দিন ফেলে রেখে মামলা পাঠায় বিহার হাই কোর্টে। সেখানেও নিষ্পত্তি হল না। কিন্তু তত দিনে মাকি ও সোনামুনির অনাহারে ও অযত্নে মৃত্যু ঘটেছে। আদালতে যাওয়ার জন্য সমাজ তাঁদের পরিত্যাগ করে। সমস্যা হল, শুধু মধু কিশোয়ারই নন, গবেষক থেকে সরকারি ও অ-সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা পর্যন্ত বিভিন্ন ‘পরিবর্তনকামী’দের কেউ হাতির লেজ দেখছেন, কেউ বা দাঁত। নিত্যার বইটির গুরুত্ব এই যে, এখানে কেবল হাতিটিকে তার পূর্ণাঙ্গ রূপে দেখার চেষ্টাই হয়নি, সেটিকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে দেখাটাকে তিনি একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ধারণা ও বাস্তবের বৈপরীত্য ভেঙে, শিখতে শিখতে এগিয়েছেন। বইটিতে জমির সঙ্গে শ্রমের সম্পর্ক, জমি ও শ্রমের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার সম্পর্ক, আবার ক্ষমতার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ, এবং রাষ্ট্রীয় নীতি, আইন ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নানা দিক নিয়ে স্বতন্ত্র কিন্তু সমন্বিত আলোচনা ভারতরাষ্ট্রে আদিবাসীদের অবস্থানটিকে তুলে ধরে। পাশাপাশি, এই আলোচনা সাধারণ ভাবেই নারী-পুরুষ সম্পর্ক, পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্ক, ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় নীতির সম্পর্কগুলোকে স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়।
এরই সঙ্গে নিত্যা দেখান যে, বঞ্চনা ও উৎপীড়ন যেমন সত্য, তেমনই এগুলোর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের নানা স্তরের সংগ্রামও সত্য। তিনি দেখাচ্ছেন, কী ভাবে আদিবাসী যুবসমাজ শিক্ষাকে নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছে। কী ভাবে তারা নিজেদের জীবনকুশলতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সরকারি অপদার্থতার কারণে ব্যর্থ হচ্ছে। কী ভাবে দেশান্তর এক দিকে তাদের জীবনে একটা জীবন্ত নিপীড়ন হিসাবে নেমে আসছে, কিন্তু আবার তাকেই কাজে লাগিয়ে কী ভাবে তারা নিজেদের এক ভিন্নতর, বিকশিত পরিচিতি গড়ে তুলছে। আবার পারিবারিক স্তরে, কী ভাবে সহযোগিতা ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কগুলো বদলে যাচ্ছে, যা আবার বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে মেয়েদের জমির অধিকারের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে।
এরই সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক পরিচিতির চেহারা: আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ আটকাতে ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হয়েছিল ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট ও সাঁওতাল পরগনা টেনান্সি অ্যাক্ট। ঝাড়খণ্ডের বিজেপি নেতৃত্বাধীন রঘুবর দাস সরকার আদিবাসীদের সেই সীমিত অধিকারও কেড়ে নিতে উদ্যত হল, এটা আদিবাসীদের উপর অ-আদিবাসীদের প্রভুত্ব বজায় রাখার ব্যাপার তো বটেই, তার সঙ্গে আরও কিছু: আদানির মতো পুঁজি-মালিকদের হাতে বিপুল-বিস্তৃত জমি তুলে দেওয়া। যে প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশ রাজ আদিবাসীদের দিনমজুরে পরিণত করেছিল, সেই প্রক্রিয়াতেই তাঁদের সর্বহারাত্ব সম্পন্ন করার জন্য আদিবাসী জীবনের অঙ্গ, পাহাড়, অরণ্য, নদীর মতো প্রকৃতিদত্ত সর্বভোগ্যগুলিকে বৃহৎ পুঁজির একচেটিয়া অধিকারে পরিণত করার উদ্যোগ করে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার। সে সরকার ভোটে হেরেছে ঠিকই, কিন্তু তার প্রোথিত বিষবৃক্ষ উৎপাটিত হয়নি। এ সম্পর্কিত অনুধাবনটি কেবল ঝাড়খণ্ড বা আদিবাসীদের সমস্যা বোঝার জন্যই নয়, সারা দেশের রাজনৈতিক-আর্থনীতিক গতিটিকে বোঝার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজির আগ্রাসন সামাজিক ক্ষেত্রটিকে পারিবারিক স্তর পর্যন্ত টেনে আনছে, যাতে আবার আদিবাসীদের, বিশেষত আদিবাসী নারীদের অবস্থা হয়ে পড়ছে অধিকতর বিপজ্জনক।
এর বিরুদ্ধে, বিশেষ করে আদিবাসী যুবসমাজের মধ্যে একটা বহুস্তরীয় প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। তার কিছুটা দৃশ্যমান, যেমন পাতালগঢ়ীর আন্দোলনে, আবার অনেকটাই অভ্যন্তরস্থ, যাকে ভাল ভাবে বুঝতে গেলে কেবল গবেষণাপদ্ধতিগত কূটতর্কের বাইরে বেরিয়ে, নিত্যার ভাষায়, “প্রক্রিয়াটিকে বুঝতে হবে”। তার জন্য, নিত্যার উপসংহার, বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই বদলাতে হবে— যা তিনি নিজে করেছেন। আদিবাসীদের, বিশেষত, যুবসমাজকে পরিবর্তনের কারক হিসাবে দেখতে হবে, তাঁদের পরিচিতির নানা দিকগুলিকে দেখতে হবে, তাঁদের জ্ঞানভান্ডার থেকে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। আদিবাসী যুবসমাজের মধ্যে তিনি সামূহিক আন্দোলনকে পুনরুদ্ধার করার যে স্বপ্ন ও শক্তি দেখতে পেয়েছেন, দীর্ঘ, শ্রমসাধ্য গবেষণা ও সহভাগিতা থেকে পাওয়া সেই অন্তর্দৃষ্টি বইটিকে বাস্তবিকই একটি সামাজিক অবদান করে তুলেছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চমৎকার লিখনশৈলী— কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি শিখেছেন কী ভাবে লেখা থেকে ‘পাণ্ডিত্য’-এর কাঁটা সরিয়ে রাখতে হয়।