Sourced by the ABP
শ্রদ্ধেয় নাট্য-অগ্রজ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নাটকে প্রধান চরিত্র যাত্রাপালার এক বাতিল নট সময়ের কথা বলতে গিয়ে বলছে, সে “বড় সেয়ানা সাজ মাস্টার। সব কাজের ফাঁকে কখন যে বুড়ো তোমার মুখে কালো তুলির আঁচড়ে ঠিক বয়েস এঁকে দিয়ে যাচ্ছে তুমি কিছু বুঝতেই পারছ না, তাই না?” একটু পরেই আবেগের এক তুঙ্গ মুহূর্তে সে বলছে, “আমি একটা ঘর চেয়েছিলাম। তিন দেওয়ালওয়ালা একটা ঘর। আশা ছিল, তার চতুর্থ দেওয়াল আমি নিজে হব। সে একটা সাজঘর। সেখানে ক্রেপ, স্পিরিটগাম, জিঙ্কের মদির গন্ধে আমি সাজব।” সময় যে তার নিজের সাজঘরে তুলির আঁচড়ে মানুষের মুখে এঁকে দিচ্ছে জীবনের বলিরেখা, অজিতেশের নাটকের এই সব অমোঘ চিত্রকল্প মনে এল, কারণ কৌশিক সেন তাঁর নিবন্ধ সঙ্কলনের নাম দিয়েছেন সময়ের সাজঘরে।
বস্তুত কৌশিক সেনকেও আমরা দেখতে পেয়েছি, তাঁর অগ্রজ এবং সমকালীন আরও অনেক নাট্যজনের মতোই, সময়ের সাজঘর থেকে বেরিয়ে আসতে নানা ভূমিকার মোকাবিলায়। নাটকের নির্দেশনা ও অভিনয়ের কাজ, কখনও বা নাটক রচনা যদিও তাঁর প্রধান আগ্রহের বৃত্ত, তবু তার বাইরেও বড় ও ছোট পর্দায় ক্রমাগত অভিনয় করে চলতে হয়েছে তাঁকে। এরই সঙ্গে তিনি অক্লান্ত থেকেছেন চার পাশের চলমান সমাজ ও রাজনীতির আবর্তের স্বরূপ-সন্ধানে, দূর থেকে নয়। নৈর্ব্যক্তিকতায় নয়, অংশীদারের সংরক্ততায়। এবং শিল্প ও জীবনের এই বহুমাত্রিকতাকে ধরতে চেয়েছেন তাঁর ছোট-বড় নানা লেখায়। গত দু’দশক জুড়ে কৌশিকের এই সব লেখা থেকে বেশ কয়েকটি বেছে নিয়ে সঙ্কলিত হয়েছে সময়ের সাজঘরে শীর্ষক এই গ্রন্থ। স্বভাবতই নাটকের মগ্ন সেবক কৌশিক এবং জীবনের ঢেউয়ে তোলপাড় কৌশিক, দ্বৈততার আলোছায়ায় মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে এই লেখাগুলি।
২০২৪-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত এই সঙ্কলনে ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে রচিত লেখাও জায়গা পেয়েছে। সবচেয়ে পুরনো লেখাও ২০০৪ বা ২০০৭-এর রচনা। অর্থাৎ, প্রায় দু’দশকের সৃষ্টির কাজের ইতিবৃত্তের সঙ্গে এখানে সমান গুরুত্ব নিয়ে স্থান পেয়েছে সমান্তরাল সমাজ-রাজনীতির প্রতিবাদ-আন্দোলনের ভাষ্য। সঙ্গে রয়েছে সমকালের এক মহৎ অভিনয়-শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃজনপ্রতিভার প্রতি কৌশিকের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদক তিনটি লেখা। তিনটি পর্বে বিন্যস্ত রচনাগুলির প্রথমেই রয়েছে থিয়েটার-শিল্প-সময় বিষয়ে কিছু অতীব তাৎপর্যময় রচনা। কখনও সেই পরিসরে উঠে এসেছে বুদ্ধদেব বসু থেকে মনোজ মিত্র হয়ে ব্রাত্য বসু পর্যন্ত নাটককারীদের নাটকের মর্মবস্তুর নিবিড় অনুসন্ধান। কখনও বা সমকালের সহযোগী বন্ধু ব্রাত্য-সুমন-দেবেশদের মতান্তর, মনান্তর, ঝগড়া ও বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গ আখ্যান। বুদ্ধদেব বসুর কালসন্ধ্যা নাটকের কৃষ্ণ চরিত্রে ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনয় প্রসঙ্গে শিলাদিত্য সেনের সঙ্গে কৌশিকের এক আলাপচারিতা মূল্যবান হয়ে ওঠে যখন কৃষ্ণহত্যার সঙ্গে অন্বিত হয় গান্ধীহত্যার অনুষঙ্গ, পৌরাণিক মহাকাব্য এসে হাত ধরে সমকালের রাজনীতির। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৯৬৫-তে লেখা কবি ভারতচন্দ্রের জীবনীভিত্তিক উপন্যাস অমাবস্যার গান-এর একটি সম্ভাবনাময় নাট্যরূপ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। তারই আলোচনায় কৌশিক অনায়াসে ইউরিপিদেস থেকে উৎপল দত্ত পর্যন্ত ছুঁয়ে যান সাবলীল পারঙ্গমতায়। শিল্পীর সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ানে উঠে আসে ভারতচন্দ্রের খেদোক্তি: “আমি কী দিতে চেয়েছিলাম, আর কী দিলাম?”
সময়ের সাজঘরে
কৌশিক সেন
২৫০.০০
দে’জ়
নাট্যশিল্পের গৌরব ও পরাজয়ের এই সীমানাকে ছুঁয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে নিয়ে লেখা তিনটি গভীরগামী প্রতিবেদন এই সঙ্কলনের মর্যাদা বাড়িয়েছে। এদের মধ্যে ‘রঙ্গালয়ের এক দেবতা’ শীর্ষক প্রথম লেখাটি ২০০৭-এ প্রকাশিত, অর্থাৎ তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জীবিত ও জীবন্ত। পরের দু’টি লেখা ‘রেডি? এখনও তো নই’ এবং মাটির প্রদীপের শিখা’ তাঁর প্রয়াণ-পরবর্তী স্মৃতিচর্চা। তিনটি আলেখ্যতেই সাফল্য ও বিপন্নতার মাঝখানের গোধূলি-বলয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক অতৃপ্ত স্রষ্টার মুখচ্ছবি ফুটে উঠতে দেখি, দেখি নিরাপদ সীমানার বাইরে না-ছোঁয়া দিগন্তের ইশারায় নৌকা পুড়িয়ে বেরিয়ে পড়তে উন্মুখ এক সওদাগরকে। কৌশিকের কাছে আমাদের ঋণ বেড়ে যায় যখন দেখি গুরুদক্ষিণার নামে অহেতুক স্তুতিতে আটকে না থেকে তিনি গভীর সততায় খুঁজে নিতে চান এই সময়ের এক বড় শিল্পীর অন্তরমহলের সত্যকে।
সঙ্কলনের তৃতীয় বা শেষ পর্বে রয়েছে লেখকের রাজনৈতিক ভাবনা ও বিশ্বাসের প্রসঙ্গ। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দেড় দশকের সময়বৃত্তে এই বঙ্গের সমাজ ও রাজনীতিতে বহু আলোড়ন ঘটে গেছে। দীর্ঘকালের বামপন্থী শাসনের অবসান দেখেছি আমরা। দেখতে পেয়েছি, কংগ্রেসের জঠর থেকে বেরিয়ে আসা নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেসের অভাবনীয় বিকাশ ও প্রতিপত্তির ইতিবৃত্ত। আমরা দেখেছি, বহু শিল্পী, শিল্পকর্মী ও বুদ্ধিজীবী এই নতুন রাজনৈতিক উত্থানের পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মিছিলে-ময়দানে শামিল হয়েছেন। কৌশিক সেনও শিল্পীর নিরাপদ মিনারের উচ্চতা ছেড়ে বার বার এসে যোগ দিয়েছেন এই পরিবর্তনের আন্দোলনে। উজ্জীবিত হয়েছেন, বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, হতাশ হয়েছেন, কিন্তু প্রশ্ন করতে পিছপা হননি। কারণ তিনি জানেন, অন্ধতা দিয়ে প্রলয় আটকানো যায় না। চোখ খুলে রাখতে হয়, বোঝার চেষ্টা করে চলতে হয়, আর অবিরল অর্গলহীন ভাবে নিজের দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের যাচাই করে নিতে হয় ধাবমান সময়ের পটে। তৃতীয় পর্বের চোদ্দোটি ছোট-বড় লেখায় সময়ের সত্যকে চিনে নেওয়ার এই আকুলতা ধরা পড়েছে। প্রায় যেন এক সাংবাদিকের সংলাপের মতোই লাগে এই লেখাগুলি। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, এর মধ্যে তেরোটি লেখাই বেরিয়েছিল দৈনিক সংবাদপত্রে, এবং তারও মধ্যে বারোটি আনন্দবাজার পত্রিকা-য়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, শিল্প-সৃষ্টির ও তার স্রষ্টাদের নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধানের পাশাপাশি ঘটমান বর্তমানের রাজনৈতিক তোলপাড়ের রোজনামচা কি ভিন্ন সুর ও স্বরের বৈপরীত্য নিয়ে আসছে না? এর জন্য কি দু’টি ভিন্নধর্মী সঙ্কলনের পরিসর দরকার ছিল? আমার তা মনে হয়নি, কারণ অনেকের মতো আমারও বিশ্বাস, শিল্প ও জীবনকে দুই আলাদা প্রকোষ্ঠে রেখে শিল্পী বাঁচে না, দুইয়ের বিরোধ ও সঙ্গমেই আছে তার প্রাণবায়ু। শেক্সপিয়রের নায়ক যখন অভিনয়-শিক্ষা দানের দৃশ্যে নাট্যশিল্পীদের বলে, শেষ পর্যন্ত আমাদের কাজ হচ্ছে, “টু হোল্ড আপ দ্য মিরর আনটু নেচার,” তখন তো সে ‘নেচার’ বলতে পাহাড়-অরণ্য-সমুদ্র-আকাশের ‘নেচার’-এর কথা বলে না, বলে ‘হিউম্যান নেচার’-এর কথা, মানব-প্রকৃতির কথা, মানুষের জটিল মুখচ্ছবির কথা।
কৌশিকের বহু রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে আমি একমত না হতে পারি, বহু ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান আমার পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু যে সততা ও আন্তরিকতায় তিনি বার বার খুঁজে ফেরেন সেই পরিসর যেখানে ক্ষমতার অনুমোদনের বাইরে দাঁড়িয়ে শিল্পী বা মানুষ তার নিজের কথা বলবে, সেই অনুসন্ধানকে কুর্নিশ না জানিয়ে আমি পারি না। শেষ পর্যন্ত তাই এই শেষ পর্বের লেখাগুলি নিছক সাংবাদিক ভাষ্যের প্রত্যক্ষতার বাইরে আরও ধ্রুব, আরও বড়, কারণ সত্যের দ্যোতনা নিয়ে আসে।