বরণ: কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত সুভাষচন্দ্র বসুকে ঘিরে কর্মী ও গুণমুগ্ধরা
তিন বছর আগে প্রয়াত কৃষ্ণা বসুর নেতাজি-পরিবারে পদার্পণ তাইহোকুর বিমান-দুর্ঘটনার এক দশক পরে, সুভাষ-ভ্রাতা শরতের পূত্রবধূ হিসেবে। শ্বশুরমশাইকেও তিনি চাক্ষুষ দেখেননি, তিনিও প্রয়াত হন ১৯৫০ সালে। সুতরাং, নেতাজি ও তাঁর পরিবারের যে বহুবর্ণ চিত্র আমরা কৃষ্ণা বসুর অনেকগুলি লেখায় পাই, তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-প্রসূত নয়, বরং পারিবারিক অনুবৃত্তির আবহে এক নিবিড় গবেষণার ফসল। তাঁর লেখার চমৎকারিত্ব এখানেই যে, এই গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের ফলটিকে তিনি গবেষণা-সন্দর্ভের মতো গম্ভীর ও ওজনদার হয়ে উঠতে দেননি, বরং এক নির্ভার, অকপট শৈলীতে নেতাজির এমন এক ছবি তুলে ধরেছেন, যা পড়লে মনে হয় এ তাঁর আজীবন কোনও সখার লেখা, যেন দিলীপকুমার রায়ের মতো।
যে পরিবারে বিবাহসূত্রে কৃষ্ণার পদার্পণ, তার ইতিহাস এক যথার্থ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্মোচনেরই আখ্যান। কিন্তু সেই আখ্যানটি কৃষ্ণা পেশ করেন এক তরতরিয়ে এগিয়ে-চলা গল্পের ভঙ্গিতে, তাঁর চরণরেখা তব, ইতিহাসের সন্ধানে, বা প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র যাঁরাই পড়েছেন, তাঁরাই জানেন যে এই অতি কঠিন কাজটি তিনি করতেন কী অনায়াস ভঙ্গিতে। সেই ছিমছাম ভঙ্গিটি এই বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের টেনে রাখে এক দিকে ইতিহাসের বিশ্লেষণ এবং অন্য দিকে জনপরিসরে উন্মোচিত ইতিহাসের অন্তরালে ঐতিহাসিক মানুষগুলির ব্যক্তিচরিত্রের এক অন্তরঙ্গ বর্ণনার যৌগপদ্যে। সেই বর্ণনায় মানুষগুলি আমাদের ঠিক পাশটিতে এসে বসেন, আমাদের দূরাগত ইতিহাস সজীবতা ও নৈকট্যে সিঞ্চিত হয়ে ওঠে।
বইটি সাতটি পর্বে বিভক্ত। প্রতি পর্বে রয়েছে নেতাজির সঙ্গে এক-একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের সম্পর্কের বর্ণনা, যার মধ্যে রয়েছেন মা প্রভাবতী দেবী, বৌদি বিভাবতী, গুরুপত্নী দেশবন্ধু-জায়া বাসন্তী, স্ত্রী এমিলির মতো মহিলারা, রবীন্দ্রনাথ, নেহরু, হিটলার, ডি ভালেরার মতো নেতৃপুরুষরা, অথবা আজ়াদ হিন্দ বাহিনীর বীর সৈনিকেরা, যার মধ্যে আবিদ হাসান, মহম্মদ কিয়ানি বা আকবর শাহের মতো নেতাজির অনুগতজন যেমন আছেন, তেমনই রয়েছেন লক্ষ্মী সেহগল বা জানকী থেবারের মতো ঝাঁসির রানি রেজিমেন্টের বীরাঙ্গনারা, অথবা মণিপুর বা আন্দামানের রণাঙ্গনের অগণিত নির্ভীক জওয়ান। বিশ ও তিরিশের দশকে ইউরোপে নেতাজি যে ইউরোপীয় মহিলাদের সমর্থন ও বন্ধুত্ব অর্জন করেছিলেন, যেমন জেন ধর্মবীর, কিটি কুর্টি, নাওমি ভেটার বা হেডি ফুলপ-মিলার, তাঁদের সখ্য ও সহকারিতার কথা এক উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি। ‘রেকোয়েম’ বা ‘শোকগাথা’ নামে শেষ পর্বটি মর্মস্পর্শী, সেখানে আছে এক চমকপ্রদ সাক্ষাতের কথা। ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে যে দাম্ভিক ও জাতিবিদ্বেষী অধ্যাপক এডওয়ার্ড ওটেনের গায়ে হাত তোলার অপরাধে সুভাষচন্দ্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়, তার পঞ্চান্ন বছর পর কৃষ্ণা ও তাঁর স্বামী শিশিরকুমার লন্ডনের দক্ষিণ শহরতলিতে তাঁর বাড়ি গেলে সাতাশি বছরের বৃদ্ধ ওটেন চা, কেক ও স্যান্ডউইচ সহযোগে তাঁদের আপ্যায়ন করে আবৃত্তি করে শোনান তাইহোকুর বিমান-দুর্ঘটনার পর সুভাষচন্দ্রের উদ্দেশে লেখা তাঁর তর্পণ-চতুর্দশপদী, বিড়বিড় করে বলতে থাকেন “সুভাষ ওয়াজ় আ রিমার্কেবল ম্যান, আ রিমার্কেবল ম্যান।” সেই অত্যাশ্চর্য পুরুষের প্রয়াণস্থল তাইপেই বিমানবন্দরের অনতিদূরের এক হাসপাতাল, আর টোকিয়োর রেনকোজি মন্দিরে তাঁর চিতাভস্ম নিয়ে যাওয়ার আগে যেখানে কিছু দিন ছিল সেই দেহাবশেষ, সেই নিশি হোঙ্গানজি মন্দিরে শিশিরকুমার ও কৃষ্ণার এক আবেগসিক্ত পদচারণা দিয়ে এই বইটির সমাপ্তি।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস’জ় লাইফ,পলিটিক্স অ্যান্ড স্ট্রাগল
কৃষ্ণা বসু,
অনুবাদ ও সম্পা: সুমন্ত্র বসু
৬৯৯.০০
পিকাডোর ইন্ডিয়া
ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে নেতাজি সম্পর্কে গবেষণা কম হয়নি, কৃষ্ণার ইতিহাসবিদ পুত্র সুগত বসুর হিজ় ম্যাজেস্টি’স অপোনেন্ট: সুভাষ চন্দ্র বোস অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ় স্ট্রাগল এগেনস্ট এম্পায়ার (২০১৩) বইটিতেই রয়েছে এই অত্যাশ্চর্য ‘দেশনায়ক’-এর জীবন ও কর্মের এক বিশদ ও প্রামাণ্য আলোচনা। কিন্তু নেতাজি তো শুধু ইতিহাসের জটিল আবর্তে আন্দোলিত হতে-থাকা এক ব্যক্তিচরিত্রই নন শুধু, তাঁর অবয়ব ও চিত্রকল্পটিকে রক্তমাংসের শরীর দেয় তাঁর সান্নিধ্যে আসা বহু মানুষের জীবনও, যে সব নিয়ে গড়ে ওঠে এক বৃহৎ ও যথার্থই আন্তর্জাতিক পরিবার। কৃষ্ণা বসুর কলমে এই বহুস্বর কিন্তু সমধর্মী পরিবারটি জীবন্ত হয়ে ওঠে, নেতাজির আখ্যানটিও এই অগণিত জীবন-যোগে আরও যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার সবচেয়ে পছন্দের লেখাগুলি প্রথম অংশে, যেখানে রয়েছে পরিবারের মেয়েদের কথা— সেখানে আমরা জানতে পারি যে, সুভাষচন্দ্র ছিলেন মা-বাবার স্নেহের জন্য কাঙাল, যদিও তাঁদের সম্পর্কের আড় ঠিক ভাঙেনি; সম্পর্কের নৈকট্য বরং বেশি ছিল আর এক ‘মা’ বাসন্তী দেবীর সঙ্গে, যাঁর স্বহস্তে রাঁধা ‘ভাতে-ভাত’ ছিল যুবক সুভাষের অন্যতম প্রিয় খাবার; আবেগ সামলাতে না পেরে মাঝেমাঝেই কেঁদে ফেলার জন্য তাঁর পিছনে লাগতেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন; অথবা পয়সার দরকার পড়লে দুঁদে ব্যারিস্টার দাদা শরতের কাছে না গিয়ে যুবক সুভাষ শরণ নিতেন বৌদি বিভাবতীর। সাত বছরের বালক শিশিরকুমারের স্মৃতিতে স্পষ্ট, শিলঙে পারিবারিক ভ্রমণের অবসরে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছেন সুভাষ। এই ধরনের নানা আটপৌরে বিভঙ্গে চিত্রিত হয়ে ওঠে দেশনায়ক বা ‘নেতাজি’র এক অন্যতর, সাধারণগ্রাহ্য রূপ, আর সেটিকে এক বহুবর্ণ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই কৃষ্ণা বসুর এই বইয়ের অনন্যতা।
এই রূপটি অনেক গবেষকের কাছেই অধরা। বৃহৎ-ক্যানভাসে ধরা ইতিহাসের অগণিত কুশীলব, তাঁদের সঙ্গে কৃষ্ণার অনেক বছরব্যাপী ব্যক্তিগত আলাপচারীর নিভৃত অবসরে ধরা পড়ে অনেক বিধুর মুহূর্ত। যেমন অগস্ট ১৯৪৫-এর সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত, রান্নাঘরে কাজ করছেন এমিলি শেঙ্কল, পাশের ঘরে তিন বছরের অনিতা ঘুমন্ত, আর রেডিয়োতে ঘোষণা হচ্ছে ফরমোসায় বিমান-দুর্ঘটনায় ‘ভারতের কুইসলিং’ সুভাষচন্দ্রের ‘মৃত্যুসংবাদ’। অথবা, ১৯৭৪ সালে নেতাজি স্মারক বক্তৃতা দিতে এসে শরৎ বসু রোডের বাড়িতে কাঁটা-চামচ দিয়ে পাবদা মাছের ঝাল খেতে খেতে আবিদ হাসান বর্ণনা করছেন কী ভাবে তাঁর উদ্যোগেই শুরু হল আজ়াদ হিন্দ সৈনিকদের মুখে মুখে ‘জয় হিন্দ’ সম্ভাষণ, আর তাঁর হাতেই লেখা হল ‘জনগণমন’-র আদলে নতুন সমবেত-সঙ্গীত, ‘শুভ সুখ চৈন কী বরখা বরসে, ভারত-ভাগ হৈ জাগা’।
সব মিলিয়ে, এক অনন্য বই। লেখাগুলির অধিকাংশই বাংলায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বা সম্পাদিত গ্রন্থে পূর্বপ্রকাশিত, আর দু’-একটি আদিতে ইংরেজিতেই লেখা। ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য পরিমার্জন-সহ বাংলা লেখাগুলিকে অনুবাদ করেছেন লেখকের কনিষ্ঠ পুত্র, প্রতিষ্ঠিত সমাজবিজ্ঞানী সুমন্ত্র বসু। সুমন্ত্র যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তাঁর মায়ের ঋজু ও নির্ভার লিখনশৈলীর প্রসাদগুণটি ভাষান্তরেও বজায় রাখতে, সে কাজে তিনি অনেকাংশে সফল। তবু, মাঝে-মাঝে একটু খটকা লাগে তরতরিয়ে এগিয়ে-চলা আখ্যানের প্রবাহের মধ্যে মধ্যেই তাঁর ‘ইন-টেক্সট’ সম্পাদকীয় টিপ্পনীর বাহুল্যে, মনে হয় এগুলিকে কি পাদটীকায় বা অন্ত্যটীকায় সংযোজিত করা যেত না? ওই সংশয়ের রেশটুকু অবশ্য মিলিয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই, বইয়ের মাহাত্ম্য তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না।