যুদ্ধযাত্রা: প্রথম ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধের প্রস্তুতি, শিল্পীর লিথোগ্রাফে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
দমদম অর্ডন্যান্স কারখানার বাইরে আজও দেখা যায় ১৮৪২ সালের ইংরেজ-আফগান যুদ্ধের স্মারক। ময়দানে গোর্খা-যুদ্ধজয়ী অকটারলোনির খাতিরে তৈরি মিনারের মতো নকশা, কিন্তু মোটেই উঁচু নয়, খানিকটা অবহেলিতই, কারণ ময়দানে বিজয়স্তম্ভ, এখানে শোকস্তম্ভ। প্রথম আফগান যুদ্ধে ইংরেজের রক্তাক্ত ও শোচনীয় পরাজয় হয়; তার পর কিছু যুদ্ধে হারজিতের খেলা চললেও কিছুতেই পঠানদের ঠিক শায়েস্তা করা গেল না।
বার বার হেরে, রক্তক্ষয় করে ইংরেজ সিদ্ধান্ত নিল, পঠান প্রভৃতি উপজাতিরা ঠিক সভ্য নয়, আধুনিক রাজনীতি-বিচারব্যবস্থায় তাদের কিছুতেই দমন করা যাবে না। স্যান্ডমান, ফ্রিয়ার প্রমুখ ব্রিটিশ শাসকের হাতে তৈরি হল সীমান্ত ফৌজদারি বিধি (ফ্রন্টিয়ার ক্রাইম রেগুলেশন), যা বাকি দেশের থেকে আলাদা— সেখানে ক্ষমতায় মূল কথা লিখিত আইন নয়, শাসকের উপস্থিত বিচার, অনেকটা যুদ্ধের সেনাপতির মতো। পাশাপাশি বশংবদ কিছু পঠানকে ক্ষমতা দেওয়া হল, দেওয়া হল অস্ত্রও, আশপাশের উপজাতিদের ঠান্ডা করার থেকে। সীমান্ত অঞ্চলকে দেশের বাকি অংশ থেকে আলাদা করার এই ফৌজদারি বিধি পাকিস্তানে সত্তরের দশক অবধি অপরিবর্তিত থেকেছে, আজও ঘুরপথে, অন্য নামে চলছে।
গল্পটা এই পর্যন্ত মোটামুটি জানা, কিন্তু বেন হপকিন্সের নতুন বই এই সীমান্ত আইনকে পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করেছে। বেন মূলত আফগানিস্তানের ইতিহাসবিদ, তাই শুরু করেছেন বালুচিস্তান-পাখতুন প্রদেশে সীমান্ত-আইন প্রণয়নের কাহিনি দিয়ে। কিন্তু তার পর দেখিয়েছেন যে এক বার যখন ‘সীমান্ত’ অঞ্চলকে সাধারণ আইনের বাইরে রাখার উপায় আবিষ্কার করা হল, তখন সেই মডেল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা জায়গায় ছড়িয়ে যেতে লাগল, এবং তার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ হল আফ্রিকায়— দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, থেকে নাইজিরিয়ায়। এর একটা কারণ, যে সমস্ত ইংরেজ পাখতুন প্রদেশে এক কালে ছিলেন তাঁরাই বদলি হয়ে অন্যত্র যেতে লাগলেন, যেমন সিন্ধ-বম্বেতে হাত পাকানো বার্টল ফ্রিয়ার (যাঁর নামে করাচির ‘ফ্রিয়ার হল’) পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে জ়ুলুদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। আবার কখনও কখনও অন্য শাসকেরাও ভারতীয় আইন পড়ে নিজেদের মতো করে নতুন আইন করে নেন, যেমনটা হয়েছিল নাইজিরিয়া বা ইরাকে। এই সমস্ত প্রমাণ করতে হপকিন্স যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, ইংল্যান্ড-কেনিয়া-নাইজিরিয়ার হরেক মহাফেজখানায় গিয়ে ভারতীয় সীমান্ত আইনের নকল আবিষ্কার করেছেন।
নতুন আবিষ্কারের উৎসাহে বেন কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেই আটকে থাকেননি— দেখতে চেয়েছেন আমেরিকা এবং আর্জেন্টিনাতেও এ ভাবেই সীমান্ত অঞ্চলকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। আমার বিচারে আমেরিকা মহাদেশে তাঁর বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা কম, কারণ আমেরিকায় আইন করে আদিবাসীদের নির্বিচারে মেরে তাঁদের জমি দখল করা, এবং এশিয়া-আফ্রিকায় ফৌজদারি বিধি জারি করে কিছু কিছু জাতিকে আলাদা করে রাখা, দুটোর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। বেন-এর প্রকৃত অবদান এশিয়া এবং আফ্রিকার ‘সীমান্ত’ অঞ্চলগুলির একটি একত্রিত, অথচ বহুমাত্রিক ইতিহাস রচনায়। সাধারণত ধরে নেওয়া হয় যে, সীমান্ত অঞ্চলগুলি নিজের থেকেই অশান্ত; কিছু কিছু অতি বামপন্থী সমাজতাত্ত্বিক এ-ও দাবি করেন যে, স্বাধীনচেতা জাতিগোষ্ঠীরাই রাষ্ট্রকে এড়ানোর জন্য শহর থেকে দূরে, পাহাড়-জঙ্গলের মুক্তাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এই বইটির পর আর সেই সব ভ্রান্তিবিলাসের অবকাশ থাকে না। বেন অকাট্য যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, সীমান্ত কোনও ভৌগোলিক বা সমাজতাত্ত্বিক বিষয় নয়, একটি আইনের প্রশ্ন, শাসনের কৌশল। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ নিজের সুবিধার্থে প্রান্তবাসী মানুষকে বর্বর আখ্যা দিয়ে তাঁদের জন্য আলাদা করে আইন করে, ইংরেজ যাওয়ার পরে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিও সেই শাসনকৌশল বেশ বহাল রাখে।
বর্তমানের হাতছানি ইতিহাসবিদকে বড় টানে, বেন-ও উস্কে দিয়েছেন আধুনিক প্রসঙ্গ— ঠিক যেখানে যেখানে ইংরেজ সীমান্ত আইন প্রণয়ন করেছিল, আজকে যা ভারত, পাকিস্তান, কেনিয়া, নাইজিরিয়ার আন্তর্জাতিক সীমানা, সেখানেই আজ আল-কায়দা, আল-শাবাব, বোকো হারাম, অর্থাৎ সেই হানাহানি-রক্তারক্তির ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। নজর টানার জন্য বেন বইটি শুরুই করেছেন এই জঙ্গিদের কিছু কুখ্যাত হামলার খবর দিয়ে, যদিও এখানে বইটির গোটা পৃথিবীর ইতিহাস বলার চেষ্টা হোঁচট খায়, কারণ আমেরিকা বা আর্জেন্টিনা, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকারও, সীমান্তে এই জাতীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ধরেই নেওয়া হয় যে আজকের আন্তর্জাতিক সীমানার জায়গাটাই আসল, যা দুষ্কর্ম সব সেখানেই ঘটছে। লেখক এক দিকে দাবি করেছেন যে প্রাকৃতিক সীমান্ত বলে কিছু নেই, পুরোটাই আইনের কৌশল; অথচ বিশ্লেষণ বা উদাহরণে অকুস্থল হিসেবে উঠে এসেছে রাজধানী থেকে দূরে থাকা প্রথাগত সীমান্ত অঞ্চলগুলিই। এখানেই তাঁর বক্তব্য খানিক দুর্বল হয়, কারণ সমস্ত সীমান্ত অঞ্চলকে ‘বর্বর’ বলা হয়নি, আবার ইংরেজের চোখে বর্বররা কেবল সীমান্তে থাকত না, সারা ভারতেই ছড়িয়ে ছিল।
রুলিং দ্য স্যাভেজ পেরিফেরি: ফ্রন্টিয়ার গভর্ন্যান্স অ্যান্ড দ্য মেকিং অব দ্য মডার্ন স্টেট
বেঞ্জামিন ডি হপকিন্স
৫১.০০ ইউএস ডলার
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
আসলে বেন ‘সীমান্ত’ ব্যাপারটিকে বুঝেছেন বেশ সঙ্কীর্ণ ভাবে, হয়তো মহাফেজখানায় আইনি নথির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই। তাঁর কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা— বিভিন্ন রকমের মানুষকে বিভিন্ন ভাবে শাসন করতে হবে, এই বিশ্বাসটি উনিশ শতকে বিভিন্ন আইন এবং শাসনকৌশলে লেখা হয়ে থাকে। সীমান্ত অঞ্চলটি ঠিক কোথায় তাতে কিছু যায় আসে না; আমেরিকা বা দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের বর্বর বলে দাগিয়ে রাখা হয়েছিল বড় বড় শহরেই, শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রের জন্য সেটাই সীমান্ত। ভারতের বড় বড় শহরেও শাসকেরা কিছু বস্তি, পাড়াকে দাগিয়ে রাখে গোলমেলে এলাকা বলে, সেখানকার গুন্ডা এবং পুলিশের বোঝাপড়া অন্য রকম, ধরেই নেওয়া হয় সেখানে আইনের স্বাভাবিক শাসন চলে না, তাই গুলিগোলা চলার নিয়মও আলাদা। ‘ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস’-এর মতো বিধি হয়তো নেই, কিন্তু তার প্রয়োজনও নেই, কারণ সাধারণ ফৌজদারি বিধিতেই শাসককে অপর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা সীমান্তের নয়, শাসক এবং শাসিতের সম্পর্কের উপর; এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজের চোখে পাঠানও যেমন বর্বর, দেশের বাকি অংশের কালা নেটিভরাও বর্বর, আফ্রিকায় এই দৃষ্টিভঙ্গি আরও স্পষ্ট। যে ক্রূরতা দিয়ে নির্বিচারে সীমান্ত শাসন করা হত, প্রয়োজন হলে সেই জাতীয় আইন দিয়েই ভারতীয়দেরও শায়েস্তা করা হত— মোট কথা, তোমরা শ্বেতাঙ্গদের থেকে আলাদা, কেউ কম বর্বর, কেউ বেশি। গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ফৌজদারি বিধিই কালো চামড়ার মানুষের সমতার এই সামান্যতম দাবি অস্বীকার করে তৈরি; আজ শাসকের চামড়ার রং বদলালেও রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সেই বৈষম্য রয়ে গেছে। এই কৌশলের চমৎকার ব্যবহার আজও হয়। যে সমস্ত আইন তৈরি হয়েছিল বিচারব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে তথাকথিত গুন্ডা-বদমায়েশদের আটকানোর জন্য, সেই আইন দিয়েই গোটা দেশেই মৌলিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া যায় সাংবাদিক, সমাজকর্মী, অধ্যাপকের। তাই বেন যাকে বলেন সীমান্ত-শাসন (ফ্রন্টিয়ার গভর্ন্যান্স), তা খুঁজতে যাওয়ার জন্য আজ আর বালুচিস্তান পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই।