সুকুমারী ভট্টাচার্যের দিনলিপি বলতেই মনে হয়, তবে কি তাঁর বৌদ্ধিক বিন্যাস-বিশ্লেষণের যে উত্তীর্ণতায় অভ্যস্ত মনোযোগী পাঠক, সেই মোহনাকে অর্জন করবার কাহিনি তিনি নিজেই ভেঙে বলবেন? বিদ্যাচর্চা আর তার আনুষঙ্গিক কাজে যত বার দেশের বাইরে গেছেন মানুষটি, প্রতি বারই লিখেছেন সেই প্রবাসকালীন রোজনামচা। এও কি এক হারিয়ে যাওয়া জমানার কথা? আজ যে যশস্বী বাঙালিরা বৈদেশিক আমন্ত্রণের প্রাপক, তাঁরা রোজনামচা যদি বা লেখেনও, তা নিশ্চয় মাতৃভাষায় লেখেন না। সুকুমারী ভট্টাচার্যের বিদেশ-বাসের বয়ানে আছে সে সব দেশের অসামান্য গ্রন্থাগার ব্যবহার করার তৃপ্তি, আরও বেশি আছে ওই সম্ভারকে আরও বেশি সময় ধরে, আরও বিস্তারে ব্যবহার করতে না-পারার অতৃপ্তি। তাঁর প্রতিটি বিদেশযাত্রাই কোনও না কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণে। নিজের বক্তৃতা বা নিবন্ধ প্রসঙ্গে দিনলিপিতে উল্লেখ খুবই সংক্ষিপ্ত, ‘উৎরে গেল’-র বেশি নয়। আর নিজে যখন শ্রোতার ভূমিকায়, তখনকার বিন্যাসে আছে, “...উঁচু মানের আলোচনা... শিখছি অনেক, প্রাক্ প্রস্তুতি না থাকায় সবটা বুঝতে পারছিনা।” এ দিনলিপি ১৯৯৩ সালের, সভাটি বার্সেলোনার, দিনলিপিকারের বয়স তখন সত্তর পেরিয়ে গেছে। এই ভাবেই তবে বৌদ্ধিক চর্চার মোহনা বিদগ্ধ মন-মননের আয়ত্তে আসে— জীবনভর নিজের শিক্ষার্থী-সত্তাটিকে লালন করে। ভেঙে বলেননি, পাঠকের বোধ-চৈতন্যের জন্য ছেড়ে রেখেছেন অনুক্তের পরিসর।
বিদেশ-বাসের খাওয়া-পরা-থাকার, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিছক আনুষ্ঠানিকতার খুঁটিনাটিও মেলে। একান্ত কৌতুকপ্রিয় একটি মনকে চেনা যায়, মানুষটির ব্যক্তিত্ব আর প্রজ্ঞার দেওয়াল পেরিয়ে। বার্সেলোনার হোটেলে বিকেল চারটেয় রুম সার্ভিসকে এক পেয়ালা চা আর চারটে বিস্কুট দিতে বলায়, সাড়ে চারটেয় এসে বরফ দেওয়া চারটে গেলাসে হুইস্কি ঢালবার উপক্রম! হুইস্কি নয়, বিস্কুট, আবার বলার পর জানা যায়, বিস্কুট নেই, শেষ পর্যন্ত স্যান্ডউইচে রফা হল। আমেরিকায় সত্তর-আশি জন ভারতীয়ের ১৫ অগস্ট উদ্যাপনে সমবেত গানের বর্ণনা ভুলবার নয়, “...সুর সম্বন্ধে প্রদেশে প্রদেশে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মতভেদ আছে কিন্তু দেশপ্রেমে কেউ পিছিয়ে থাকতে রাজি না। তাই বেসুরো কণ্ঠে উচ্চ গ্রামে গান— সাগরসঙ্গমে ভাগীরথীর দ্বাদশধারায় বিভক্ত হয়ে শমে পৌঁছল।” ভাগীরথীর দেশ যাঁর মাতৃভূমি, বিখ্যাত টেমস নদীকে প্রথম দর্শনে তাঁর মনে হয়, “...একটা মাঝারি খালের মতো... সুন্দর নয়— যেটুকু দেখলাম।” ক্যানবেরায় সারা দিনব্যাপী সেমিনারের পর সন্ধ্যায় গভর্নর হাউসে যাওয়া। প্রায় দু’হাজার লোকের করমর্দন করতে হল গভর্নর ভদ্রলোককে, সুকুমারী লিখছেন ‘মায়া হচ্ছিল’। আবার এই মানুষটিই যখন ক্যানবেরার প্রাকৃত শোভা আর জীবজগতের দর্শক, তখন তাঁর অনুভব আশ্চর্য গভীর। নতুন দেশ দেখার অভিজ্ঞতায় তাঁর স্মৃতিতে ভিড় করে আসে সেই দেশের অতীত ইতিহাস, সাংস্কৃতিক পরম্পরা, অগ্রগমনের পরতে পরতে সেই পরম্পরা থেকে বিচ্যুতিও। সে দিক থেকে ‘১৯৭২: বেইরুট–কায়রো-রোম’ আর ‘১৯৭৭: নেপাল’ অংশ দু’টি সুকুমারী ভট্টাচার্যের তথ্যবহুল আর বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধের স্বাদ-গন্ধ মনে করায়। ‘... নেপাল’-এর শেষে আছে, ‘ধর্ম আচ্ছন্ন করেছে শিল্পবোধকে’। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত থেকে লোকসঙ্গীতের শ্রবণে, বিখ্যাত মিউজ়িয়ম বা আর্ট গ্যালারি দেখায় তাঁর রুচি আর সংবেদন পাঠককে জীবনের উদ্বৃত্ত চেনায়।
সুকুমারী ভট্টাচার্যের অপ্রকাশিত ডায়েরি
সম্পা: কুমার রাণা
১৫০০.০০
গাঙচিল
সমকালীন শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতা প্রসঙ্গে মতামতও বেশ স্বতঃস্ফূর্ত। ১৯৯০-তে ‘প্যারিস-লন্ডন-আমস্টারডাম’ অংশে আছে, “কেম্ব্রিজে সংস্কৃতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাফ, ছাত্র নিতে চাইতেন না ইচ্ছে করে দুরূহ করে তুলতেন অধ্যাপনা, ফলে বেচারি জন্ এখন খালি ঘরে।” ‘১৯৭৪: চেম্বার্সবার্গ (মেরিল্যান্ড), আমেরিকা’ অংশে লিখেছেন, “...সাংঘাতিক অপচয় এখনও এ দেশে। Self-clear system-এর জন্যে waste barrel-টা দেখি, প্রচুর সুখাদ্যে ঠাসা... পৃথিবীর একই গোলার্ধে অহর্নিশ খিদে জেগে আছে কোটি কোটি মানুষের শীর্ণ জঠরে, এটুকু জানা নেই এদের... বিচিত্র এবং প্রচুর খাবার, তাতেও ছেলেমেয়েরা গজগজ করে। বিধাতার আদুরে দুলাল এই জাতটি।” ১৯৮৮-র প্যারিসে রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে দেখেছিলেন, আহারের শেষে যথাস্থানে প্লেট নামিয়ে রাখার আগের মুহূর্তে অনেকের হাত থেকে ছোঁ মেরে প্লেট টেনে নিয়ে ভুক্তাবশিষ্ট খাচ্ছে রুক্ষ চুল, ময়লা জামা, উদ্ভ্রান্তদর্শন এক অল্পবয়সি ছেলে। দিনলিপিতে আছে, “কী বিভীষিকা খিদের এই উদগ্র রূপ। টাকা দিতে সাহস হল না, যদি অপমান করে।” একই সময়ে দেখা জসিয়ান নামের লড়াকু মেয়েটির সঙ্গে— রুক্ষ, প্রতিকূল যাপনের ভিতরেও যে খুঁজছে জীবনের উদ্বৃত্ত। দেখেছে অনেক, তার দেখা রাশিয়ার কথা শুনে মন খারাপ হয় দিনলিপিকারের, “মাংস কেনার কিউ, ৩/৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে খুব খারাপ মাংস কেনা। একটা চাকরিতে কুলোয় না, দুতিনটে কাজ করতে হয়, স্বামী-স্ত্রীকে দু’জায়গায় কাজ দেওয়া, ওপরওয়ালা পার্টি কর্তাদের মেজাজ, বাকি পৃথিবী সম্বন্ধে অজ্ঞতা।” সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখছেন, “মন খারাপ হয়ে যায় শুনলে, কিছু তর্ক করলাম, কিন্তু চোখে-দেখা সত্যের সঙ্গে তর্ক চলে না।”
এমন সব চিন্তা-চেতনার পাশাপাশিই আছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা, বিষাদের, একাকিত্বের গ্রন্থনা। ঋজু, মর্মস্পর্শী। অত্যন্ত গুরুভার দায়িত্ব নির্বাহ করেছেন সম্পাদক কুমার রাণা। বিদগ্ধ মানুষটির জীবন এবং বৌদ্ধিক অবদান নিয়ে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা যখন পূর্ণাঙ্গ কাজ করবেন, আলোচ্য বইতে সঙ্কলিত আটটি বিদেশযাত্রার দিনলিপি নিঃসন্দেহে সেই কাজের জরুরি সহায় হবে। এমন সম্ভাবনায় বইটি ভরপুর বলেই দু’-একটি প্রশ্ন। দিনলিপির সর্বপ্রথম অংশ ‘১৯৫৬-৫৭: ইংল্যান্ড-আমেরিকা-ইউরোপ’ অংশে কি সাল-তারিখে কোনও মুদ্রণপ্রমাদ ঘটেছে? ‘১৯৯০: প্যারিস-লন্ডন-আমস্টারডাম’ অংশে আছে, “’৬৭ সালের বিশেষ কটি রাত হানা দিচ্ছে এবারে রোজই”; কিংবা “পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এমন করে ’৬৭ সাল ফিরে ফিরে আসছিল কেন এত স্পষ্টভাবে কে জানে।” তবে কি ১৯৫৬-৫৭ নয়, ১৯৬৬-৬৭, যখন সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রথম বার গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে, সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী, ইংরেজির সুপ্রসিদ্ধ অধ্যাপক অমল ভট্টাচার্য এবং কন্যা মুনিয়া (পরবর্তী কালে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার)? স্বামীর অকালমৃত্যুর স্মৃতি ফিরে ফিরেই এসেছে পরের দিনলিপিগুলিতে। আবার ১৯৫৭-র ৬ অক্টোবরে জার্মানি পৌঁছনোর দিন লেখা হয়েছে, “ড. মোডে ভাবেননি মুনিয়া এত বড়।” সালটা ১৯৫৭ হলে তনিকার বয়স তখন আট। ইংল্যান্ডে পৌঁছনোর পর পরই ১৯৫৬-র ৩০ সেপ্টেম্বরের দিনলিপিতে দেখি, “অমিয় তিস্তা (যশোধরা ও অমিয় বাগচীর কন্যা)-কে নিয়ে এসেছিল।” পরবর্তী কালে ব্যুৎপন্ন ভাষাবিদ তিস্তা বাগচীর জন্ম ১৯৬৪-র ১ অক্টোবর, অমিয়-যশোধরার বিবাহ ১৯৬৩-র ডিসেম্বরে। তবে কি পুরনো ডায়েরির অস্পষ্টতায়, সময়ের চাপে ফিকে হয়ে যাওয়া কালিতে বা মুদ্রণপ্রমাদে ১৯৬৬-৬৭ হয়ে গেছে ১৯৫৬-৫৭? এই স্পষ্টতাটুকু বইটির পরের সংস্করণে জরুরি।