অর্থশাস্ত্রী কৌশিক বসু তাঁর বিয়ন্ড দি ইনভিজ়িবল হ্যান্ড বইটিতে লিখেছেন, “প্রাচীন কালের তুলনায় বর্তমান পৃথিবী শ্রেষ্ঠতর হলেও আপাতদৃষ্টিতে আমাদের পূর্বজদের তুলনায় আমাদের যতটা সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়, আমরা ঠিক ততটা নই।” নই, তার একটা বড় কারণ, পৃথিবীর বহু মানুষ, যেমন নারী, দাস, এবং বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর বঞ্চনা আমাদের চৈতন্যকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে যায়। তাঁরাও যে মানব সমাজের অংশ, এ কথাটা আমরা ভুলে থাকতে চাই। এই বিস্মরণ অধিপতি গোষ্ঠীর স্বার্থসঞ্জাত। আদি বাসিন্দাদের মৃতদেহের উপর দাঁড় করানো হল নতুন আমেরিকার সৌধ, আধুনিক বিবেক রইল অবিচল। তেমন ভাবে, যে বিধানে অরণ্যজীবীদের অপসারণকে আদর্শ জনপদের শর্ত বলে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল, এবং অধিপতি সমাজের বিবেক সেই ঘোর অন্যায্যতাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিল, সেই ধারাবাহিকতাকেই কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ দখলদাররা ভারতে ‘সভ্যতার আলো ফোটাতে লাগল’। শুরু হল ভিন্ন এক মাত্রায় অরণ্য, খনিজ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের বেহিসেবি লুণ্ঠন।
লুণ্ঠনের মাত্রায় যে তীব্রতা যোগ হল, সেটা শাসকদের বিদেশি হওয়ার কারণে নয়, বিশ্ব জুড়ে বিকাশশীল এক নতুন আর্থ-রাজনীতিক ব্যবস্থায় এই শাসকদের নেতা হয়ে ওঠার জন্য। তাদের দার্শনিক ভিত্তি ছিল পুঁজিবাদ, যা ভবিষ্যতে কী হবে তার চিন্তা না করে বর্তমানের, এই মুহূর্তের, মুনাফাকেই একমাত্র সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল। প্রায় ১৫০ বছর আগে ফ্রিডরিক এঙ্গেলস এ নিয়ে লিখেছিলেন, যত ক্ষণ মুনাফা হচ্ছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত পণ্য উৎপাদক বা বিক্রেতা সেই পণ্য বা তার ক্রেতার ভবিষ্যৎ বিষয়ে কিছু ভাবে না। এই তাৎক্ষণিক মুনাফাই ছিল ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের আরাধ্য। গাত্রচর্ম, জন্মভূমি নিমিত্তমাত্র— যে দক্ষ বাজিকর তাদের চালিত করছিল, সেটা পুঁজি। এরই প্রেরণা বা তাড়নায় অরণ্য ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে গৃহহারা, বাস্তুহারা হয়ে বহু দূর ভিন্দেশে বসত গড়তে বাধ্য হলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই আদিবাসী। ধ্বংস হল পরিবেশ, আর তার মধ্যে, তার সঙ্গে জীবন গড়ে তোলা মানুষকে ঠেলে দেওয়া হল এমন এক কলে, যেখানে সে নিজেই নিজের স্বপ্ন নিংড়ানো জ্বালানিতে জ্বলে শেষ হয়ে যায়।
এবং ঠিক এই কারণেই, স্বাধীন ভারতেও এই প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটল না। প্রকৃতিকে নির্বিচারে লুণ্ঠন করার পরম্পরা চলতেই থাকল। চলতে থাকল ‘দেশের উন্নয়নের যজ্ঞে’ কিছু বাছাই করা লোকগোষ্ঠীর ‘স্বেচ্ছায়’ আত্মবিসর্জন; অর্থশাস্ত্রে যাঁরা অটবি, ঔপনিবেশিক অভিধায় তাঁরা তফশিলি জনজাতি। ব্রিটিশ শাসকেরা যেমন ভারতকে ‘সভ্য করে তোলার’ প্রতিজ্ঞায় পরিবেশ ও মানুষের সম্পর্কটাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল, স্বাধীন ভারতের শাসকেরাও তেমনই উন্নয়নের তাগিদে এই সম্পর্কটাকে অস্বীকার করে। বর্তমানের লাভান্বেষণ হয়ে উঠল মোক্ষ, ভবিষ্যৎ দুর্বিপাকের চিন্তা কি নীতি, কি ‘মূলস্রোতের জনসমাজ’— কোথাও স্থান পেল না। উন্নয়নের ভাবনায় পরিবেশ, পরিবেশকেন্দ্রিক মানবাধিকারের মতো জরুরি বিষয়গুলো তেমন ভাবে পরিস্ফুট হল না। এমনকি, রাজনৈতিক ইতিহাস সংক্রান্ত বিদ্যাচর্চাতেও এই দিকটি যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হল না। উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে বৈর সম্পর্কটাই প্রধান রূপে দেখা দিল। পরিবেশ সুরক্ষা যে উন্নয়নের আবশ্যিক শর্ত, এ দিকটাকে যেমন পুলিশ-মিলিটারির জোরে ভুলিয়ে দেওয়া হল, আবার উল্টো দিকে পরিবেশ ভাবনায় একটা প্রগতি-বিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
উডস, মাইনস অ্যান্ড মাইন্ডস: পলিটিক্স অব সারভাইভাল ইন জলপাইগুড়ি অ্যান্ড দ্য জাঙ্গল মহলস ১৮৬০-১৯৭০
সাহারা আহমেদ
১২৯৫.০০
প্রাইমাস
এরই মধ্যে সামাজিক বিকাশের নিয়মেই মানুষের প্রতিরোধী চিন্তা পরিবেশ-উন্নয়ন ও লোকসমাজের সম্পর্ক নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ছাপ ফেলেছে। বিদ্যাচর্চার আন্দোলনে এই অভাবটা পূরণের একটা সুসংহত প্রচেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। সাহারা আহমেদ-এর সম্প্রতি প্রকাশিত বইটি এই প্রচেষ্টায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সাহারা তাঁর বিশ্লেষণে স্থানিক, ব্যষ্টিগত উপাদান সংগ্রহ করে একটি সমষ্টিগত রূপ গড়ে তুলেছেন। বাংলার দুই অঞ্চল, উত্তরে জলপাইগুড়ি এবং দক্ষিণে জঙ্গলমহল— এই দুই ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল তাঁর প্রধান তথ্যভিত্তি। সেই ভিত্তি থেকে তিনি ঔপনিবেশিক কাল থেকে চলে আসা প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের ক্রম, তা নিয়ে মানুষের নানা রূপের প্রতিরোধ, সরকারি নীতিতে এই লুণ্ঠনকে আইনসিদ্ধ করে তোলা; আবার এক দিকে রাষ্ট্রের একটা নৈতিক মুখ তুলে ধরার জন্য এবং অন্য দিকে বিভিন্ন রূপে উঠে আসা জনপ্রতিরোধগুলোকে সামাল দেওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে নাগরিকদের জন্য কিছু আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে অত্যন্ত জরুরি আলোচনা করেছেন।
এই আলোচনা কিছুটা জটিল হতে বাধ্য। কিন্তু বর্তমানকে জানা এবং ভবিষ্যতের নির্মাণের জন্য অতীতের জরুরি অনুধাবন সহজবোধ্য নয়, তাকে সরল ভাবে তুলে ধরাটা বিপজ্জনক। সাহারা সে চেষ্টা করেননি, ইতিহাস যে জটিলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, সাহারা তাঁর চিন্তাকে সেই জটিলতাগুলোর অন্বেষণে নিবিষ্ট রেখেছেন। তাঁর বর্ণনায় চমৎকার ধরা পড়ে দুই অঞ্চলের ভূগোল, জনসমাজ, রাজনৈতিক-আর্থনীতিক-সাংস্কৃতিক গঠন, তাৎক্ষণিক লাভের জন্য উত্তরে— জলপাইগুড়িতে— সরাসরি অরণ্য ধ্বংস, এবং দক্ষিণে কয়লা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশ ও মানুষের ভারসাম্য ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে একমাত্রিক ‘উন্নয়ন’-এর ছাঁচে ফেলে দেওয়ার প্রক্রিয়া। সাহারা প্রশিক্ষিত ইতিহাসবেত্তা, ফলে বর্ণনার মধ্যে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-সাবুদের ব্যবহার যে ভাল ভাবে থাকবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু চিন্তার অনুশীলনকারীরা তাঁর বই থেকে যেটা উপরি পেতে পারেন তা হল, গবেষণার কঠোর নৈর্ব্যক্তিক দাবিটাকে অস্বীকার না করেও ব্যক্তি-সংবেদনশীলতাকে বিসর্জন না দেওয়া। সেই সংবেদনশীলতায় তিনি দেখাচ্ছেন, কী ভাবে ব্যবস্থার মধ্যে এবং ব্যবস্থার বাইরে পরিবেশ ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য আত্মিকতার সম্পর্কটিকে রক্ষা ও দৃঢতর করে তোলা যায়।
ব্যক্তিস্বার্থের ভয়াল আগ্রাসনে ভারত শুধু নয়, গোটা পৃথিবী জ্বলছে। পরিবেশ ও মানুষের সমঞ্জস অগ্রগমনের খণ্ড খণ্ড সংগ্রামগুলো পৃথিবী জুড়ে যে খণ্ডিত সাফল্যগুলো অর্জন করেছিল জন-রাজনীতি, সেই সংগ্রামগুলোকে অবহেলা করেছে, তার যে মূল্য দিতে হচ্ছে তা ভয়ানক। আমাজ়ন জ্বলছে, অস্ট্রেলিয়া জ্বলছে, ক্যালিফর্নিয়া জ্বলছে। এই প্রজ্বলনে জন-রাজনীতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দক্ষিণপন্থী, চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতির উত্থানের ভূমিকা বিরাট। পরিবেশকে বিপন্ন করে, মানুষকে তার স্ব-ভূমি, স্ব-সংস্কৃতি, স্ব-জন থেকে উৎখাত করে পুঁজির জন্য নিষ্কণ্টক পথ করে দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে নরেন্দ্র মোদী, বোলসোনারো থেকে মরিসনের মতো রাষ্ট্রনেতারা উদ্গ্রীব। সাহারার বর্ণনায় আমরা গত তিন দশকে ভারতে ধীরে, ক্রমে ক্রমে অর্জিত পরিবেশ ও পরিবেশকেন্দ্রিক মানবাধিকার বিষয়ক যে রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচগুলোর কথা জানতে পারছি, মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার গত পাঁচ বছরে অত্যন্ত দ্রুততায় সেগুলো অপহরণ করেছে, করে চলেছে।
পুঁজি, আমাদের কালে আর্থনীতিক-ইতিহাসবিদ অমিয় বাগচী দেখাচ্ছেন, যেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেখানেই সে তা করেছে বীভৎস রক্তস্রোতের মধ্যে দিয়ে। (পেরিলাস প্যাসেজ: গ্লোবাল অ্যাসেন্ডেন্সি অব ক্যাপিটাল)। পরিবেশের উপর নেমে আসা পুঁজির তরবারিকে প্রতিহত করতে চিন্তার চেয়ে বড় আয়ুধ কিছু নেই। সাহারার বইটি সে কথা মনে করিয়ে দেয়।