প্রদর্শনীর একটি ছবি
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতেসে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার।
রবীন্দ্রনাথের অন্তিম সৃজনের এই শেষ তিনটি চরণে ধরা আছে তাঁর আত্মবোধের পরম অভিজ্ঞান। ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনা-জালে/ হে ছলনাময়ী’ — কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ৩০ জুলাই ১৯৪১ তারিখে, আমরা জানি সবাই। তিনি বলেছিলেন। রাণী চন্দ লিখেছিলেন। সেই দিনই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ডাক্তারি পরিভাষায় সেই অস্ত্রোপচারের নাম Supra qubic cystostomy. এই অস্ত্রোপচারের পরে কবি আর সুস্থ হননি।
আট দিন পরে ২২-শে শ্রাবণ ইংরেজি ৭ অগস্ট ১৯৪১ দুপুর ১২ টা ১০ মিনিটে তাঁর প্রাণের প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছিল।
তাঁর প্রয়াণের ধারাবাহিক তথ্য সংবলিত করে অভিনব একটি প্রদর্শনীর সূচনা হল এ বছর তাঁর ৭৫-তম প্রয়াণ-বার্ষিকীতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবির প্রয়াণকক্ষেরই অলিন্দে। ছবি ও লেখায় অনেকগুলি প্যানেলের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর অসুস্থতা ও অন্তিমযাত্রার ধারাবাহিক বিবরণ। এই প্রদর্শনীটির আয়োজক প্রস্টেট ক্যানসার ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা ডা. অমিত ঘোষ।
সারা জীবন অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ কথা সুবিদিত। তবু জীবনের সমাপ্তি তো একদিন আসেই।
‘‘মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর প্রথম পদধ্বনি শুনেছিলেন ছিয়াত্তর বছর বয়সে। দিনটা ছিল ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭ সাল। শান্তিনিকেতনে সকলের সাথে কথা বলতে বলতে কবি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ‘হরিসি প্ল্যাসের’ আকস্মিক আক্রমণে পঞ্চাশ ঘণ্টা অচৈতন্য অবস্থায় কবি থাকেন। একই সঙ্গে আক্রান্ত হন প্রস্টেট ও কিডনির গুরুতর অসুখে।’’
প্রদর্শনীর একটি প্যানেলে এভাবেই বলা হয়েছে কবির অন্তিম অসুস্থতার সূচনার কথা। তারপর প্রায় চার বছর ধরে চলেছিল আলো-আঁধারের খেলা। তারই অনুপুঙ্খ তথ্য-ভিত্তিক বিবরণ আছে এই প্রদর্শনীতে।
প্রয়াণের পর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কুমার শ্রীজয়ন্তনাথ রায় একটি লেখায় শেষ দিনের মর্মস্পর্শী ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন।
তার কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ‘‘রাত্রি এল। পূর্ণিমার রাত্রি। ... ঠিক বারোটার সময় একটি সঙ্কট-অবস্থা দেখা দিল কিন্তু তা কেটে গেল। ... সেই জন্যই হয়ত মনে ক্ষাণ আশা ছিল যে রাত্রি ৩ টার সঙ্কট অবস্থা যদি কেটে যায় তা’হলে হয়ত পূর্ণিমা শেষ হওয়া পর্যন্ত কেটে যেতে পারে, আর যদি পূর্ণিমা কেটে যায় তাহলে হয়ত, ... তার পর আর কোন আশার কথা ভাবতে সাহস হচ্ছিল না। ... (ভোর) ৭ টার সময় শ্রদ্ধেয় রামানন্দ বাবু কবির শয্যা পার্শ্বে শেষ বারের মত উপাসনা করলেন আর তার পর বেলা ১২ টা ১০ মিনিটের সময় একাশী বৎসরের লক্ষ সুখ-দুঃখ-সমন্বিত জীবন-নাট্যের উপর শেষ যবনিকাপাত হল।’’
এই মহানির্বাণের প্রতিক্রিয়ায় জওহরলাল নেহরু দেরাদুনের জেল থেকে কবির একজন জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন ২৭ আগস্ট ১৯৪১ তারিখে।
তারই কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে, যাতে তাঁর মৃত্যুর গৌরবকে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। ‘‘However, all that is over and, instead of sorrow, let us rather congratulate ourselves that we were privileged to come in contact with this great and magnificent person. Perhaps it is well that he died when he was pouring out song and poem and poetry – He died, as he should, in the fullness of his glory.’’
আলোচ্য প্রদর্শনীটির ভিতর থেকে আমরা এই গৌরবের কিছু অনুরণন যেন শুনতে পাই।
এই প্রদর্শনীর শেষ উপস্থাপনাটি ছিল ইনস্টলেশন-ধর্মী একটি ভাস্কর্য, যাতে কবির শেষ অস্ত্রোপচারের দৃশ্যটি গড়ে তোলা হয়েছে।
সম্ভবত ওই বারান্দাতেই অস্ত্রোপচারটি সম্পন্ন হয়েছিল।