বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল: বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক কবি ও কবিতা
ব্রাত্য বসু
আনন্দ, ২০২০
দশ জন কবিকে নিয়ে লেখা একটি বই পড়লাম। কবিরা হলেন: বরিস পাস্তেরনাক, পাবলো নেরুদা, ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি, পল এলুয়ার, আরনেস্ট টলার, বেই দাও, সিলভিয়া প্লাথ, গার্সিয়া লোরকা, আবদুল ওয়াহাব আলবায়টি, আমিরি বরাকা। বিংশ শতাব্দীর কবি এঁরা। এ বই থেকে জানতে পারলাম এমন অনেক তথ্য, যা অন্তত আমার জানা ছিল না। যেমন, ১৯৭১ সালে নোবেলজয়ী নেরুদা চিকিৎসার জন্য একটি ক্লিনিকে ভর্তি হন। সে দেশে ঠিক তার আগেই গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে চিলির সামরিক প্রধান অগুস্ত পিনোশে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। পিনোশে সরকারের এক ভাড়াটে চিকিৎসক নেরুদার পেটে একটি ইঞ্জেকশন দেন এবং তার ছয় ঘণ্টা পরে নেরুদার মৃত্যু হয়। সেটা ১৯৭৩। ২০১১ সালে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নেরুদার ড্রাইভার এ কথা প্রকাশ্যে আনেন। ২০১৫ সালে নতুন তদন্তে জানা যায় নেরুদাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। অত বড় এক কবি, তাঁর কী মর্মান্তিক পরিণাম! রাষ্ট্রযন্ত্র তা হলে কত শক্তিশালী !
মায়াকভস্কির কথাই ধরা যাক। তাঁর সঙ্গে যে প্রখ্যাত নাট্য-নির্দেশক মায়ারহোল্ডের বন্ধুত্ব ছিল, সে কথাও এ বই আমাকে জানাল। মায়াকভস্কির দু’টি প্রহসন স্নানঘর ও ছারপোকা সোভিয়েট কর্তৃপক্ষ কু-নজরে দেখলেন। রাষ্ট্রের নজরে লেখাগুলি নিয়ে এলেন ম্যাক্সিম গোর্কির লেখকগোষ্ঠী। মায়াকভস্কিকে বলা হল প্রাচীনপন্থী ও ফুরিয়ে যাওয়া এক কবিমাত্র। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০ তাঁর সাম্প্রতিক প্রণয়িনী পলনস্কায়া মায়াকভস্কির বাড়ি থেকে বেরনোর পরেই একটি গুলির আওয়াজ শুনলেন। তখনই বাড়ির ভিতরে গিয়ে তিনি দেখলেন, গুলিবিদ্ধ কবি মৃত। কবির বয়স তখন সাঁইত্রিশ। মায়াকভস্কির মৃত্যুর পর সোভিয়েট রাষ্ট্র এই কবি সম্পর্কে শীতল ও নীরব হয়ে গেল। যদিও মায়ারহোল্ড পরে বললেন, মায়াকভস্কি ছিলেন সেই খাঁটি নাটককার যাঁকে আমাদের সময়ে আমরা বুঝতেই পারলাম না। মায়াকভস্কি যে এক জন নাটককারও ছিলেন, সে কথাও এ বই জানাল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, দু’বার বিবাহিত বরিস পাস্তেরনাক, আবার প্রেমে পড়লেন বছর চৌত্রিশের অনুবাদিকা ইভনস্কায়ার। তখন স্তালিন-শাসন পাস্তেরনাকের কোনও মৌলিক রচনা প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। তাই অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেছেন তিনি। ১৯৪৯-এ পুলিশ হানা দিল ইভনস্কায়ার বাড়ি, কিন্তু কিছুতেই পাস্তেরনাকের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও বলাতে পারল না। ফলে, কুখ্যাত গুলাগ-এ নির্বাসিত হলেন ইভনস্কায়া। পাস্তেরনাক নোবেল পেলেন, কিন্তু পুরস্কার নিতে স্টকহোমে যেতে পারলেন না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তখন ক্রুশ্চেভ। ক্রুশ্চেভের সামনেই, এক পরাক্রমী নেতা চোদ্দো হাজার লোকের এক সভায় পাস্তেরনাককে কুকথা বললেন। বলা হল, তিনি এক স্বদেশ-বিরোধী মানুষ।
এ বই আমাদের জানায় চিনের এক কবি বিষয়েও, যাঁর নাম: বেই দাও। ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্রছাত্রীরা অবস্থানে বসেছিল বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে। তারা ছিল নিরস্ত্র। ট্যাঙ্ক চালিয়ে পিষে মারা হয় তাদের। বেই দাও তখন বার্লিনে ছিলেন এক কবিসভায়। তাই প্রাণে বাঁচলেন, কিন্তু স্বদেশে ফিরতে পারলেন না। এখনও নির্বাসিত তিনি।
এ বই বলছে সিলভিয়া প্লাথের কথা। তরুণী এই কবি, বিবাহ করেছেন কবি টম হিউজেসকে, দুই সন্তানের জননী তিনি তখন— এই সময় এক দিন সকালে তাঁর নার্স এসে দেখলেন, কেউ বাড়ির দরজা খুলছে না। বহু চেষ্টায় ভিতরে ঢুকে রান্নাঘরে সিলভিয়ার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল। রান্নাঘরটি খুব ভাল করে বন্ধ করে, গ্যাসওভেনে মাথা রাখেন প্লাথ ও গ্যাসের লাইন চালিয়ে দেন। ফলে গোটা রান্নাঘর কার্বন মনোক্সাইডে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। তাঁর বয়স তখন ত্রিশ। ডাক্তারকে জানিয়েছিলেন, সকালে ঘুম ভাঙা মাত্রই তাঁর আত্মহত্যার ইচ্ছা জেগে ওঠে। ডাক্তার সে জন্যই সকালের নার্সকে মোতায়েন করেন।
এই দশ জন কবির জীবনকথার পাশাপাশি এ বইয়ে আছে প্রত্যেকেরই কিছু অনুবাদ। আছে তাঁদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, কবিদের প্রেম-সম্পর্কের ওঠা-নামা, রাজশক্তির সঙ্গে কবিদের জড়িয়ে পড়া ও তার দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। যে কবি যে দেশে বাস করছেন, তার রাজনৈতিক টানাপড়েন সেই সব দেশকে কী ভাবে আলোড়িত করছে, আছে সে কথাও।
তথ্যসমৃদ্ধ হলেও বইয়ের ভাষা অত্যন্ত বেগবান। কবিদের ব্যক্তিগত, কাব্যগত, রাষ্ট্রগত সমস্ত তথ্যকে আত্মসাৎ করে প্রবন্ধগুলির ভাষা চলেছে বিদ্যুৎগতি নিয়ে। এ বই পড়ার আগে আমি জানতাম না যে, আবদুল ওয়াহাব আলবায়টি-ই হচ্ছেন সমগ্র আরব-সাহিত্যে গদ্যকবিতার উদ্গাতা। তাঁর হাত ধরেই আরবীয় কবিতা ছন্দোবদ্ধ প্রথাগত ছকবাঁধা বিন্যাস থেকে মুক্তি পেয়েছিল। জানতাম না অ্যাফ্রো-আমেরিকান দৃপ্তকণ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ কবি লিয়র জনস তাঁর আমিরি বরকা নাম নিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন।
এ বইয়ের লেখক কোনও কবি নন— নাটককার-নির্দেশক-অভিনেতা-প্রাবন্ধিক ব্রাত্য বসু এর লেখক। উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র বাংলার নাট্যজগতকে তর্কাতীত ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন এঁরাও। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিদের নিয়ে বই লেখার কথা ভাবেননি। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে, বিজয় তেন্ডুলকর, গিরীশ কারনাড, মোহন রাকেশ, মহেশ এলনকুঞ্চওয়ার— এঁরাও ভাবেননি। যদিও গিরীশ পঞ্চদশ শতকের দুই ভক্তিকবি কণক ও পুরন্দর, এবং কন্নড় কবি দত্তাত্রেয় রামচন্দ্র বেন্দ্রেকে নিয়ে দু’টি তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। তবে, বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কবিদের খুঁজে এনে তাঁদের বিষয়ে গ্রন্থ রচনার বিপুল পরিশ্রমে নিয়োজিত হননি এঁরা কেউই। ভারতের নাট্যজগতে, এ ক্ষেত্রে, ব্রাত্য বসু একটি জ্বলন্ত ব্যতিক্রম।