আই অ্যাম দ্য পিপ্ল: রিফ্লেকশনস অন পপুলার সভারেনটি টুডে
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
৫৯৫.০০
পার্মানেন্ট ব্ল্যাক
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আই অ্যাম দ্য পিপ্ল গণসার্বভৌমত্বের দ্বিশতবর্ষব্যাপী বিশ্বজোড়া কাহিনি, যা শেষ হচ্ছে একেবারে আমাদের এই কালে। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, ঔপনিবেশিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ ও উপনিবেশ— বিশ্বব্যাপী আখ্যানের কেন্দ্রে রয়েছে গণসার্বভৌমত্বের অতীত, বর্তমান এবং খানিকটা ভবিষ্যতের ওপর আলোকপাত। বিশাল প্রেক্ষাপটে বিন্যস্ত এই ধরনের লেখা পাঠে সন্তোষ যেমন আসে, সমস্যাও দেখা দেয়। সে অবশ্য অন্য কথা, আর এক অবসরে তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
পার্থ গণসার্বভৌমত্বের আখ্যানকে বেঁধেছেন জাতি, জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের কাহিনির সঙ্গে। জাতি জন্ম দিয়েছে জনসাধারণের। অন্য দিকে, জনগণের রাজনৈতিক বোধ জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করেছে, যদিও লেখক বলেছেন এই সম্পর্ক অত সরল নয়। জাতিবোধ, জনসাধারণের আত্মশক্তি বা আত্মপরিচিতিবোধ, রাষ্ট্রক্ষমতার নিজস্ব যুক্তি— সবই আবার বিকশিত হচ্ছে পুঁজিবাদের কালে, তিন উপাদানই পুঁজির বয়ানের সঙ্গে বাঁধা। জনগণের আত্মপরিচিতি তার আকার নিচ্ছে আন্তর্জাতিক জাতিব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে, যার বৈশিষ্ট্য হল জাতিতে জাতিতে অসাম্য, কিছু জাতির নিরন্তর অপমান আর অধীনতা, ক্ষমতার অনৈতিক প্রকৃতি ও গণরাজনীতির ক্রমাগত চাপ, যা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে, পরিশেষে এই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যক্তিরূপ দান করে। এক দিকে পুঁজিবাদের আমলাতান্ত্রিক রূপ, পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার প্রাধান্য ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিকতা; অন্য দিকে জনসাধারণের রাজনৈতিক বোধ এবং আত্মপরিচিতি, দুইয়ের টানাপড়েনে গণসার্বভৌমত্বের কী পরিণতি হল?
এর উত্তর পার্থ কী দিয়েছেন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। গণসার্বভৌমত্ব বলে আদৌ কখনও কি কিছু ছিল? না কি, সেটি ধনতান্ত্রিক আধুনিকতার কল্পনা, যা নানা সময়ে নানা কাজে এসেছে? আজ সেই কল্পনার তেজ ফুরিয়ে গিয়ে তার যে কঙ্কালসার চেহারা প্রকাশ্য, তা কি আর জনগণকে উদ্দীপ্ত করে? জাতীয়তাবাদের ডাকে সাড়া দেয় বটে, কিন্তু সার্বভৌমত্বকে স্বাধিকার বলে দাবি করা নিয়ে কি জনগণ আজ চিন্তিত?
যে ভবিষ্যৎ নতুন পথের সন্ধান দেয় না, সেই কল্পবস্তুর অতীত ইতিহাসকে হয়তো এক নতুন নির্মোহ আলোকে দেখা যায়। গণসার্বভৌমত্বের বিচ্ছেদহীন জীবনের কাহিনি আজ এক নতুন বাধার সামনে। জনসাধারণের কল্পিত ক্ষমতা আজ জনতা নামক বাস্তবতার সম্মুখীন। গণতন্ত্র মুখোমুখি জনপ্রিয়তাবাদের বা জনবাদী রাজনীতির, যার প্রবাহ অন্য রাস্তায়। সার্বভৌমত্বের যুক্তি ও জনবাদী যুক্তির পথ ভিন্ন, দুইয়ের সম্পর্ক থাকলেও।
ষাটের দশকে মাও জে দং বলেছিলেন, দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি, জনগণ চায় বিপ্লব। সেই কাহিনি ও কাল আজ গত। তবে সেই রণধ্বনিতেও শোনা গিয়েছিল একই কথা: সার্বভৌমত্বের কল্পকাহিনিতে আমরা ভুলছি না। স্বাধীনতা ও সমাজ পরিবর্তন, জনসাধারণ ও শ্রেণি, জাতি ও মুক্তি, বিপ্লব ও ক্ষমতার আন্তঃসম্পর্ক আমরা নির্ধারণ করব অন্য ভাবে। নয়া উদারনীতিবাদী পুঁজিবাদের কালে, বিশ্বায়নের প্রকোপে অর্থনীতির নতুন মোড়ের পরিণামে আবার আজ দেশ, জাতি, জনসাধারণ এবং জনসাধারণের রাজনৈতিক আত্মবোধের আন্তঃসম্পর্ক নতুন রূপে নির্ধারিত হচ্ছে। অসংগঠিত বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি কাঠামোয় উৎপাদন বাড়ছে। শ্রমিক ও শ্রমজীবীরা নিযুক্ত হচ্ছে অনিয়মিত ভিত্তিতে। নাগরিকত্ব অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাচ্ছে। জনসাধারণ প্রতিনিধিত্বমূলক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি-ব্যবস্থা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। জনসাধারণকে মনে হচ্ছে জনতা, সাবেক গণতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে যা আবির্ভূত হচ্ছে ।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় গণসার্বভৌমত্বের আলোচনাকে জনবাদের বর্তমান রূপের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। জনবাদী রাজনীতির বহু উৎস ও একাধিক অতীতের কথাও বলেছেন। প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র ইতিহাস, গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের সঙ্গে স্বতন্ত্র সম্পর্কের ইঙ্গিত এই বইটিতে পাওয়া যাবে— জাতি ও জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের আলোকে, জনসাধারণের চৈতন্য ও রাজনৈতিক প্রয়োগকৌশলের ইতিহাসের আলোকে নয়। জাতি ও জাতীয়তাবাদকে মুখ্য উপাদান না করে জনসাধারণ ও বিভিন্ন নিপীড়িত শ্রেণি অন্য ভাবে রাজনীতির কথা ভেবেছিল, তার স্বীকৃতি এ বইয়ে নেই।
কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ জন্য ধন্যবাদার্হ যে, তিনি জনবাদী রাজনীতির বহু উৎস এবং অতীতের কথা উল্লেখ করেছেন। কৃষককেন্দ্রিক, ধর্মকেন্দ্রিক, জাতীয়তাবাদী— এমন নানা ধরনের জনবাদ আমরা আধুনিক রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে পাই। বেশির ভাগেরই বৈশিষ্ট্য ছিল, গণতন্ত্রের এবং আধুনিক শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামোর বিরোধিতা । এমনকি জ়ারশাসিত রাশিয়াতেও আওয়াজ উঠেছিল, উদারনৈতিক সংস্কারে কাজ হবে না, জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া চাই। আজ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক কাঠামো যত জীর্ণ হচ্ছে, ততই বাড়ছে জনবাদের আকর্ষণ। ধ্বনি উঠছে: গণতন্ত্রের অর্থ হল আশু গণতন্ত্র, যথাসম্ভব প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, যা জনগণকে সুরক্ষা দেবে এবং নতুন করে জনসাধারণের নির্মাণে ব্রতী হবে। প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, গণতন্ত্র প্রমাণিত হয় জনতার নিজস্ব আত্মনির্মাণে, পুনর্নির্মাণে। তাই গণতন্ত্রের সহোদর প্রতি-গণতন্ত্র, বা বলা যায়, বিরোধী গণতন্ত্র!
এর সঙ্গে সার্বভৌমত্বের সম্পর্ক আছে, কিন্তু তা খুব সম্পৃক্ত নয়। পিছনের শতাব্দীতেও সার্বভৌমত্বের কল্পকাহিনি এক রূঢ় বাস্তবতার রূপ নিয়েছিল এবং বিশ্ব রাজনীতি তাকে পাশ কাটিয়ে এগোতে চেয়েছিল। জনবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতাকে তাই মতাদর্শের, অথবা কোনও বিশেষ রাজনৈতিক যুক্তির বিশ্লেষণের পথে বোঝা সম্ভব নয়। বরং বোঝা সম্ভব জনসাধারণের নানা রাজনৈতিক কৌশল বা প্রয়োগের ইতিহাস অনুসন্ধানের মাধ্যমে। পুঁজিবাদী শাসন চেষ্টা করে জনবাদী বোধ, বিশৃঙ্খলা, এবং রাজনীতিকে কুক্ষিগত ও আত্মস্থ করার। কিন্তু লেখক বলেছেন (পৃ ৯৭), জনবাদী রাজনীতি ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’-এর পুঁজিবাদী নীতির পক্ষে বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত জনবাদী রাজনীতি পুঁজির সামগ্রিক গণতান্ত্রিক কলাকৌশলের পক্ষেই বিপজ্জনক। তাই লিবারাল থেকে সাবেক বামপন্থী— সবাই জনবাদের মুণ্ডপাতে সরব ও ব্যস্ত।
দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয়তাবাদ পরিণত হয় কর্তৃত্ববাদী, একনায়কতন্ত্রী শাসনে। বামপন্থী জনবাদ ক্ষমতা অর্জন করে ক্রমশ সামাজিক হয়ে উঠে। তার সীমাবদ্ধতা থাকে, কিন্তু সম্ভাবনাও অনেক। এক একটি জনবাদী জাগরণ বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, তা হল এক একটি বিশেষ মুহূর্তকে বোঝার রাজনীতি। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তকে ব্যবহার করে ঐতিহাসিক বিস্ফোরণের রাজনীতি। নিষ্ক্রিয় বিপ্লব বা প্রশান্ত বিপ্লবের কাঠামোয় তাকে কি বোঝা যায়?
বোঝা যায়, যদি শ্রেণি-সংঘর্ষ ও সামাজিক দ্বন্দ্বের আয়নায় তাকে দেখি। পুঁজিবাদের নিরন্তর নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত শ্রেণি-সংগ্রামের নিজস্ব চরিত্র ও ইতিহাসকে অস্বীকার করে। আসলে, সার্বভৌমত্বের নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাসের মতোই নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের তত্ত্বও এক কল্পকথা মাত্র।
এ-বই পাঠককে রাজনীতির গভীরে নিয়ে যাবে। অবশ্যপাঠ্য বইটি যে কোনও ভাল বইয়ের মতো কিছু প্রশ্নের সমাধান করেছে, আবার নতুন একগুচ্ছ প্রশ্ন তৈরিও করেছে।