সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইম। স্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচ। জাগেরনাট, ৬৯৯.০০
ভা ল-মন্দের সমালোচনা পরের কথা। কিন্তু ৫৭০ পাতার এই বই শেষ করে দিন কয়েক থম মেরে বসে থাকতে হয়। অদ্ভুত এক অনুভূতি! সংশয়, বিষণ্ণতা, জীবনের খুঁটিনাটি আবিষ্কারের আনন্দ সব একসঙ্গে আঁটো স্যান্ডো গেঞ্জির মতো বুকটাকে জড়িয়ে ধরছে। বই পড়ে এ রকম অনেক দিন বোধ হয়নি।
বেলারুসের ৬৮ বছরের লেখক স্বেতলানাকে দুনিয়া চিনেছে গত বছর, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কল্যাণে। তার আগে তাঁর বই স্বদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে, দেশ ছাড়তেও হয়েছে। নোবেল পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘রুশ শিল্পের জগৎটা আমার পছন্দের। স্তালিন বা পুতিনের জগৎ নয়।’ নোবেল পুরস্কার মাঝে মাঝেই অপাত্রে অর্পিত হয়, তলস্তয় থেকে বর্হেস অনেককেই তারা সম্মান দেয়নি। কিন্তু স্বেতলানাকে আবিষ্কারের জন্য সেই সব অপরাধ অক্লেশে ক্ষমা করে দেওয়া যায়।
এই বইটি গল্প-উপন্যাস নয়। ১৯৯২ থেকে ২০১২ অবধি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রজন্মের সৈনিক, অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ীদের ইন্টারভিউ করেছিলেন স্বেতলানা। খুঁজতে চাইছিলেন ‘সোভোক’ কাকে বলে! বাঙালিদের যেমন ঠাট্টা করে ‘বং’ বলা হয়, সোভিয়েতের মানুষকেও তেমন ঠাট্টা করে সোভোক বা ‘হোমো সোভিয়েটিকাস’ বলা হত।
সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর এই সোভোকরা কেমন? এখন রাস্তায় দুর্ঘটনা দেখলে তারা মোবাইলে খচাত খচাত ছবি তোলে। এই বইয়ে এক মায়ের সাক্ষাৎকার আছে। মস্কোর মেট্রো স্টেশনে চেচেন জঙ্গিদের বিস্ফোরণে তাঁর মেয়ে আহত। লোকে রক্তে ভেসে-যাওয়া আহতদের বের করে সিঁড়িতে শুইয়ে দেয়, অ্যাম্বুল্যান্স আসে। তারই মধ্যে কিছু অফিসযাত্রী মোবাইলে ক্যামেরা তাক করে আহতদের ছবি তোলে ও সোশাল নেটওয়ার্কে হাহুতাশ করে।
সোভোক আসলে দলবদলের মাস্টারপিস। গোরবাচেভ আমলের শেষ দিক, কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা রোজ রাতের বেলায় রাস্তার ডাস্টবিনে তাদের মেম্বারশিপ কার্ড ফেলে দিয়ে যায়, সকালে ঝাড়ুদারদের প্রাণাম্ত। এক নেতা সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘এখানকার সবচেয়ে ভাল স্কুলের হেডমাস্টারমশাই তার দু’ বছর আগে ব্রেজনেভের ওপর চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পার্টি থেকে পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ব্রেজনেভ-ভক্ত সেই কমিউনিস্ট শিক্ষক এক দিন আমাকে রাস্তায় দেখে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘এই স্তালিনবাদী হারামজাদা, তোদের দিন শেষ, জানিস তো?’’ নেতা পরে কথায় কথায় স্বেতলানাকে আসল দুঃখ জানিয়েওছেন, ‘‘আমাকে স্তালিনবাদী বলল? আমার বাবাকে স্তালিনের আমলে সাইবেরিয়া পাঠানো হয়েছিল। বাবা স্তালিনকে ক্ষমা করলেও আমি কোনও দিন করিনি।’’
স্তালিনকে ক্ষমা না করেও কমিউনিস্ট নেতা? সোভোক ট্রাজেডি এখানেই। স্বেতলানা ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে দেখছেন, অনেকের বাবা, ঠাকুর্দাই স্তালিনের আমলে কারাগারে ছিলেন। তাঁরা জানতেন, কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকর্মী বা আত্মীয় তাঁদের নামে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে চুকলি কেটেছিলেন। ঘটনাটা নতুন নয়। ইতিহাসবিদ অরল্যান্ডো ফিগ্স বছর কয়েক আগে তাঁর হুইস্পারার্স বইয়ে দেখিয়েছিলেন, স্তালিনের আমলে সোভিয়েত দেশে ‘হুইস্পার’ কথাটার দুটি অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একটি ফিসফিসানি। অন্যটি পিছনে লাগানিভাঙানি বা চুকলি কাটা।
স্বেতলানার ওরাল হিস্ট্রি এগিয়েছে আরও অনেক দূর। সাইবেরিয়া বা কারাগার থেকে যারা বেঁচে ফিরতেন, আজীবন নীরব। তাঁরা জানতেন, কোন বন্ধুর সৌজন্যে দিনের পর দিন তাঁদের জেলে থাকতে হয়েছে, কিন্তু কখনও প্রকাশ করতেন না। উল্টে তার সঙ্গে আগের মতো আড্ডা ও ভদকা পান। সোভোক মানে ভিতরে ভিতরে নিঃশব্দে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার ট্রাজেডি।
দহনে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে গোটা জাতি। শিকার বা শিকারি কেউই রেহাই পায়নি। ইয়েলতসিনের আমলে মস্কো থেকে এক ভদ্রমহিলা কাজাখস্তান যাচ্ছেন। তাঁর বাবা সেখানে স্তালিনের শ্রমশিবিরে বন্দি ছিলেন, সেখানেই মারা যান। যাওয়ার পরে স্থানীয়রা বলেন, ‘শ্রমশিবির? সেই ইতিহাস মুছে গিয়েছে। ওই যে বড় শপিং মল, সনা বাথ দেখছেন, দাদুর মুখে শুনেছি, ওখানেই ছিল কাঁটাতার।’ ফেরার পথে মহিলাকে গাড়িতে লিফট দেয় এক যুবক। তার বাবা ওই শিবিরে প্রহরী ছিলেন। চাকরির খাতিরে বন্দিদের অনেককেই চাবকে লাল করে দিতে হত। ক্রুশ্চেভের আমল থেকে বারংবার বদলির আবেদন জানিয়েছেন, লাভ হয়নি। শুধু প্রহরীরা নন। বন্দিদের যে ট্রেনে চাপিয়ে মস্কো থেকে আনা হত, তার ড্রাইভার এবং গার্ডদেরও আজীবন জনমানবহীন স্তেপভূমিতেই থাকতে হয়েছে। রেহাই কেউ পাননি।
সোভোকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, একটি বিশেষ শব্দের মানে খুঁজতে গিয়ে সে বারংবার হয়রান হয়েছে। ফ্রিডম বা স্বাধীনতা! সোভিয়েত আমলে আলু খেয়ে পেট ভরাতে হত, এখনও! বরং তখন রেশনের লাইনে দাঁড়ালে সারা মাসে এক কেজি মাংস পাওয়া যেত। এখন, ইয়েলতসিনের আমলের সংস্কারের পর সেই টাকায় এক ছটাক গমও জোটে না। সোভিয়েত সেনাবাহিনির এক অফিসার তাই ফুটপাথে চাদর পেতে তাঁর পদকগুলি বিক্রি করেন। আমেরিকান টুরিস্টরা ওই সব জাঙ্ক ভাল দামে কেনে। এক জন বলে, ‘‘আমাদের মা-বাবারা গোরবাচেভকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁরা স্বাধীনতা বলতে বুঝেছিলেন, মানবিক সাম্যবাদ। পরে আমরা স্বাধীনতা মানে বুঝলাম, বড়লোক হওয়া। হরেক রকম জিনস আর সালামি কেনার টাকা। বড়লোক না হলে, তুরস্কে ছুটি কাটানোর সামর্থ্য না থাকলে সবাই তোমাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে।’’ আশি শতাংশ দেশবাসী দারিদ্রে ধুঁকছে, বাকিদের যেন তেন প্রকারেণ বড়লোক হতেই হবে। ‘‘গণতন্ত্র বলবেন না। শুধু খনিজ তেল আর গ্যাস বেচে গণতন্ত্র আসে না। সুইস চকোলেটের মতো ওটা আমদানি করা যায় না। গণতন্ত্র একটা অভ্যাস, সেটা সোভোকদের নেই,’’ বলেছে সোভিয়েত জমানায় বেড়ে-ওঠা এক সোভোক।
জারতন্ত্র গত শতকের ইতিহাস। তার পরেও লেনিন, স্তালিন, ক্রুশ্চেভ, গোরবাচেভ, পুতিন অবধি পেরিয়ে কেনই বা আসে না গণতন্ত্র? কথা বলতে বলতে এক জন বলছেন, ‘‘কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বপুরুষেরা আমাদের জন্য শুধু সেনাবাহিনি মার্কা কিছু স্লোগান রেখে গিয়েছিলেন। ‘পার্টির অনুগত সৈনিক’, ‘শস্য ফলানোর সংগ্রাম’। ছোটবেলায় স্কুলে ‘ইয়ং পায়োনিয়ার’ হওয়ার সময় শপথ নিতে হত, ‘মাতৃভূমিকে আমি সবচেয়ে ভালবাসি।’ তিন বছর বয়সে মুখস্থ করতে হত, ‘মাই ডার্লিং রাইফেল/ফ্লাই, হট বুলেট, ফ্লাই।’ সোভোককে দেশনেতারা মানুষ বানাতে চাননি। চেয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করতে। বইয়ে আর এক জনের আক্ষেপ, ‘‘আমরা জার্মানদের হারিয়েছিলাম। পরমাণু অস্ত্রসম্ভারে পশ্চিমি দুনিয়া আমাদের ভয় পেত।’’ অন্য এক জন: কিন্তু একটা ওয়াশিং মেশিন বা ভিসিআর দেখলে আমাদের বিস্ময়ের অবধি থাকত না।
জাতীয়তাবাদী, যুদ্ধবাজ এই সোভোক শেষে মুষলপর্বের মতো নিজেদের অস্ত্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়। আজারবাইজানের এক মেয়ে বলে, ‘স্কুলে শেখানো হয়েছিল সশস্ত্র সৈনিকদের ভালবাসতে। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর যারা বোমা, পিস্তল নিয়ে বাড়িতে হামলা চালিয়ে বলল, মস্কোয় কেটে পড়! তারা তো দুগ্ধপোষ্য শিশু। কিছুদিন আগেও আমরা সোভিয়েত ছিলাম। আজ কেউ জর্জিয়ান, কেউ ইউক্রেনিয়ান!’’ সোভোক চরিত্রেই কি ছিল এই ধ্বংসের বীজ? কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তানের লোকেরা জানায়, আগে মস্কোয় তারা অতিথি হিসেবে গণ্য হত। এখন বেআইনি অভিবাসী শ্রমিক। যাকে কম টাকায় যথেচ্ছ খাটিয়ে নেওয়া যায়, প্রতিবাদে খুন হয়ে গেলেও পুলিশ খবর রাখে না। সোভোক আজও তাই একনায়ক খুঁজে বেড়ায়। বইয়ের অনেক চরিত্র মাঝে মাঝেই বলে ওঠে, ‘‘বুঝেছেন, স্তালিন থাকলে সব ঠান্ডা হয়ে যেত।’’
স্বেতলানার বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এখানেই। বন্ধনীতে ‘আমরা দু’জনে একসঙ্গে কাঁদছিলাম’ বা ‘সে চিৎকার করে ওঠে’ গোছের বাক্যবন্ধ ছাড়া লেখক সর্বতো ভাবে অনুপস্থিত। স্বেতলানা ভূমিকায় লিখছেন, ‘আমি সমাজতন্ত্র নিয়ে কাউকে প্রশ্ন করিনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম ওঁদের শৈশব, প্রেম, বার্ধক্য, ছোট ছোট হিংসা, ঈর্ষা নিয়ে। কী ভাবে ওঁরা চুল বাঁধতেন, রান্না করতেন সে সব নিয়ে।’ নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি অভ্যন্তরীণ সমাজতন্ত্রকে খুঁজতে চেয়েছি। কী ভাবে সে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে।’
তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তিকে অনেকে সাংবাদিকের নোবেল লাভ বলে হাসিঠাট্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিভাময় সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের তফাত কতটুকু? ধসে পড়া দেশে ক্ষয়ে যাওয়া জীবনে সোভোকদের বীর নায়ক খোঁজা কি আমাদের মনে পড়ায় না ব্রেশটের সেই লাইন: দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয়। ইন্টারভিউ দিতে দিতে লোকে রসিকতা করে, ‘রুশ ভাষায় সবচেয়ে ছোট্ট রসিকতাটা জানেন তো? পুতিন এক জন গণতান্ত্রিক মানুষ।’ এক তরুণ বলে, ‘নতুন ঠাট্টাটা শুনেছেন? এক জনের প্রশ্ন ছিল, কোথায় কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়া যায়? উত্তর এল, পাগলা গারদে।’ এই সোভোক রসিকতা কি পদে পদে মনে পড়িয়ে দেয় না চেক লেখক মিলান কুন্দেরাকে?
স্বেতলানা কোনও রায় দেননি, শুধু সোভোকের সংজ্ঞা খুঁজে গিয়েছেন। অনেক মানুষ, অনেক অভিজ্ঞতা। তারই মাঝে খিটখিটে মেজাজের এক প্রৌঢ় জেনারেল বলেছেন, ‘সোভোক আসলে ইউটোপিয়ায় বিশ্বাসী। আমরা ভাবতাম, সাম্যবাদ সব ঠিক করে দেবে। আমার নাতি ভাবে, বাজার-অর্থনীতি সব ঠিক করে দেবে।’
কোনটা ঠিক? বই শেষ করে মনে হল, প্রচ্ছদটি চমৎকার। সাদা প্রেক্ষাপটে হাল্কা শিমুলতুলো এলোমেলো উড়ে যায়। সোভোকদের জীবন যে রকম!