অদ্বৈত মল্লবর্মণের উত্তরসূরি কৈবর্ত সমাজ থেকে উঠে আসা এক কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনকে দীপিত, সজীব এবং প্রাণবন্ত করে চলেছেন। সাতচল্লিশ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস জলপুত্র প্রকাশের পর তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। এই গ্রন্থে তিনি কৈবর্ত সমাজের দৈনন্দিন সংগ্রাম, প্রেম, দুঃখ, বেদনা ও আকাঙ্খাকে নবমাত্রায় উন্মোচন করেছিলেন। পরে আরও প্রসারিত চেতনায় নিম্নবর্গীয় মানুষ হয়ে ওঠে তাঁর উপন্যাসের বিষয়। দীর্ঘ দিন বাদে বাংলা সাহিত্যে কৈবর্ত সমাজ ও নিম্নবর্গীয় মানুষ তাঁর সৃজনে নবীন মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত। আমরা তাঁর দশটি উপন্যাস ও ছোটগল্পে অমিত সম্ভাবনাময় এক লেখকের আবির্ভাবকে প্রত্যক্ষ করছি।
তাঁর দহনকাল উপন্যাসটির বিষয় ছিল সংগ্রামী জেলেদের জীবনালেখ্য। তাঁদের শোষণবঞ্চনা, প্রতিবাদ প্রতিশোধের কাহিনির সঙ্গে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এই উপন্যাসের একটি বড় অংশে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।
তাঁর সাম্প্রতিক প্রতিদ্বন্দ্বী উপন্যাসটি তাৎপর্যময়, এখানে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের বিষয়টি প্রণিধাণযোগ্য হয়ে ওঠে। উপন্যাসে তারই বিস্তৃত বোধ আমাদের নিয়ে যায় ভিন্ন জগতে। আদিমকাল থেকে মানব জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্তর্মুখী চাপে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্ব যে বিচ্ছিন্নতা, দূরত্ব ও হিংসার জন্ম দেয় প্রতিদ্বন্দ্বী উপন্যাসে তারই প্রতিফলন। এখানে ব্যক্তিদ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে। সেন পরিবার আর দত্ত পরিবার মুখোমুখি হয় একটি বাড়ি দখল করবার অভিলাষে। এই বাড়িটিকে কেন্দ্র করে যে চক্রান্তের জাল বিস্তার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
এই উপন্যাসের মূল চরিত্র প্রতিমা চৌধুরী চট্টগ্রামের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর প্রতিচিত্র যেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সৈন্য যে নারীদের নির্যাতন করেছিল, বীরাঙ্গনা অভিধায় অভিষিক্ত করলেও, সমাজ ও রাষ্ট্র এখনও তাঁদের যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। রমা চৌধুরী সমাজে উপেক্ষিতা হলেও তাঁর ভেতর মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা অহর্নিশ নদীর প্রবল স্রোতের মতো বহমান।
মুক্তিযুদ্ধ নবীন প্রজন্মের কাছে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কত প্রাণময় এবং অর্থময় লেখক এই উপন্যাসে এক প্রত্যয় ও অঙ্গীকার নিয়ে সে কথা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৃহত্তর বোধে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠে।
আমার দিনগুলি গ্রন্থে সুস্মিতা ইসলাম তাঁর দীর্ঘ জীবনাভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। এক অনমনীয় জেদ নিয়ে নানা বাধা অতিক্রম করে জীবন সায়াহ্নে এসে নির্মোহ ভাবে সে কথা লিখেছেন। কলকাতার এক বনেদি হিন্দু পরিবারে তাঁর জন্ম। সুস্মিতার বাড়িতে বেড়াতে এসে প্রেমে পড়েন কবি গোলাম মোস্তফার পুত্র মোস্তফা আনোয়ার। সুস্মিতার বাড়িতে এক উদার মানবিক এবং উন্নত রুচির সাংস্কৃতিক পরিবেশ থাকায় এ বিয়ে সম্ভব হয়ে উঠেছিল। স্বামীর বিমান দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু ১৯৫৯ সালে, তারপর তাঁর নতুন করে বেঁচে ওঠা ও সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য জীবনসংগ্রাম— সুস্মিতা উচ্চশিক্ষা নিয়ে পরিবারের জন্য দেশে-বিদেশে চাকরি নিলেন। এক নারীর জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার এই কাহিনি তিনি লিখলেন, সংসার থেকে অবসর নিয়ে। এ শুধু তাঁরই জীবনকথা নয়, এই গ্রন্থে উঠে এসেছে ৮৯ বছর বয়সি এই মানুষের পরিপার্শ্ব, সমাজ ও সময়। রাজনৈতিক ঘটনা সহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় তাঁকে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কত ভাবে আলোড়িত করেছিল, তা এই গ্রন্থে তিনি বর্ণনা করেছেন।
সুস্মিতার পিতামহ নিখিলনাথ রায় ছিলেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবং আইন ব্যবসায়ী। বাবা ত্রিদিবনাথ রায়ও ছিলেন আইনজীবী। কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে ১৯২৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর সুস্মিতা রায়ের জন্ম, পরিবারের প্রথম সন্তান।
সুস্মিতা নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা লিখেছেন। হিন্দু ও মুসলিম দুই সংস্কৃতির অন্দরমহলেরও কথা আছে। বিয়ের পর ঐতিহাসিক ৫ পার্ল রোডের বাড়িতে আলাদা ভাবে সুখের নীড় রচিত হল তাঁদের। সখ্য হল সৈয়দ মুজতবা আলির সঙ্গে। পরে তাঁরই সূত্র ধরে আবু সয়ীদ আইয়ুব, রশীদ করীম, শামসুর রহমান এমন অনেক সাহিত্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নিবিড় এক সখ্য গড়ে ওঠে সুস্মিতার।
১৯৭১ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের কর্মকর্তা রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এবং তাঁকে ১৯৭১ সালে লন্ডনে বিয়ে করেন। সুস্মিতা আনোয়ার হয়ে ওঠেন সুস্মিতা ইসলাম। এই স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৬ সালে।
এই গ্রন্থে সুস্মিতা ইসলামের বুকচাপা কান্না যেমন শোনা যায়, তেমনই আছে বাংলাদেশ এবং চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের সাংস্কৃতিক আবহ। এই গ্রন্থে তাঁর হৃদয়ের ব্যথাকে অনুভবের সঙ্গে পাঠক পেয়ে যান একটি কালকে।
ঢাকার ‘কালি ও কলম’ এবং ‘শিল্প ও শিল্পী’ পত্রিকার সম্পাদক