পাঞ্চালী: দ্য গেম অব ডাইস
কাহিনি: শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়
৭৯৯.০০
পেঙ্গুয়িন
শ্রুতি থেকে উৎসারিত কোনও মহাকাব্য নতুন করে বলতে গেলে প্রয়োজন সেই কাহিনির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অবলম্বন করা। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা মহাভারত-আশ্রিত এই গ্রাফিক নভেলে তা করা হয়েছে মহাকাব্যের মর্যাদা ধরে রেখেই, বর্তমান সময়ের সঙ্গে সন্ধি করে। সমাজ-সভ্যতা যে এক প্রচণ্ড কাহিনির মুখোমুখি হতে চলেছে, তার রূপ বর্ণনা করতে করতেই যে কারণে দেখতে পাওয়া যায়, নদীর জল আচমকা রক্তে রাঙা হয়ে গিয়েছে এবং তার কয়েকটি ফ্রেম পরেই, কেন এমন হচ্ছে তা বলতে গিয়ে শিবাজী তখনকার মতো এমন মন্তব্যও করতে পারছেন যে, “দি অ্যানসার ইজ় ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড।”
শিবাজীও তাই আমাদের সময়ের সৌতি। সৌতি উগ্রশ্রবার চরিত্রটিও শিবাজীর সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে উগ্রশ্রবা কাহিনিটি বলছেন, আর তাতে জড়িয়ে নিচ্ছেন সংস্কৃতির নানা পরত। গ্রন্থটির প্রথম পর্ব ‘ব্যাস: দ্য বিগিনিং’-এ সৌতি কাহিনিটি আরম্ভ করেছিলেন নৈমিষারণ্যের চিন্তকদের সামনে। এ বার তিনি উপস্থিত নগরের প্রান্তে। বর্তমান গ্রন্থটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কাহিনি হিসেবেই পড়া যাবে, প্রাসঙ্গিক পুরনো কথা এখানে ছবির ছোট ছোট ফ্রেমে কোথাও কোথাও বলে দেওয়া হয়েছে। এ বার তাঁর শ্রোতাদের দেখে মনে হয় শ্রমজীবী। আগের বার চিন্তকদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে কাহিনিটি এগিয়েছিল। এই গ্রন্থেও তেমন, কাঁধে ঝাড়ু নিয়ে এক শ্রোতা প্রশ্ন করেন, জতুগৃহে আগুন দেওয়ার সময় পাণ্ডবেরা কি খেয়াল করেননি যে, পাঁচ পুত্রকে নিয়ে আর এক মহিলাও সেখানে রয়েছেন? শিবাজী বুঝিয়ে দিচ্ছেন, মহাভারতের শ্রোতার বৈচিত্রও বাড়ছে এবং শ্রোতা তাঁর অধিকার ও বঞ্চনার প্রশ্নে সচেতন। ধর্মপুত্র বলে যুধিষ্ঠিরের অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠাও নগরে কাজ করতে আসা শ্রমজীবী বিনা প্রশ্নে মেনে নেন না। এই মেনে না নেওয়া পাশা-পর্বের আবহও তৈরি করে।
এই যে শ্রোতাদের ভূমিকাকেও গুরুত্ব দেওয়া, তাতে শিবাজীর রচনাও অবলীলায় ছাপিয়ে যায় কোনও নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার গল্প হিসেবেই মহাভারতকে চেপে ধরে রাখার অন্যায় আবদারকে। নানা সংস্কৃতির প্রভাব শিবাজীর কাহিনিটির গায়ে অতি লাবণ্যে জড়িয়ে যায়। তাতে শঙ্খও হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থের অলঙ্করণে সুমের-মেসোপটেমিয়া থেকে ইলোরার ভাস্কর্যের ছায়া তুলে আনতে পারেন। তাই শঙ্খ দক্ষিণ দিনাজপুরের চদরবদরও ব্যবহার করতে পারেন কুরু-পাণ্ডবদের সম্পর্কের টানাপড়েন বোঝাতে। সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যেই থাকে পাতা জোড়া পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাদা-কালো ছবির স্কেচ। কিন্তু খুবই যত্নের সঙ্গে সেই স্কেচগুলোর বিবরণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে তাতে একটি আবশ্যিক নীরব ইঙ্গিত থেকে যায় যে, মহাভারত-লেখকদের কল্পনায় যতই তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটুক, মহাকাব্যটির পূর্বসীমা জোরের সঙ্গে হেঁকে বললেও খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের খুব বেশি পিছনে যেতে পারে না। দ্বিতীয় পর্যায়ের নগরায়ণের আগেই ‘জয়’-এর সৃষ্টি, এ কথা ধরেও এ কথা বলা যায়।
এখানেই ওস্তাদের হাতের দেখা মেলে। জাদু ও যুক্তি পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে রাখে শিবাজীর লেখা, শঙ্খের ছবিতে। তার শুরুটি হয় খুব নরম ভাবে। শুধু আকাশভর্তি কালো মেঘের ছবির নীচে লেখা থাকে, ‘দ্য সিটি অব বারণাবত’। জতুগৃহে আগুন দিয়ে সকুন্তী পাণ্ডবেরা সুড়ঙ্গ দিয়ে যখন ছুটে পালান, তখন তাঁদের মশালের আলোয় মনে হয়, যেন স্বয়ং পৃথিবীই আগুনরঙা চোখ নিয়ে পাণ্ডবদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বোঝা যায়, ছবিতেও আখ্যান আরও একটি ভাষ্য পাচ্ছে। কোনটা জাদু, কোনটা যুক্তি তার ভাষ্যও শিবাজী তৈরি করেন হিড়িম্বর মুখে রোমান হরফে পরিষ্কার বাংলা বাক্য ‘হাঁউ মাউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ’ বসিয়ে!
মজা হল, বাংলা না-জানা পাঠকের কাছে এই বাক্যটি রাক্ষসদের উপযুক্ত মাম্বোজাম্বো, অ্যাব্রাক্যাড্যাব্রা-র মতো জাদু-ভাষা বলে মনে হবে। কিন্তু বাংলা জানা পাঠক তার অর্থ বুঝতে পারবেন, এবং রাক্ষসেরা যে সাধারণ বাংলা বাক্যে চন্দ্রবিন্দুটুকু কেবল যোগ করে এ ভাবেই কথা বলেন, যাতে তা বুঝতে অসুবিধা না হয়, কিন্তু একটু অন্য রকমও হয়, তা তো বাংলাভাষী জানেন। চন্দ্রবিন্দুগুলোর মতোই জাদুটি তাই থেকেও থাকল না। এতদ্দ্বারা শ্রোতার স্তরভেদের সঙ্গে পাঠকের স্তরভেদও করা হল। পাঠকভেদে সংলাপের বোধগম্যতার এমন স্তরভেদের শৈলী বহুস্তরীয় মহাভারতের দার্শনিক একটি ব্যাখ্যাও উপস্থিত করে।
একই সঙ্গে এটি একটি ধাঁধাও। যুক্তি রয়েছে, যুক্তিসম্মত ধন্দের জালও রয়েছে। শিবাজীর তৈরি শকুনি ততটাই শেক্সপিরীয়, ভীম যতটা ককনি। শকুনির সংলাপে সরাসরি ঋগ্বেদের অক্ষসূক্ত উদ্ধৃত। ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে ফেরার পথে শকুনি ও দুর্যোধনের সেই সংলাপ মহাকাব্যের সীমাকে সত্যিই স্পর্শ করে। তার পরে শঙ্খের ছবিতে কাহিনিতে আবার ফিরে আসে রূপক। পঙ্গপাল যেমন শস্যদানা খেয়ে ফেলে, তেমনই শকুনির জালে পড়া যুধিষ্ঠিরের মস্তিষ্কের সব রসদ যেন পাশার নেশা খেয়ে ফেলে। দেখা যায়, শকুনি অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে খেলতে শুরু করেন। পাশা সম্ভাবনার অঙ্কের উপরে নির্ভর করে। সেখানে শকুনির অক্ষের সংখ্যা যুধিষ্ঠিরের চেয়ে বেশি হতে শুরু করে। যাঁর নাম যুধিষ্ঠির, তিনি তখন অঙ্কুশযুক্ত। যুধিষ্ঠির যখন ভাইদের বাজি ধরতে শুরু করেন, ছবির ফ্রেমগুলো যেন খাঁচার মতো হয়ে যায়। এ বার যুধিষ্ঠিরের মস্তিষ্কে একটি শকুনিকেই দেখা যায়, যে পাখি মৃত বা মৃতপ্রায়কে ভক্ষণ করে। মহাভারতের ভাণ্ডারকর সংস্করণ কঠোর ভাবে অনুসরণ করে শিবাজী জানিয়ে দেন, উনিশতম বাজিতে যুধিষ্ঠির নিজেকে হারেন, বিশতম-তে দ্রৌপদীকে বাজি রেখে পরাজিত হন। প্রসঙ্গত, দেবপালের মুঙ্গের ও নালন্দা তাম্রশাসনের মতো বেশ কিছু লেখ-তে ভূমি রক্ষার জন্য যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়েছে, যুধিষ্ঠির যেন সম্পত্তির উপযুক্ত রক্ষাকর্তা। অথচ, মহাভারতের পাশা খেলায় তিনি তাঁর সব সম্পত্তি বাজি রাখেন ও বার বার হারের পরেও নিবৃত্ত হন না।
এ বার দ্রৌপদীর সেই বিখ্যাত প্রশ্ন, যুধিষ্ঠির নিজেকে হারানোর পরে স্ত্রীকে বাজি রাখতে পারেন কি? এই ধাঁধায় পাতার পর পাতা কালো হয়ে যায়। কেবল কমলাক্ষী দ্রৌপদীর চোখ দুটো জেগে থাকে। যাঁর নাম ধৃতরাষ্ট্র, তাঁকে দিয়েই শিবাজী বলিয়ে নেন, এই ধাঁধার জবাব আমার কাছে নেই, দ্রৌপদী।
এই গ্রন্থে সৌতি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাই যুক্তি ও জাদু দিয়ে নির্মাণ করেছেন জানা একটি আখ্যানের প্রাসঙ্গিক একটি প্রকাশ। তাঁকে ও শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ প্রকাশককেও, এই মহাকাব্যিক প্রকল্পে আগ্রহের জন্য।