জীবন মৃত্যু (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)/ অসীম রায়
সম্পাদক: রবিশংকর বল ও কুশল রায়
৬০০.০০ (প্রতি খণ্ড)
৯ঋকাল বুকস
প্রয়াত লেখক অসীম রায়ের এই আত্মজীবনীতে বেশ কিছু ফটোগ্রাফ ছাড়াও শিল্পীদের আঁকা নানা ড্রইং ও স্কেচ, পাতার মুদ্রণকে ভিতরে ঠেলে পার্শ্বিক তথ্য ও টীকাভাষ্য ইত্যাদি দিয়ে চমৎকার, কিছুটা উত্তর-আধুনিক (আমি যতটা বুঝি) চেহারায় প্রকাশ করেছেন দুই সম্পাদক, যাঁদের একজন, বেদনার বিষয়, আজ আর নেই। ‘দুই’ খণ্ডটি তাই প্রত্যাশিত ভাবে তাঁকেই উৎসর্গ করা হয়েছে, এ খণ্ডে অন্যতর সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম রক্ষা করেই। মুদ্রণ-পারিপাট্যে এবং প্রকাশনার অন্যান্য গুণে খণ্ড দু’টি মুহূর্তেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বইটি নিয়ে যখন পড়তে বসি তখন আকর্ষণ নিছক দৃষ্টিসুখে সীমাবদ্ধ থাকে না। বস্তুতপক্ষে একজন আত্মসচেতন, মননশীল, ভাষাবিচক্ষণ, নিজের স্বাতন্ত্র্য-নির্মাণে যত্নবান ঔপন্যাসিকের লেখার যা যা গুণ তার সবই এতে তিনি নিহিত করেছেন, ফলে একবার শুরু করলে প্রায় ৭৮০ পৃষ্ঠার এই আখ্যান শেষ না করে ওঠা মুশকিল। সেই সঙ্গে আছে পরিশিষ্টে লেখকের পঞ্চাশ বছর বয়সের একটি সংবর্ধনা-পুস্তিকার সংযোজন, যাতে বিষ্ণু দে, নীহাররঞ্জন রায়, অমলেন্দু বসু প্রভৃতির লেখা অসীম রায়ের নানা উপন্যাসের আলোচনা। লেখক হিসেবে যিনি অত্যন্ত প্রখর ভাবে আত্মসমর্থক ছিলেন তিনি এই আত্মকথায় আর-একটু এগিয়ে, যেন-বা আত্ম-উন্মোচনে বদ্ধপরিকর। এক দিকে সে-পক্ষে বা থার্ড পার্সনে গিয়ে নিজেকে ব্যক্তি হিসেবে বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী করেছেন, নিজের জন্য ‘সে’, ‘তার’ ইত্যাদি সর্বনাম গ্রহণ করেছেন, অন্য দিকে অকুণ্ঠিত ভাবে, যেন এক কঠোর অনাসক্তি নিয়ে এমন সব ঘটনার কথা লিখেছেন যা খানিকটা ‘কন্ফেশনস’-এর কথা মনে পড়ায়। নিজের চেয়ে বয়সে অনেক বড় দু’টি মহিলার সঙ্গে তাঁর প্রথম যৌবনের ‘প্রেম’, বাংলাদেশের এক তরুণীর সঙ্গে তার পত্রবাহিত প্রেমের ঢেউ তাঁর নবদাম্পত্যে এসে আছড়ে পড়া, এমনকি প্রগাঢ় ভাবে সুখী এক দাম্পত্যজীবনের শেষ লগ্নে আর-এক আত্মীয়ার ‘সান্নিধ্য’— কিছুই তিনি আড়াল করার চেষ্টা করেননি। এটা কতটা গভীর সততা আর কতটা আত্মপ্রচারের দুর্মর বাসনা— পাঠককে এই প্রশ্নসঙ্কটে ফেলেন তিনি।
অথচ তাঁর পঁচিশ বছরের দাম্পত্যজীবন ছিল প্রায় নিখাদ, গীতা বসুকে তিনি সর্ব অর্থেই প্রবল ভাবে কমনীয়া এক সহধর্মিণী হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁর প্রতি লেখকের প্রেম, মমতা ও শ্রদ্ধা এ গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ব্যাপ্ত। ‘দুই’ খণ্ডের শেষে মধুপুরে গীতার মৃত্যুঘটনার মর্মান্তিকতা পাঠককেও মুহ্যমান করে, ‘যা কিছু স্পর্শ করি সেখানেই তোমার আঙুল’ কথাটি পাঠককে ছেড়ে যেতে চায় না। লেখকের আত্মনিবেদন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর নিজের জীবনীর শুরুতে গীতার প্রাক্বিবাহ জীবন এবং তাঁর পরিবারের দীর্ঘ ইতিবৃত্ত দিয়ে, এবং তা শেষও হয়েছে গীতার মৃত্যুতে। তাই মনে হয়, লেখক দু’জনের মিলিত-জীবনকেই একটি জীবন হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, কারণ ‘জীবন-মৃত্যু’ নামে মৃত্যু মূলত গীতার মৃত্যুর চিহ্নকেই বহন করছে। ভূমিকাতে বলেনও, “গীতার বাল্যকাল দিয়ে এই সাধারণ একজন লেখকের আত্মজীবনী শুরু; গীতার মৃত্যুতে এই আত্মজীবনী শেষ।”
আগেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ আত্মজীবনীর আর-একটি বিরল আর ডাকাবুকো লক্ষণ হল রাখঢাক করে কথা না বলা— বিশেষত বিখ্যাত মানুষজন সম্বন্ধে। ‘শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ক্লাসে শব্দের বোমা ফাটাতেন, যা সহজ করে বলা যায় তা কতটা কঠিন করে বলা যায় তাই ছিল তাঁর সাধনা।’ সেনেট হলের কবি সম্মেলনে কবিতা পড়ে ‘বনলতা সেনকে হত্যা করলেন জীবনানন্দ দাশ’। কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ‘লেখার মধ্যে সিনে ক্যামেরা ঘোরানোর প্রবৃত্তি স্পষ্ট’। নীরদ মজুমদার লেখককে বলেন, ‘বিষ্ণুবাবু এখনও সেই ‘পটোটাকে’ নিয়েই পড়ে আছেন?’ বিষ্ণুবাবু হলেন কবি বিষ্ণু দে, ‘পটো’ যামিনী রায়। আবু সয়ীদ আইয়ুবকে ‘মাইনর প্রবন্ধকার’ আখ্যা দেন; আবার বিষ্ণু দে-র ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর ‘বস্তুত আক্রোশ’ এবং জীবনানন্দের প্রতি ‘কার্যত উপেক্ষা’, তা-ও বলতে তিনি দ্বিধা করেন না।
লক্ষ করি, আত্মজীবনীকারের এক সময়কার কলকাতাবাসী নাগরিকদের মতো ‘হাওয়াবদল’-এর খুব ঝোঁক ছিল, এবং রিখিয়া, মধুপুর, বাবুডি, শিমুলতলায় যেমন বহু বার গিয়েছেন, তেমনই সমুদ্রে তাঁর প্রিয় আশ্রয় ছিল ওডিশার গোপালপুর অন সি। পাহাড়েও (দার্জিলিং, হরিদ্বার, দেরাদুন) কয়েক বার গিয়েছেন। কলকাতার গতানুগতিকতার বাইরে এই দাম্পত্য ও সাংসারিক বৃত্তান্ত খারাপ লাগে না, তবে কখনও একটু পুনরাবৃত্ত মনে হয়।
এই আত্মজীবনীতে আখ্যান এবং বিশ্লেষণ (আত্মকে, অপরকে, ঘটনাকে) পাশাপাশি চলেছে। কখনও কখনও মনে হয় লেখক কি একটু বেশি বেশি করে বলছেন তাঁর দ্বন্দ্বজটিল ভাবনার কথা। ‘এক’ খণ্ডে অবশ্য লেখক বলেন যে, “এটা সে বরাবরই লক্ষ করেছে দুটো নির্দিষ্ট ধারা তার মেজাজে। একটা নিপাত গদ্য। বিশ্লেষণাত্মক। সমস্ত জিনিস খুঁটিয়ে বিচার করে দেখার ইচ্ছে আর একটা কবিতার জগৎ যেখানেও খুঁটিয়ে দেখার চোখ আছে কিন্তু যা মানুষের অস্তিত্বের সমস্যার উপর আলো ফেলে।” এই সূত্র দিয়ে নিজের লেখা এবং জীবনকে তিনি বিশ্লেষণ করেন। উঠে আসে কর্মস্থল স্টেটসম্যান, সাময়িক কর্মস্থল অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসের নানা চরিত্র— সব যে অনুকূল রঙে আঁকা, তা নয়। বিষ্ণু দে, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণতি দে, নীরেন্দ্রনাথ রায়, গোপাল হালদার, গৌরকিশোর ঘোষ, কৃষ্ণগোপাল মল্লিক, হীরেন মিত্র প্রভৃতির চরিত্র মোটামুটি মমতা লাভ করেছে, সন্তোষকুমার ঘোষ, কেদার ঘোষ প্রভৃতি অতটা মমতা পাননি। লেখকের স্পষ্টবাদিতা তাঁর মায়ের সঙ্গে গীতার শীতল সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাকেও নিষ্কৃতি দেয় না। নিজের সম্বন্ধেও তাঁর মোহ নেই। এই যে মানুষটি— ম্যাজিস্ট্রেট-পুত্র, ইংরেজির উজ্জ্বল ছাত্র, অভিজাত-অভ্যাস অনুসারে ড্রেসিং গাউন পরে শীতের রোদ পোহাতেন, পাইপও মুখে থাকত কখনও— তাঁর আত্মজীবনী কখনও প্রবল আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ, কখনও শান্ত আত্মগ্লানিতে বিষণ্ণ।
এ বই সাংবাদিকের লেখা আত্মজীবনী, ফলে এতে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তাঁর সময়ের নানা ইতিবৃত্ত, কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বময় বিবর্তন, ভারত-চিন সংঘর্ষ, বাংলায় কংগ্রেস সরকারের পতন ও যুক্তফ্রন্টের প্রতিষ্ঠা, তার টালমাটাল, পরে ধস ও ইন্দিরা গাঁধীর উত্থান, জরুরি অবস্থা, চূড়ান্ত ক্ষমতা থেকে তাঁর সাময়িক পতন এবং জনতা দলের গদি দখল— এই ঝোড়ো সময়ের পরিক্রমা এসেছে। তাঁর নিজের সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আত্মবিশ্লেষণাত্মক সম্পর্কও তিনি বর্জন করেননি। ব্যক্তি, পরিবার, বন্ধু ও পরিচিত গোষ্ঠী, দল এবং দেশের আখ্যান নানা ভাবে গ্রথিত হয়েছে। ফলে অসীম রায় যোগ্য সাংবাদিকের মতোই নিজের সময়কেও কিছুটা জীবন দিয়েছেন। সমসাময়িক কবি ও লেখকদের তিনি সমালোচনা করেছেন, তা কিছুটা আংশিকতার দোষ পেয়েছে।
বইটির প্রথম সমস্যা, একাধিক প্রসঙ্গ প্রায়ই একই ভাষায় আগে-পরে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। যেমন মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুরে সম্পত্তি-সংক্রান্ত এক মামলায় তাঁর বাবার বিচারকে প্রভাবিত করার জন্য জমিদারগিন্নিদের প্রচুর মিষ্টান্ন আর খাদ্যদ্রব্য ভেট নিয়ে হাজির হওয়া এবং তাদের প্রত্যাখ্যান আর, রবীন্দ্রনাথের ভাবনাচিন্তার বিবর্তনধারার বিশ্লেষণ, ভোলাতে মসজিদের পাশ দিয়ে কীর্তনের দলের যাত্রা প্রসঙ্গে তাঁর বাবার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা ঠেকানোর প্রসঙ্গ, যেমন ‘দুই’ খণ্ডে রানা ঘোষের স্টেটসম্যান অফিসে এসে ‘অনেক বোঁদে ভেজেছেন’ বলে লেখককে বার করে নেওয়ার চেষ্টা। দ্বিতীয় সমস্যা— টীকাভাষ্যে ভুল খবর: তারকনাথ সেনের বই বলে যে নামগুলি করা হয়েছে সেগুলি আদৌ বই নয়, প্রবন্ধ; কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ আর মৌমাছি বিমল ঘোষকে এক ব্যক্তি বলে দেখানো হয়েছে, ক্ষিতীশ রায় (প্রথমে ‘ক্ষিতিশ’ আছে) রবীন্দ্রনাথের ‘ক্রাইসিস ইন সিভিলাইজেশন’ বাংলায় ‘সভ্যতার সংকট’ নামে অনুবাদ করেন এ কথা ঠিক নয়। মূল বাংলা ভাষণ রবীন্দ্রনাথেরই রচনা। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রকৃত নাম ‘নরেন্দ্রনাথ’ বলে ছেড়ে দিয়েছেন, ভট্টাচার্য যোগ করেননি, টীকা ও অচেনা ছবির হাসান আজিজুর রহমান হবেন হাসান আজিজুল হক। ‘ইউরোপিয়’, ‘আকাঙ্খা’ ‘ঔদাসিন্য’, ‘প্রসারতা’ ‘মরূদ্যান’ ইত্যাদি মুদ্রণের পারিপাট্যকে একটু নিষ্প্রভ করে। ফরাসি কবি পোল এলুয়ার আর লুই আরাগঁ (ছাপা হয়েছে ‘আরগও’)— এ দু’জনের বইয়ের নাম ফরাসি ভাষায়, কিন্তু স্তাঁদাল, বালজাক, প্রুস্ত্, সার্ত্র্— এঁদের বইয়ের নাম ইংরেজিতে। টমাস মানের বই একই টীকায় ডক্টর ফাউস্টুস আর ডক্টর ফস্টাস— দু’রকম নামই পেয়েছে। তা ছাড়া ‘স্যামসন অ্যাগনিস্টিম’, ডেসমন্ড ডয়গে, লুই আরগও (আরাগঁ), ‘ফ্রন্টয়ার’, ‘বৈরতক’, ‘বার্কিংহাম প্যালেস’ ‘রাজী বাগেশ্বরী’, ‘আর্বত’, ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’, ‘চিয়াং কাই শেখ’, ‘ক্রেসিজ’ (ক্রেসিডা) ‘অনিষ্ট’ (‘অন্বিষ্ট’) ইত্যাদিকে চিনতে গিয়ে একটু থমকাতে হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির স্কেচগুলি একটু কাঁচা হাতের বলে মনে হয়।
তবু ভিন্নতাব্যাকুল এক ব্যক্তি এবং উত্তাল সময়— উভয়কে জানবার জন্য এই দু’খণ্ড আত্মজীবনী আমাদের অবশ্যপাঠ্য।