প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)
পড়ুন বা না পড়ুন, বাঙালি মাত্রেই ‘আলালের ঘরের দুলাল’—এই প্রবাদকল্প বাক্যাংশের অর্থ জানেন। বড়লোকের বাড়ির বখে যাওয়া ছেলের গল্পকথা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ‘মাসিক’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর। সেই বাস্তব-কাহিনি অনেকের মতে বাংলা উপন্যাসের আদিরূপ। লেখকের আদত নাম প্যারীচাঁদ মিত্র— আদি বাড়ি হুগলি জেলার হরিপালে। প্যারীচাঁদের বাবা রামনারায়ণ ইংরেজ আমলে কোম্পানির কাগজ, হুন্ডি এই সব ব্যবসায়ে প্রচুর টাকা করেছিলেন, তবে তাঁর চতুর্থ সন্তান প্যারীচাঁদ মোটেই বখে যাওয়া ছেলে নন। ছোটবেলায় শিখেছিলেন বাংলা আর ফারসি। তাঁর জন্মের তিন বছর পরে ১৮১৭-য় কলকাতায় হিন্দু কলেজ গড়ে উঠেছিল। বাবা রামনারায়ণ পাশ্চাত্যভাবাপন্ন, ১৮২৭-এ প্যারীচাঁদ তাই ইংরেজি শেখার জন্য হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেন। তার আগের বছর হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ডিরোজিও। প্যারীচাঁদ তাই কেবল ইংরেজি শিখলেন না, প্রশ্ন করতে শিখলেন। ইয়ং-বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে আপাত-সহজ মত্ততার তিনি অনুসারী ছিলেন না। যুক্তিনিষ্ঠা, নীতিবোধ ও সমাজমনস্কতা তাঁর জীবনযাপনে ও বাংলা-ইংরেজি লেখার মধ্যে মিশে গিয়েছিল।
সাধারণ বাঙালি পাঠকের পক্ষে প্যারীচাঁদের লেখাপত্র পড়া সহজ ছিল না। বঙ্গদেশের বই-বাজার বড় বিচিত্র, সেখানে কী যে ছাপা থাকে আর কী যে ছাপা থাকে না তা বলা মুশকিল। তবে প্যারীচাঁদের জন্মের দুশো বছর উদ্যাপন উপলক্ষে অন্য ধারার বাংলা প্রকাশকরা প্যারীচাঁদের বাংলা-ইংরেজি রচনা পুনরায় প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে প্যারীচাঁদের নির্বাচিত ইংরেজি রচনার সুমুদ্রিত সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এ সংকলনের ভূমিকা লিখেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। সোপান প্রকাশ করেছে ‘প্যারীচাঁদ মিত্র রচনাবলী’। সেই বাংলা লেখার গোড়ায় আছে অলোক রায়ের ‘পরিচিন্তন’। খোয়াবনামা প্রকাশ করেছে সটীক ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’। সে বইয়ের টীকা রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তরুণ শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া। অস্বীকার করার উপায় নেই এই সুমুদ্রিত সটীক মদ্যপান নিবারণী নীতিগ্রন্থটি শুধু নয়নশোভন নয়, ‘পাঠকলোভন’। শ্রুত্যানন্দ টীকাকার হিসেবে ‘যাহা জানি লিখি’ গোত্রের নন, তাঁর পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। মূল পাঠ্যে শব্দটি কোন পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত তা খেয়াল রেখে তিনি টীকা যোজনা করেছেন, অহেতুক বাক্বিস্তার করেননি। বইয়ের গোড়ায় সুস্পষ্ট ভাবে সম্পাদনা নীতি উল্লেখ করেছেন।
সিলেক্টেড ইংলিশ রাইটিংস। প্যারীচাঁদ মিত্র। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ৫৫০.০০
প্যারীচাঁদ মিত্র রচনাবলী। সোপান, ৪৫০.০০
মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়। খোয়াবনামা, ২০০.০০
প্যারীচাঁদের বাংলা ভাষার অনুরাগী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের থেকেও লেখক হিসেবে প্যারীচাঁদকে বেশি খাতির করতেন। ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়বাবু... প্রশংসা ব্যতীত অপ্রশংসার পাত্র নহেন’ তবে ‘যে ভাষা সকল বাঙ্গালীর বোধগম্য এবং সকল বাঙ্গালী কর্ত্তৃক ব্যবহৃত’ বঙ্কিমের মতে প্যারীচাঁদ প্রথম তা বাংলা ছাপা বইতে ব্যবহার করলেন। বাংলা গদ্যে ইংরেজি ও সংস্কৃতের ছায়া অতিক্রম করে তিনি ‘স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার হইতে আপনার রচনার উপাদান’ সংগ্রহ করলেন। বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমারের তুলনায় প্যারীচাঁদকে বঙ্কিম বড় করে তুলেছিলেন কি না তা বিতর্কের বিষয়। স্বভাব বলতে বঙ্কিম এখানে বাস্তবতাকে বুঝিয়েছেন। বাঙালির সমাজগ্রাহ্য বাস্তবতা প্যারীচাঁদের লেখায় শুধু ধরাই পড়েনি, আদর্শ বাস্তব কেমন হওয়া উচিত সে কথাও প্যারীচাঁদের লেখায় ছিল। সাহিত্যে বাস্তবের অনুকৃতিই কেবল থাকবে না, আদর্শ বাস্তব কেমন হওয়া উচিত তার দিশাও থাকবে। আলালের ঘরের দুলালের শেষে কুপুত্র মতিলাল অনুতাপদগ্ধ। এই অনুতাপের আগুনে পাপ পুড়ে যায়, প্রায়শ্চিত্ত হয়। বঙ্কিম তাঁর পরিণত উপন্যাসে বাঙালির ঘরে ঘরে অমৃতফল ফলানোর জন্য নগেন্দ্র-গোবিন্দলালদের অনুতাপের আগুনে পোড়ান, প্যারীচাঁদের মডেলের তিনি অনুসারী। ‘স্ত্রীর অন্য পুরুষের প্রতি মন কখন হইবে না এবং পুরুষেরও অন্য স্ত্রীর প্রতি মন কদাপি যাইবে না’— এই একগামী আদর্শের কথা প্যারীচাঁদ তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর শেষে লিখেছিলেন। দাম্পত্যের এই আদর্শ তো বঙ্কিমেরও মান্য— পরিবার, সমাজ নির্মাণে রূপমোহ বড়ো বালাই। সেই বালাই জয় করা চাই। আদর্শ দাম্পত্য, আদর্শ পরিবার থেকে আদর্শ জাতির উদ্ভব!
নীতিনিষ্ঠতা প্যারীচাঁদের লেখার রমণীয়তা কিছুমাত্র খর্ব করেনি। ‘মদ খাওয়া বড় দায়’-এর ‘ভূমিকা’য় টেকচাঁদ লিখেছিলেন, ‘বাসনা ছিল যে দুই তিনটী গল্প তসবিরের সহিত প্রকাশ হইবে’। তাঁর সে বাসনা পূর্ণ হয়নি। বাংলা মুদ্রণের সেই শৈশববেলায় অলংকরণ ছাপা সহজ ছিল না। তসবির ছাপাতে না পারলেও প্যারীচাঁদের লেখা ছবির মতো। ‘কি আজব দেখিলাম শহর কলিকাতায়’ লেখাটিতে শহুরে বামুনদের চরিত্রচিত্র বড় রংদার। ‘কোন খানে বলরাম ও রামেশ্বর ঠাকুরের সন্তানেরা শূদ্রের বাটীতে জলস্পর্শ করেন না কিন্তু বেশ্যার ভবনে এমন করিয়া আহার ঠাসিতেছেন যে পাত দেখিয়া বিড়াল কাঁদিয়া মরে।’ বটতলা থেকে ছাপা চটি বইতে শনিবারের মজা, মদ্যপান ইত্যাদি নিয়ে নানা রসিকতা থাকত তবে সে চটি বই সাহিত্যের সামাজিক দায়িত্ব এ ভাবে স্বীকার করত না।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর সুলিখিত ভূমিকায় খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন প্যারীচাঁদ নিতান্ত বহুপ্রজ লেখকমাত্র নন, বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ জীবনকথার প্রণেতা। দেওয়ান রামকমল সেন, ডেভিড হেয়ার, কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট প্রমুখের জীবনকথা লিখতে গিয়ে প্যারীচাঁদ যথাসম্ভব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে না দিয়ে সমকালকে বুঝতে চেয়েছেন। প্যারীচাঁদ গ্রন্থাগারিক ছিলেন, পিটার গ্রান্ট লিখেছিলেন প্যারীচাঁদের ‘love of study and readiness of apprehension’ প্রশংসনীয়। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গদেশীয় সামাজিক বিজ্ঞানসভা তাঁর সরব দায়িত্বপূর্ণ উপস্থিতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। জ্ঞানের নানা পথে বিচরণ করাতেই তাঁর স্বাভাবিক আনন্দ। তাঁর রচিত ‘কৃষিপাঠ’ মনোগ্রাহী বই। সেগুন গাছ, কুসুম ফুল, তুত ইত্যাদির অর্থকরী দিক নিয়ে তাঁর সুস্পষ্ট পরামর্শ রয়েছে সে বইতে। তিনি মনে করতেন শিক্ষা দুই প্রকার— জ্ঞানকরী ও অর্থকরী। উপার্জনের জন্য কেবল শিক্ষা নয়— জ্ঞান ও নীতি শিক্ষার উদ্দেশ্য। সব রকম শিক্ষাই চাই। তাঁর ‘রামারঞ্জিকা’য় আছে ‘বাড়ীর দরয়ান শীতল সিংহের দুটী’ মেয়ের কথা। একজন শীতল সিংহের মৃত্যুর পর পাঁচালির দলে ঢুকে ‘বেশ্যা’ হয়েছে অন্য জন ‘আগরপাড়ার বিবির স্কুলে পড়িয়া’ সৎপথে গিয়েছে। প্যারীচাঁদের সিদ্ধান্ত, ‘যেমন একটা চারাকে যেদিকে ইচ্ছা করি সেইদিকে নোয়াতে পারি, মনও তদ্রূপ’। মন ও সমাজের ওপর সর্বার্থে পরিবেশের প্রভাব স্বীকার করেন বলেই প্যারীচাঁদ পরিশোধনের জন্য নীতিনিষ্ঠ গল্পকথা লেখেন ও ইংরেজিতে বঙ্গদেশের বাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থা, রায়তদের অবস্থা নিয়ে তথ্যবহুল নিবন্ধ রচনা করেন। সমাজ ও পরিবেশ না চিনলে জাতির উন্নতির পথ নির্দেশ করা সম্ভব নয়। দুশো বছর আগে বাংলা-ইংরেজি দু’ভাষায় সচল প্যারীচাঁদের লেখাগুলি পড়লে হালের বাঙালি পাঠকেরা লাভবান হবেন।