চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

তমসার ভিতর থেকে উৎসারিত যে সৌন্দর্য

গ্যাঞ্জেস গ্যালারিতে চলছে যোগেন চৌধুরীর একক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ গ্যাঞ্জেস গ্যালারিতে চলছে যোগেন চৌধুরীর একক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:২৩
Share:

শিল্পী: যোগেন চৌধুরী

সময় ও প্রজ্ঞা বা সময়ের ভিতর দিয়ে জারিত প্রজ্ঞা একজন প্রতিবাদী শিল্পীকেও অনেক সময় আস্তিকতার দিকে নিয়ে যায়। গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে চলছে যোগেন চৌধুরীর ৬০-টি ড্রয়িং নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনী। যা দেখে কোনও দর্শকের এ রকম মনে হতে পারে।

Advertisement

যোগেন চৌধুরীর সারা জীবনের সাধনায় তাঁর রেখার একটি বিশেষ চরিত্র তৈরি করেছেন। সেই রেখা এক সময় বিপন্ন বাস্তবের সমস্ত তমসাকে আত্মস্থ করেছে। তার পর সেই তমসার ভিতর থেকেই এক আলোকিত সৌন্দর্য নিষ্কাশিত করেছে। আলোচ্য প্রদর্শনীর কালি-কলম, কালি-তুলি ও প্যাস্টেলে আঁকা ছবিগুলিতে সেই তমসাদীর্ণ আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পাই আমরা।

তাঁর রেখার ক্রমিক বিবর্তনের দিকে তাকালে দেখা যায় সেই রেখা আমাদের চিত্রের আধুনিকতার বিবর্তনকে অনুসরণ করেই ধীরে ধীরে পাল্টেছে। ১৯৫৫ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে ওপার বাংলার ফরিদপুর জেলা থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৮৬-তে অনুষ্ঠিত ‘ভিশনস’ প্রদর্শনীতে তাঁর ছাত্রজীবনের গোড়ার দিকের বেশ কয়েকটি ছবি দেখছিলাম। সেখানে ১৯৫৬-য় আঁকা ওয়াশ ও টেম্পারার একটি ছবি ছিল ‘শীতের সকাল’ শিরোনামে। কুয়াশাময় ভোরে কোনও গ্রামে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের দৃশ্য রূপায়িত হয়েছিল সেই ছবিতে। অনুশীলনমূলক সেই রচনায় রেখা ও ছায়াতপের চলনে নব্য-ভারতীয় ধারার যে প্রতিফলন দেখতে পাই, তা আর্ট কলেজ জীবনের আরও অনেক ছবিতেই ছিল। কিন্তু সহসাই যেন এই সুরেলা কোমলতাকে প্রত্যাখ্যান করেন শিল্পী। ১৯৬০-এ তাঁর আর্ট কলেজের শিক্ষা শেষ হয়। সে বছরই ১৭ অক্টোবর আঁকা তাঁর একটি আত্মপ্রতিকৃতি ছিল ওই প্রদর্শনীতে। এই ছবিতে রেখার যে চরিত্র দেখি, তা যেন সময়ের এবং সেই সময় জারিত শিল্পীর আত্মারও সমগ্র তমিস্রা থেকে সঞ্জাত হয়েছে। আর্ট কলেজে শিক্ষার সময়েই তিনি পরিচিত হন জার্মান অভিব্যক্তিবাদী শিল্পী কাথে কোলভিৎসের ছবির সঙ্গে। সেই প্রতিবাদী অভিব্যক্তি থেকে যোগেন তাঁর প্রকাশের একটি অভিমুখ অর্জন করতে পারেন, যা তাঁর রেখার চরিত্রকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল সেই সময়। ১৯৬৫-তে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি প্যারিসে যান। পাশ্চাত্যের অভিঘাতে তাঁর রেখায় যে পরিবর্তন আসছিল তাতে সমগ্র সামাজিক ক্ষয়কে স্ফীতিতে রূপান্তরিত করছিলেন তিনি। তমসাজারিত এই কর্কট-সদৃশ স্ফীতিই তাঁর রেখায় আনে শ্লেষাত্মক এক প্রতিবাদী চরিত্র। যা নানাভাবে রূপান্তরিত হয় তাঁর মাদ্রাজ পর্বে (১৯৬২ থেকে ৭২) ও দিল্লি পর্বে (১৯৭২ থেকে ৮৭)। ১৯৮৭-তে তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে অধ্যাপক হিসেবে আসেন। শান্তিনিকেতনে রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার তাঁর শিল্পী চেতনাকে অনেকটাই রূপান্তরিত করেছে। রেখার সেই স্ফীতিকে তিনি এক সংক্ষুব্ধ সৌন্দর্যের দিকে নিয়ে গেছেন। যোগেন চৌধুরীর ছবিকেও কি আজ শান্তিনিকেতন ঘরানার অন্তর্গত করে ভাবা যায়, সোমনাথ হোরের সমান্তরালে? দুজনের কেউই শান্তিনিকেতন সঞ্জাত নন, কিন্তু ওই ভাবাদর্শই হয়তো অন্ধকারের উৎস থেকে আলোর সন্ধান দিয়েছে তাঁদের। তাঁর সারা জীবনের বিবর্তন-ধারাকে মনে রেখে আলোচ্য প্রদর্শনীর ছবিগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে আঁধার নিঃসৃত এক আলো আমাদের ছুঁয়ে যায়। এখানে তাঁর ছবির বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে পুরুষ ও নারীর মুখাবয়ব, পশু, পাখি, ফুল, লতা ও নিসর্গ। ‘একজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মুখ’ শিরোনামে একটি ছবি আছে এই প্রদর্শনীতে। খুবই সুস্মিত মুখ। আমাদের মনে পড়তে পারে ১৯৭৩-এ ‘বুদ্ধিজীবী’-কে তিনি এঁকেছিলেন স্ফীত এক চালকুমড়োর রূপে। আজ তাঁর সেই ক্রোধ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। কোথাও কোথাও ক্ষতবিক্ষত মানুষ যে আসেনি, তা নয়। ‘ফেস স্ক্র্যাচড’, ‘ফেস অব এ ম্যান ইন অ্যাগনি’ বা ‘থ্রি আইড ম্যান’ শীর্ষক ছবিগুলি এর দৃষ্টান্ত। অন্যান্য সুষমাময় মুখের অনেকগুলোতেও কিন্তু অন্তরের হতাশার অনুরণন আছে। তবু হতাশা জারিত লাবণ্যই এই প্রদর্শনীর মূল সুর, যা মন্ময়ভাবে প্রকাশিত হয়েছে লতা, ফুল, পল্লব ও নিসর্গের রূপায়ণগুলিতে। ১৯৬০-এর দশকের পর থেকে যে আস্তিকতার আলো উপহার দিয়েছেন শিল্পী, আজকের দর্শককে তা সমৃদ্ধ করে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement