বর্তমান যুগে চীন সাম্রাজ্য
বিনয়কুমার সরকার
গৃহস্থ পাবলিশিং হাউস, ১৯২১
অতিমারিতে ঘরবন্দি থেকে অনেক বই পড়ার সুযোগ হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে মনে দাগ কেটেছে টমাস পিকেটি-র ক্যাপিটাল অ্যান্ড আইডিয়োলজি বা চিওয়েই সি-র ডেমোক্র্যাসি ইন চায়না: দ্য কামিং ক্রাইসিস। তবে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও প্রাসঙ্গিক বিনয়কুমার সরকারের প্রায় ১০০ বছরের পুরনো বাংলা কেতাব বর্তমান যুগে চীন সাম্রাজ্য।
১৯১৪ সালে যখন বিনয়বাবু দেশ ছেড়েছিলেন, তখন তাঁর কানে বেজেছিল— “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনক’ তুমি।” মিশর, ইংল্যান্ড, আয়ার্ল্যান্ড, আমেরিকা, জাপান ঘুরে চিন পৌঁছে হঠাৎ তাঁর মনে হল, তিনি ভারতের একটি জুড়ি খুঁজে পেয়েছেন। তিনি লিখলেন, চিন ভারতবাসীর মাসির বাড়ি। অতএব চিনা ও ভারতবাসী মাসতুতো ভাই।
১৯১৫-র অগস্ট থেকে ১৯১৬-র জুন পর্যন্ত প্রায় ন’মাস বিনয়বাবু চিনে ছিলেন। তাঁর কেতাব প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে, যদিও এই পর্যটকের ডায়েরি তথা মানবতত্ত্বের মশলা লেখা হয়ে গিয়েছিল ১৯১৫-তেই। বিনয়বাবুর প্রথমেই চোখে পড়েছিল বিদেশিদের অত্যাচারে চিনাদের দুর্দশা।
বেজিং থেকে ট্রেনে চেপে বিনয়বাবু হেনান ও হুবেই প্রদেশে গিয়েছিলেন। তিনি লিখছেন, “ফেরিওয়ালার চীৎকার, দরদস্তুর, মোসাফেরদিগের কলরব ইত্যাদি ভারতবর্ষ ছাড়িবার পর আর পাই নাই।” সন্ধ্যার পর কেরোসিনের লণ্ঠন তাঁকে ভারতীয় গ্রামের কথাই মনে পড়িয়ে দিত। তাঁর প্রশ্ন, কলকাতার বাঙালি যদি পুণের মরাঠাকে এবং মাদুরাইয়ের তামিলকে নিজের ভাই বলে ডাকতে পারে, তা হলে উত্তর চিনের জনগণকেও ভাই বলে কেন ডাকতে পারবে না? কেবলমাত্র ভাষার প্রভেদকে তিনি বড় করে দেখতে নারাজ। তাঁর দৃঢ় মত: “সমগ্র এশিয়াই এক। যদি এশিয়ার ঐক্য অবিশ্বাস করিতে হয় তাহা হইলে আগে ভারতের ঐক্য অবিশ্বাস করিতে হইবে।”
সে-কালের হ্যান-কাও, আজকের উহান নগরে পৌঁছে অবশ্য তিনি দেখলেন ইংরেজ কনসেশনে শিখ সৈন্য পাহারাওয়ালার কাজে নিযুক্ত। তাই চিনারা ভারতবাসীকে এই রকম বরকন্দাজ হিসেবেই জানে। বিনয়বাবুর পর্যবেক্ষণ: “চীনের যত স্থানে এইরূপ বিদেশী কনসেশন-মহাল্লা আছে সেই সকল স্থানে ন্যূনাধিক পরিমাণে ভারত-বিদ্বেষ জন্মিয়াছে।”
চিনের বৌদ্ধসমাজের চেয়ে বিনয়বাবুর মুসলমান সমাজকেই বেশি আত্মীয় মনে হয়েছিল। তাঁর মনে প্রশ্ন: “এখানে মুসলমানের সাক্ষাৎ পাওয়া মাত্র হৃদয়ের যে তন্ত্রী বাজিয়া উঠিল, শাক্য সিংহের উপাসক চীনা জাপানী বৌদ্ধগণকে দেখিয়া সে তন্ত্রী বাজিল না কেন?” এর উত্তর তিনি নিজেই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন: “বোধ হয় এই যে ভারতবর্ষ (অত বড় দেশটার চতুঃসীমা মনে থাকে না— কেবল বাংলা দেশটার কথাই বলি), অথবা বাংলা দেশ কেবল হিন্দুস্তান নহে, মুসলমানস্তানও বটে।” জন্ম থেকে বাঙালি হিন্দু মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে খেলা করে। তার পর, “বাজারে, দোকানে, হাটে, গোচারণ-মাঠে, কৃষিক্ষেত্রে, পরবে মেলায়, ধর্মকর্মে, উৎসবে ব্যসনে দুর্ভিক্ষে শ্মশানে হিন্দুর সাহচর্য মুসলমান করে, মুসলমানের সাহচর্য হিন্দু করে। হিন্দুর রক্তের সঙ্গে মুসলমানের নিশ্বাস মিশিয়া আছে—মুসলমানের রক্তে হিন্দুর নিশ্বাস লক্ষিত হয়।”
বিনয়বাবু মালদহ জেলার কৃতী সন্তান। আজকের ধর্মীয় মেরুকরণের যুগে তাঁর হিন্দু-মুসলমানের সাহচর্য, সহবাস ও ভ্রাতৃত্বের দুশ্ছেদ্য বন্ধনের বিষয় এই লেখা দুঃসময়ে আশার আলো দেখায়। দর্শন আলোচনা করে বা ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্য দেখিয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ বা পার্সি ও বৈদিকের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। কিন্তু বিনয়বাবুর বক্তব্য, “মস্তিষ্কের আবিষ্কারে কি হৃদয়ের টান, মায়ার শৃঙ্খল সৃষ্টি করিতে পারে।”
এই কেতাবে সাম্রাজ্য ও স্বরাজের বিষয়ে বিনয়বাবু যথেষ্ট ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন। ‘এম্পায়ার’-এর বাংলা সাম্রাজ্য, ‘রিপাবলিক’-এর বাংলা, তাঁর ভাষায়, স্বরাজ। চিনের স্বরাজপন্থীরা ছিং সাম্রাজ্যের গায়ে বিদেশি তকমা এঁটে দিয়ে ভুল করেছিলেন। ইতিহাসের গভীর পর্যালোচনা করে বিনয়বাবু দেখিয়েছেন যে ভারত যেমন মুঘল আমলে পরাধীন ছিল না, চিনও মাঞ্চু আমলে পরাধীন ছিল না। ইতিহাসের এই তত্ত্ব আজকের হিন্দু ও হান উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী। পুরনো সাম্রাজ্য ভিন্নতাকে মান্যতা দিয়ে ঐক্য সৃষ্টি করতে জানত। আজকের জাতীয়তাবাদ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী।
বিনয়বাবু লিখছেন, “চীনাদের ভবিষ্যৎ ঐক্যবদ্ধ মহাচীন গঠনে নয়— বহুসংখ্যক ছোট, বড়, মাঝারি স্বাধীন ও শক্তিশালী চীন গঠনে। এই বহুত্ববাদ এবং শক্তিকেন্দ্রের মাহাত্ম্য চীনারা বুঝিবে না কি?” একই প্রশ্ন ভারতবাসীকেও করা যায়। এক শতাব্দীর ও পার থেকে বিনয়কুমার সরকার যেন বলতে চাইছেন যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় চিন ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের ভিত্তির উপর প্রকৃত ঐক্যবদ্ধ এশিয়া গড়ে তোলা সম্ভব।