প্রতিস্পর্ধা: শাহিন বাগে সিএএ, এনআরসি-বিরোধী জমায়েত। ফেব্রুয়ারি, ২০২০।
বর্ন আ মুসলিম: সাম ট্রুথস অ্যাবাউট ইসলাম ইন ইন্ডিয়া
গজ়ালা ওয়াহাব
৯৯৯.০০
রূপা, আলেফ
২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর সন্ধেবেলায় সংসদে যখন নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নতুন আইন পাশ হল, তরন্নুম বেগম তখন বাড়িতে বসে রুটি করছিলেন। দিল্লির জামিয়া নগরের বাটলা হাউস এলাকায় দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। বড় ছেলে সবে অল্পস্বল্প রোজগার শুরু করেছে। সংসার ঠেলতেই মায়ের দিন কেটে যায়। কিন্তু তিন দিন পরে যখন খবর এল— কাছেই জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় পুলিশ ঢুকে সব তছনছ করেছে, ছাত্রদের বেধড়ক মেরেছে, টিয়ার গ্যাস চালিয়েছে, তখন তরন্নুম বেগম রান্না বন্ধ করে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লেন ‘অব নহী তো কব’ বলে চিৎকার করতে করতে। পাশের বাড়ির মহিলাও একই সঙ্গে রাস্তায় নামলেন, তিনিও খবরটা শুনেছেন। আশপাশ থেকে আরও মেয়েরা যোগ দিলেন। পরস্পর জানতে পারলেন, সবাই শাহিন বাগে জড়ো হচ্ছে। তাঁরাও হাজির হলেন সেখানে। বাকিটা ইতিহাস। গজ়ালা ওয়াহাব তাঁর বইয়ের একটি অধ্যায়ের শুরুতে দু’বছর আগের এই ঘটনার কথা লিখতে গিয়ে স্মরণ করেছেন মজরুহু সুলতানপুরীর লেখা দু’টি জনপ্রিয় লাইন: “ম্যায় আকেলা হি চলা থা জানিব-এ-মনজ়িল মগর/ লোগ আতে গয়ে, কারওয়াঁ বনতা গয়া।” অক্ষম অনুবাদে মানেটা মোটামুটি দাঁড়ায় এই রকম— একলাই যাচ্ছিলাম আমার ঠিকানায় পৌঁছব বলে, কিন্তু/ লোক আসতেই থাকল, মিছিল তৈরি হয়ে গেল। উপসংহারের ঠিক আগের ওই অধ্যায়টির শিরোনাম: ‘দ্য চেঞ্জিং ফেস অব দ্য মুসলিম সোসাইটি’।
আগরার মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে গজ়ালা। সত্তরের দশকে ছোটবেলাটা কেটেছিল যৌথ পরিবারে, সাবেক মহল্লায়। একটু বড় হতে যৌথ পরিবারের নাড়ি ছিঁড়ে ফ্ল্যাটবাড়িতে এলেন স্কুলের কিশোরী। ক্রমে দিল্লির কলেজ, অতঃপর সাংবাদিক জীবন। ‘বর্ন আ মুসলিম’— মুসলমান হয়ে জন্মানোর সুবাদে দৈনন্দিন প্রতিবেশে ধর্মাচরণের এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও নিজে কোনও দিনই তার ঘনিষ্ঠ শরিক হননি, বাড়ির কোনও চাপ ছিল না। যত বড় হয়েছেন, অভিজ্ঞতার ছাপ ক্রমশ চেতনাকে গড়েছে, ইসলাম এবং মুসলমান জনসমাজের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। ধর্ম এবং সেই ধর্মকে ঘিরে গড়ে ওঠা সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পড়া এবং শোনা দুই-ই— সাংবাদিকতার অনুশীলন বহু প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং চিন্তাশীল মানুষের কাছে নিয়ে গেছে তাঁকে, কথা বলেছেন তাঁদের সঙ্গে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছেন নানা বিষয়ে, প্রশ্ন তুলেছেন, নিজের ধারণাকে সমৃদ্ধ ও শানিত করেছেন— বইয়ের প্রায় আক্ষরিক অর্থে প্রতি পাতায় তেমন কথোপকথনের নির্যাস পরিবেশিত হয়েছে।
এ-বইয়ের সাবটাইটল-এ ‘ভারতে ইসলাম সম্পর্কে কিছু সত্য’ সন্ধানের কথা আছে। সেটা কোনও ‘যাহা জানিলাম তাহা লিখিলাম’ গোত্রের ব্যাপার নয়। প্রায় চারশো পৃষ্ঠার পরিসরে আলোচনা যত এগোয়, ততই পরিষ্কার হতে থাকে যে, সাংবাদিক-লেখক তাঁর আন্তরিক জিজ্ঞাসার প্রেরণায় ভারতীয় মুসলমানের সমস্যাকে বুঝতে এবং উত্তরণের পথ খুঁজতে চাইছেন। তার ফলে এ-বই দু’টি তারে বাজে— ব্যক্তিগত এবং বিষয়গত। দু’টিকে মেলানো কঠিন কাজ। দোতারার দুই স্বর সর্বদা ঠিকঠাক মেলে না, পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয় একটা বই থেকে আর একটা বইয়ে যাতায়াত করছি। কিন্তু এটাও অবশ্যই বলা দরকার যে, লেখক কঠিন কাজটিকে অনেক দূর অবধি সাধন করেছেন। এবং, ব্যক্তিগত কথা যতটা বলা যেত তার চেয়ে তিনি অনেকটা কম বলেছেন, ফলে পাঠকের কখনও মনে হয় না যে লেখক নিজেকে জাহির করতে চান, বরং তাঁকে আর একটু জানতে ইচ্ছা করে। বিরক্তি অপেক্ষা অতৃপ্তি বহুগুণ শ্রেয় বইকি।
প্রথম অধ্যায়ে আত্মজীবনীর স্বাদ সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক, কারণ শৈশব কৈশোর এবং প্রথম তারুণ্যের নানা অভিজ্ঞতাই লেখকের জিজ্ঞাসার উৎস। পরের তিনটি অধ্যায়ে ইসলামের সূচনা থেকে শুরু করে বিবর্তনের বিভিন্ন পর্বের ইতিহাসের সূত্র ধরে আলোচিত হয়েছে এই ধর্মমতের বিভিন্ন ধারা, বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং তাদের পারস্পরিক টানাপড়েন, রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে ইসলামের দ্বন্দ্বময় জটিল সম্পর্ক, ঔপনিবেশিক ভারতে যে জটিলতা এক নতুন রূপ নেয়, যার উত্তরাধিকার আমরা আজও বহন করে চলেছি। পাঁচ ও ছ’নম্বর অধ্যায়ে আছে স্বাধীন ভারতের রাজনীতির কথা, সেই রাজনীতি কী ভাবে ‘সংখ্যালঘু’-কে তার মূলধন হিসেবে ব্যবহার করল এবং ব্যবহৃত হওয়া ও না-হওয়ার দ্বিধায় আন্দোলিত ভারতীয় মুসলমান কী ভাবে অনিশ্চিতি ও নিরাপত্তাহীনতার গ্রাসে তলিয়ে যেতে থাকল, তার বৃত্তান্ত এবং বিশ্লেষণ। এই ধারাতেই সপ্তম অধ্যায় মুসলিম মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করে, সমাজ ও রাজনীতির বিবর্তনকে বুঝতে যা কেবল সহায়কই নয়, অপরিহার্য।
অষ্টম অধ্যায়ের কথা শুরুতেই বলেছি। তার শিরোনাম: মুসলিম সমাজের পাল্টে-যাওয়া মুখ। সেটিই এ-বইয়ের বিস্তৃত আলোচনার প্রকৃত নিশানা। দেশভাগের পরে ভারতীয় মুসলমান ক্রমাগত যে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, গত তিন দশকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এবং গত সাত বছরে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে তার সর্বগ্রাসী অভিযানের ফলে সেই সঙ্কট এক অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। ভারতীয় মুসলমান নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা শঙ্কিত, এতটা উদ্বিগ্ন আগে কখনও হয়নি, নিরাপত্তাবোধের অভাব তার মনে ছিলই, কিন্তু সেই নিরাপত্তাহীনতাই এখন যেন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে; অনেকেই মনে করছেন— এমনটাই চলবে। এই পরিস্থিতির দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছেন গজ়ালা। এক দিকে মুসলমান সমাজের বহু মানুষ সংখ্যাগুরুবাদের প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে উত্তরোত্তর নিজের সংখ্যালঘু সত্তাকে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলে বাঁচতে চাইছেন, বাঁচবার তাড়নায় তাঁরা ধর্মীয় আচার এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে সংহতি খুঁজছেন। এ জন্য তাঁদের অপরাধী করলে তাড়নার বাস্তবটাকে অস্বীকার করা হবে, কিন্তু এই ‘গুটিয়ে যাওয়া’র সংহতি যে ভারতীয় মুসলমানকে আরও দুর্বল করছে এবং করবে, সেই সত্যও অনস্বীকার্য।
সেখানেই প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় ধরনটির গুরুত্ব ও সম্ভাবনা। শাহিন বাগ যার অনন্য প্রতীক। ২০১৯-২০’র প্রতিবাদী এবং প্রতিস্পর্ধী বিক্ষোভ সম্পর্কে গজ়ালা লিখেছেন, “সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে ভারতের নানা জায়গায় যে প্রতিবাদ, তা বাস্তবিকই ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতার সময় থেকে এই প্রথম তারা ধর্ম ছাড়া অন্য প্রশ্নে রাস্তায় নেমেছে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানিয়েছে, অনেক সময় হিংস্র আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে।” তাঁর মতে, এটাই ভারতীয় মুসলমানের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ। মানবাধিকারের প্রশ্নে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগার-সহ অর্থনীতি ও জীবনের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের প্রশ্নে সমবেত ভাবে দাবি জানানোর পথ।
লেখক যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকে আর একটা প্রকল্প শুরু করা দরকার। ভারতীয় মুসলমানের এই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামের সঙ্গে অন্য সমস্ত বর্গের শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন এবং সাধারণ সংগ্রামের সংযোগ সাধনের প্রকল্প। সেই সংযোগ যত বাড়বে, ভারতের সংখ্যালঘু মানুষের ‘গুটিয়ে যাওয়ার’ সংহতি খোঁজার প্রয়োজন তত কমবে। এবং, সেই জীবনমুখী অভিযাত্রায় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে বাংলা, গোটা মানচিত্র জুড়ে যত লোক আসতে থাকবে, মিছিল যত বড় হবে, সংখ্যাগুরুবাদের দানবকে প্রতিহত করার জোর তত বাড়বে। এটাই এখন কাজ।